Ali Ahmad Mabrur (আলী আহমেদ মাবরুর)
আমাদের মামলাগুলোতে বিদেশী আইনজীবী ও পর্যবেক্ষকদের আসতে দেয়া হয়নি। আমার মনে আছে, যেহেতু আইনটা একটি বিশেষ আইন- তাই এই আইনের আওতায় বিচার নিয়ে আইনজীবীদের বাড়তি প্রশিক্ষনের প্রয়োজন পড়েছিল। ট্রেইনারও পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু তারা দেশে আসতে পারেননি। ইমিগ্রেশনে তাদের নামে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল।
বিদেশী পর্যবেক্ষকদের আসতে দেয়া হতো না। তখন বিদেশি চাপ থেকে বাঁচানোর জন্য আওয়ামী লীগের নেতারা বলতেন, আইনটা বিদেশি কিন্তু অপরাধ দেশি। মানে জগাখিচুড়ি দিয়ে চালানো। মানবাধিকার কত সংস্থা তখন আপত্তি জানিয়েছিল, বিচারের প্রক্রিয়া অস্বচ্ছ, আন্তর্জাতিক মানসম্মত নয়- এগুলো বলে বিবৃতি দাবি করেছিল। আওয়ামী লীগ পাত্তা দেয়নি। বলেছিল, এগুলো নাকি আসামী পক্ষের লবিস্টরা টাকা দিয়ে বানিয়েছে।
অথচ শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ডের রায় দেয়া হলো; কারো কোনো প্রতিক্রিয়া বা সমালোচনা নেই। কারণ এখানে অপরাধ দৃশ্যমান এবং এগুলো সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। সেই আমলে জাতিসংঘ এবং জাতিসংঘ মানবাধিকরা কমিশনের নানা অবজারভেশন নিয়েও আওয়ামী লীগ পরিহাস করেছে। আর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্ট দিয়েছে খোদ জাতিসংঘই। সেই রেফারেন্স গতকালের রায়ে বারবার দেয়া হয়েছে। এই রায় আন্তর্জাতিক মানদন্ডে উত্তীর্ণ এবং এক্সপার্টদের রেফারেন্সে সমৃদ্ধ একটি রায়।
আরাফাত সাহেব দেখলাম কাল একটি সাক্ষাতকারে বলছেন, “বিচার নাকি সঠিকভাবে হয়নি। কারণ আওয়ামী আমলে যারা ডিফেন্স আইনজীবী ছিলেন তারা এখন প্রসিকিউটর। আমি অবাক হলাম এটা কোনো যুক্তি হলো? দেশের পট পরিবর্তন হয়েছে। খেলার বোর্ড উল্টে গেছে। তাহলে এমন হওয়া তো অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু বিচারিক প্রক্রিয়ায় কোনো ত্রুটি হয়েছে কিনা- তারা তা নিয়ে বলতে পারতেন। কিন্তু একজন আওয়ামী লীগারকেও এই নিয়ে কথা বলতে দেখলাম না।
আওয়ামী আমলে ট্রাইবুনালের রায় লিখে দেয়া হতো বিদেশ থেকে। জনৈক আহমেদ জিয়াউদ্দিন এই গুরু দায়িত্বটা পালন করতেন। এটা তখনকার আওয়ামী সেনাদের অনেকেই জানতেন। কিন্তু এই অনিয়মটা তারা বরদাশত করতেন। প্রসিকিউশন আর বিচারকদের মধ্যে সখ্যতা ছিল ওপেন সিক্রেট। অথচ সেই বিচার তাদের কাছে ভালো ছিল, গ্রহণযোগ্যও ছিল। অথচ এবারের বিচার নিয়ে তাদের কত কথা। আমার মতে শেখ হাসিনার এখন উচিত হবে দেশে এসে কারাগারে যাওয়া, আইনগতভাবে মামলা ফেইস করা। তাহলে তার একটি ভাবমূর্তি তৈরি হলেও হতে পারে।
পরিশেষে, একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। ঐ আমলে জামায়াত বা যে কোনো মহল বিবৃতি দিতে খুব সতর্ক থাকতো। আমার মনে আছে, আমাদের পিতা ও তার সহকর্মীদের বিরুদ্ধে যখন রায় ঘোষণা হতো, তখন দলকে বাধ্য হয়েই একটি প্রতিক্রিয়া দিতে হতো। সেই বিবৃতির একটি শব্দও কোনোভাবে যেন আদালতের বিরুদ্ধে না যায়, সে জন্য কতবার যে এডিট করা হতো। আইনজীবীদের মতামত নেয়া হতো। এরপরও আমাদের তৎকালীন দায়িত্বশীলদের অনেককেই ভুগতে হয়েছে।
মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, সেলিম উদ্দিন ভাইকে আদালত অবমাননার মামলা ফেইস করতে হয়েছে। বর্ষীয়ান সাংবাদিক ও সম্পাদক আবুল আসাদকে আদালতে গিয়ে ক্ষমা চাইতে হয়েছে। অথচ এবার শেখ হাসিনার রায়ের পর অনেককেই নানা ধরনের আগ্রাসী মন্তব্য করতে দেখলাম। আমি জানিনা, আদালত তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিবেন কিনা। তবে শেখ হাসিনার মামলাটি যেভাবে উন্নত বিচারিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছে আর রায়ের পর এত সরব ভূমিকার পরও তার সমর্থকেরা যেভাবে স্বস্তিতে আছেন, সেই বিচারে তাদেরকে আমাদের তুলনায় সৌভাগ্যবানই বলতে হবে।