Image description

কি রোদ, কি বৃষ্টি অথবা প্রচণ্ড ঠান্ডা; কোনো কিছুই যেন তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগোতে পারে না। রোদ, ঝড়-বৃষ্টি অথবা প্রচণ্ড ঠান্ডায় ক্ষণিকের জন্য শরীর প্রতারণা করলেও সাজামাল (৬৮) দ্রুতই উঠে দাঁড়ান। তিনি যেন থামতেই চান না। রিকশার প্যাডেলে ঝরান জীবনযুদ্ধের ঘাম। তার বড় পরিচয় তিনি একজন বাবা— যার স্বপ্ন শুধু দুই সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়া। এরই মধ্যে দুই সন্তানকে মাস্টার্স পর্যন্ত পড়িয়েছেন। রাজশাহী সদর উপজেলার বিনোদপুর ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের মির্জাপুর এলাকার এই মানুষটির জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে মিশে আছে সংগ্রাম, ত্যাগ আর অদম্য পরিশ্রমের গল্প।

 

সম্প্রতি এক দুপুরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) প্যারিস রোডে দেখা মেলে মো. সাজামালের সঙ্গে। প্রচণ্ড রোদে রিকশা চালানোর পর রাস্তার ধারে গাছতলায় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তিনি। ঘামে ভেজা শরীর, ক্লান্ত মুখ— তবু চোখে ছিল শান্ত এক তৃপ্তি; যেন দিনের ক্লান্তি ভুলে সামান্য বিশ্রামেই খুঁজে নিচ্ছিলেন নতুন শক্তি।

প্রশ্ন করতে সহজ ও সরল ভঙ্গিতে জীবনের গল্প বলা শুরু করলেন— ‘প্রায় পনরো বছর হইল রিকশা চালাই। এই রিকশা চালাইয়াই দুইটা ছেলে-বিটিরে মাস্টার্স পাশ করাইছি। ছাগল, হাঁস-মুরগি বিক্রি কইরা, ধার কইরা তাদের ফরম ফিলাপের টাকা দিছি। আগে কাঠমিস্ত্রির কাম করতাম, কিন্তু ওই কামে টিকতে পারি নাই। একদিন কাম পাইলে দুই-তিন দিন পাইতাম না, শরীরেও আর তেমন জোর নাই।’

এখন তার হাতে আছে একটাই রিকশা। আগে ছিল দুইটা। কিন্তু, সংসারের চাপে একটি বিক্রি করতে হয়েছে। সাজামাল বলেন, ‘ব্যাটারিচালিত রিকশা আসার পর থেকে আয় অনেক কমে গেছে। এখন কেউ আমার রিকশায় উঠতে চায় না। বলে প্যাডেলের রিকশা, আবার রিকশাও পুরান। চেনা কয়েকজনই ওঠে। দিনে দুই-তিনশ টাকা হয়, তাও যদি আবহাওয়া ভালো থাকে।’

বয়সের ভারে শরীর ভেঙে পড়ছে সাজামালের। প্রচণ্ড গরম বা বৃষ্টিতে রিকশা চালাতে পারেন না। ঠান্ডা, জ্বর, শ্বাসকষ্টে বিছানায় পড়ে যান। তিনি বলেন, ‘প্রতি মাসে দুই হাজার টাকার ওষুধ লাগে। দোকান থেকে বাকি আনি, খাই। এমনেই চলতেছি আরকি।’

জীবনযুদ্ধে হার না মানা রিকশাচালক সাজামাল। ছবি: সারাবাংলা

জীবনযুদ্ধে হার না মানা রিকশাচালক সাজামাল। ছবি: সারাবাংলা

একসময় চাকরির চেষ্টা করেছিলেন সাজামাল। কিন্তু অক্ষরজ্ঞান না জানায় প্রত্যাখ্যানের তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন বারবার। সেই কষ্ট থেকেই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে নিয়েছিলেন সন্তানদের লেখাপড়া করাবেন। আক্ষেপের সুরে তিনি বলেন, ‘যহন কোথাও দারোয়ানের চাকরির খোঁজে গেছি, তহন কয়— তুমি স্বাক্ষর জানো?’ ওই সময়ই ঠিক কইরা নিলাম, ‘আমার ছেলে-বিটিরে লেখাপড়া শিখামু।’

এখন জীবনের শেষপ্রান্তে এসে সাজামালের ভরসা তার সন্তানরা। ছেলে-মেয়ে প্রসঙ্গে তিনি বলেন ‘পনরো বছর রিকশা চালাইয়া, নিজের শেষ সম্বল দিয়া ছেলে-বিটিরে মাস্টার্স পাশ করাইছি। অনেক হইছে, এখন বয়স হইছে, শরীরেও জোর নাই। এখন আমার ছেলে-বিটিই আমার শেষ ভরসা।’

জীবনের সূর্য যখন পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে, তখনও থামেননি সাজামাল। বয়সের ভার, অসুস্থতা কিংবা দারিদ্র্য, কোনো কিছুই তার স্বপ্নের প্রদীপ নিভিয়ে দিতে পারেনি। ঘাম আর পরিশ্রমকে সঙ্গী করে একটানা প্যাডেল ঘুরিয়েছেন তিনি, শুধু সন্তানদের আলোর পথে দাঁড় করাতে। আজ তাদের সাফল্যেই খুঁজে পান নিজের জীবনের পূর্ণতা, খুঁজে পান জীবনের অর্থ।

রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, ক্লান্ত শরীরে রিকশার প্যাডেল ঘোরানো এই মানুষটির গল্প শুধু একজন পিতার নয়, এটি সেই সকল নীরব সংগ্রামী বাবাদের গল্প, যারা সন্তানের মুখে হাসি ফোটানোর স্বপ্নে প্রতিদিন নতুন করে লড়ে যান জীবনের সঙ্গে।