সাতক্ষীরার সবচেয়ে দক্ষিণের উপজেলা শ্যামনগর। জেলা সদর থেকে ৫২ কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান। সুন্দরবনের কোলঘেঁষা উপজেলাটির ভূদৃশ্য খুবই মনোহর। সুন্দরবন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের দোতলা–তিনতলা থেকে চারপাশের বহু দূর পর্যন্ত জলরাশি ও গাছের সারি বাধাহীনভাবে চোখে ধরা পড়ে। উপজেলা সদর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে তিনতলা ভবনের স্কুলটির অবস্থান মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নে।
২২ সেপ্টেম্বর টানা বৃষ্টির মধ্যে সাতক্ষীরা সদর উপজেলা থেকে স্কুলটিতে পৌঁছাতে সময় লেগে গেল তিন ঘণ্টা। দুপুর ১২টায় স্কুলে পৌঁছে দেখা যায়, কয়েকটি ক্লাস চলছে। কয়েকটি ক্লাসের মেয়েরা ক্লাস শুরুর অপেক্ষায়। উপস্থিতি কম। দশম শ্রেণির ক্লাসে গিয়ে কথা হয় কয়েকজন ছাত্রীর সঙ্গে। তারা জানাল, তাদের ক্লাসে ছাত্রীর সংখ্যা এমনিতেই কম। ফলে উপস্থিতিও কম থাকে।
কেন কম জানতে চাইলে চারজন ছাত্রী জানাল, তারা ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে এই স্কুলে পড়ে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে তারা ৪০ জন ছিল। এর মধ্যে ৪ জন অন্য স্কুলে চলে গেছে। বাল্যবিবাহের শিকার একজনসহ দশম শ্রেণিতে ১৭ জন ছাত্রী আছে। ২০ জনের বাল্যবিবাহ হয়ে গেছে। অর্থাৎ দশম শ্রেণি পর্যন্ত পৌঁছাতে পৌঁছাতে এই ব্যাচের মেয়েদের ৫০ শতাংশের বাল্যবিবাহ হয়েছে। বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েদের মধ্যে শুধু একজন ক্লাসে ফিরে এসেছে। বাকিদের কেউ কেউ এরই মধ্যে মা হয়েছে।
কেন কম জানতে চাইলে চারজন ছাত্রী জানাল, তারা ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে এই স্কুলে পড়ে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে তারা ৪০ জন ছিল। এর মধ্যে ৪ জন অন্য স্কুলে চলে গেছে। বাল্যবিবাহের শিকার একজনসহ দশম শ্রেণিতে ১৭ জন ছাত্রী আছে। ২০ জনের বাল্যবিবাহ হয়ে গেছে। অর্থাৎ দশম শ্রেণি পর্যন্ত পৌঁছাতে পৌঁছাতে এই ব্যাচের মেয়েদের ৫০ শতাংশের বাল্যবিবাহ হয়েছে।
জেলার দক্ষিণ প্রান্তের উপকূলীয় এই স্কুল শুধু নয়, সাতক্ষীরা শহর ও এর উত্তর প্রান্তের উপজেলার স্কুলগুলোতেও বাল্যবিবাহের একই রকম প্রকোপ। বাল্যবিবাহ নিরোধ নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিদের মতে, এ জেলায় বাল্যবিবাহ হয় না এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই বললেই চলে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে যতসংখ্যক মেয়ে ভর্তি হচ্ছে, দশম শ্রেণিতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে শুধু বাল্যবিবাহের কারণে ওই ছাত্রীদের ৩০ থেকে ৪৮ শতাংশ ঝরে পড়ছে।
২০ থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর ৪ দিনে জেলার ৭টি স্কুল ও মাদ্রাসা পরিদর্শন করে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এ ছাড়া ৪টি স্কুলের তথ্য আলাদাভাবে সংগ্রহ করা হয়। এতে দেখা গেছে, ওই ১১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটেছে। এ বছরও বাল্যবিবাহ হয়েছে। শুধু একটি মাদ্রাসার শিক্ষকেরা দাবি করেন, গত তিন বছরে সেখানে বাল্যবিবাহ হয়নি। যদিও এ দাবি সত্য নয় বলে জানিয়েছেন অন্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও স্থানীয় অধিকারকর্মীরা।
এক উপজেলায় দেড় শতাধিক বাল্যবিবাহ
শ্যামনগর উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজার মিনা হাবিবুর রহমান জানান, সেপ্টেম্বর মাসে তাঁরা একটি জরিপ চালিয়ে ধারণা করছেন, শ্যামনগর উপজেলায় চলতি বছরের এ পর্যন্ত অন্তত ১৬০ ছাত্রীর বাল্যবিবাহ হয়েছে। উপজেলায় ৩৬টি মাদ্রাসাসহ মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে ৮২টি। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমিক স্তরের ১ হাজার ১২ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৮০০ জন ছাত্রী। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৭০ শতাংশই অনিয়মিত। এর মধ্যে ৩৫ শতাংশ ঝরে পড়েছে। এই শিক্ষার্থীদের ২৫ শতাংশ মেয়ে। এর মধ্যে অন্তত ২০ শতাংশ বাল্যবিবাহের শিকার।
বাল্যবিবাহ নিরোধ নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিদের মতে, এ জেলায় বাল্যবিবাহ হয় না এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই বললেই চলে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে যতসংখ্যক মেয়ে ভর্তি হচ্ছে, দশম শ্রেণিতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে শুধু বাল্যবিবাহের কারণে ওই ছাত্রীদের ৩০ থেকে ৪৮ শতাংশ ঝরে পড়ছে।
হাবিবুর রহমান বলেন, বাল্যবিবাহের কারণে দশম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলগুলোতে গড়ে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ এবং মাদ্রাসাগুলোতে ৫০ শতাংশ ছাত্রী থাকে না। কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ হার আরও বেশি। শিক্ষকেরা এসে বলেন, ‘স্যার, আমার স্কুলে বাল্যবিবাহ হয়ে যাচ্ছে।’ অভিভাবকদের বলেও কিছু করা যাচ্ছে না। শিক্ষকেরাও নিবেদিতপ্রাণ নন, খোঁজ রাখেন না। এ ছাড়া শিক্ষকেরা এমপিওভুক্তি, উপবৃত্তি বাতিল হতে পারে ভেবে বাল্যবিবাহের খবর খুব একটা প্রকাশ করতে চান না।
হাবিবুর রহমানের মতে, সরকার এই মুহূর্তে কঠোর পদক্ষেপ না নিলে এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে। বাল্যবিবাহ নিবন্ধন না হওয়ায় নির্যাতন বা বিবাহবিচ্ছেদের শিকার হলেও মেয়েরা কোনো আইনি প্রতিকার পায় না।
২০ থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর ৪ দিনে জেলার ৭টি স্কুল ও মাদ্রাসা পরিদর্শন করে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এ ছাড়া ৪টি স্কুলের তথ্য আলাদাভাবে সংগ্রহ করা হয়। এতে দেখা গেছে, ওই ১১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটেছে।

মেয়ের বাল্যবিবাহ দিয়েছে এমন পরিবারগুলোতে গিয়ে কথা হয়েছে অভিভাবকদের সঙ্গে। তাঁদের কেউ বলেছেন, দারিদ্র্য ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। কেউ কেউ বলেন, ‘ভালো ছেলে’ পেয়ে যাওয়ায় মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। কেউ কেউ বলেন, তাঁরা দেননি, ছেলেমেয়েরা নিজেরা পছন্দ করে বিয়ে করেছে।
২০২৩ সালে ব্র্যাকের সোশ্যাল এমপাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড লিগ্যাল প্রোটেকশন (সেলপ) কর্মসূচি ‘বর্ন টু বি আ ব্রাইড’ (কনে হওয়ার জন্যই জন্ম) শিরোনামে জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, মাধ্যমিক শিক্ষার শেষ পর্যায়ে থাকা ১৬-১৭ বছর বয়সী মেয়েরা বাল্যবিবাহের সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে। জরিপের সময় থেকে আগের ৫ বছর ধরে নবম শ্রেণিতে পড়া মেয়েদের বিয়ে হওয়ার হার সবচেয়ে বেশি ছিল। এ হার ছিল ৪৬ শতাংশের বেশি। বাল্যবিবাহের পেছনে দারিদ্র্যকে বড় কারণ বলা হলেও জরিপে উঠে এসেছে ধনী ও মধ্যবিত্ত পরিবারেও বাল্যবিবাহের হার ৫০ শতাংশের ওপর। বাল্যবিবাহ দেওয়ার পেছনে পরিবারগুলো মূলত তিনটি কারণের কথা উল্লেখ করেছে। এর মধ্যে ৪৪ শতাংশ বলেছে, ‘উপযুক্ত’ পাত্র পাওয়া, ১৮ শতাংশ দারিদ্র্যের কথা বলেছে, ১০ শতাংশ বলেছে বরপক্ষের যৌতুকের চাহিদা নেই বা কম। মাত্র ৭ শতাংশ নিরাপত্তাহীনতার কথা বলেছে।
সাতক্ষীরা জেলার বাল্যবিবাহের হার
জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বাল্যবিবাহের প্রবণতা নিয়ে গত বছরের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত হয় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘স্মল এরিয়া এস্টিমেশন’ প্রতিবেদন। ওই প্রতিবেদন অনুসারে, জেলাগুলোতে বাল্যবিবাহের দিক দিয়ে সাতক্ষীরার অবস্থান অষ্টম। এ জেলায় ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বাল্যবিবাহের হার ৬২ শতাংশের বেশি। প্রতিবেদন অনুসারে, ৬৫ শতাংশ বাল্যবিবাহের হার নিয়ে শীর্ষে রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ।
সাতক্ষীরায় ছেলেদেরও বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটে। ছেলেদের বাল্যবিবাহের সুর্নিদিষ্ট হিসাব পাওয়া না গেলেও বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২৩–এর প্রতিবেদন থেকে পাওয়া যায়, শহরাঞ্চলে প্রতি হাজারে ৭৩ জন মেয়ে ও ১৪ জন ছেলে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সের মধ্যে বিয়ে করছে।
বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) ২০২২ প্রতিবেদন অনুসারে, দেশে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বাল্যবিবাহের হার ৫০ শতাংশ।
বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ অনুসারে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়ে এবং ২১ বছরের কম বয়সী ছেলের বিয়ে হলে তা বাল্যবিবাহ। আইনে বাল্যবিবাহ করা, সম্পাদন ও পরিচালনার জন্য সর্বোচ্চ ২ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। ১৯ ধারায় বিশেষ বিধান অনুসারে, বিশেষ প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্তবয়স্কের সর্বোত্তম স্বার্থে আদালতের নির্দেশে এবং মা-বাবা কিংবা অভিভাবকের সম্মতিতে বাল্যবিবাহ হলে অপরাধ গণ্য হবে না।
সাতক্ষীরায় ছেলেদেরও বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটে। ছেলেদের বাল্যবিবাহের সুর্নিদিষ্ট হিসাব পাওয়া না গেলেও বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২৩–এর প্রতিবেদন থেকে পাওয়া যায়, শহরাঞ্চলে প্রতি হাজারে ৭৩ জন মেয়ে ও ১৪ জন ছেলে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সের মধ্যে বিয়ে করছে।
শহরাঞ্চলেও বাল্যবিবাহের ‘কমতি’ নেই
ভূদৃশ্যের দিক দিয়ে সাতক্ষীরার উত্তর ও দক্ষিণের চিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। তবে প্রাকৃতিক বৈসাদৃশ্য যা–ই হোক, বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে উপজেলাগুলোতে তেমন কোনো হেরফের নেই। শহর ও গ্রাম—কোথাও বাল্যবিবাহ থেমে নেই।
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার বাটকেখালীতে অবস্থিত কারিমা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির এক ছাত্রী দুই মাস ধরে স্কুলে অনুপস্থিত। ২১ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টায় ওই স্কুলে গিয়ে কথা হয় তার সহপাঠী ও শিক্ষকদের সঙ্গে। জানা গেল, মেয়েটির বাল্যবিবাহ হয়ে গেছে। স্কুল থেকে ১৫–২০ মিনিটের হাঁটা দূরত্বে তাদের বাড়ি। বাড়িতে গিয়ে কথা হয় মেয়েটির মায়ের সঙ্গে। দুই কক্ষের পাকা ঘরের বারান্দায় বসে সবজি কুটছিলেন তিনি। এই প্রতিবেদককে জানান, তাঁর তিন মেয়ে, এক ছেলের মধ্যে এই মেয়ে দ্বিতীয়। দুই মাস আগে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘গরিব মানুষ, ভালো পাত্র পাইছি। তাই দিয়ে দিছি। ওরা (মেয়ের শ্বশুরবাড়ি) আগ্রহ দেখিয়ে নিইয়ে গেছে। ও যখন ছোট, তখন থেকেই বলে রাখত, মেয়েক আমরা নেব।’ মেয়ে আর স্কুলে যাবে কি না, জানতে চাইলে তিনি ঘাড় নেড়ে বলেন, ‘ওদের কাছে শোনা হয়েছে, পড়াবে না।’
স্কুলে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এক বছরে মেয়েটির আরও ছয় সহপাঠীর বিয়ে হয়ে গেছে। স্কুলের নবম শ্রেণির ‘ক’ শাখার শ্রেণিশিক্ষক মফিজুল ইসলাম বলেন, হুট করেই ছাত্রছাত্রীরা স্কুলে অনুপস্থিত থাকে। ফোন করলে অভিভাবকদের কাছ থেকে জানা যায়, ছেলেদের শিশুশ্রমে দেওয়া হয়েছে আর মেয়েদের বাল্যবিবাহ হয়ে গেছে। তিনি জানান, তাঁর শ্রেণিতে ৫৪ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রী ৩০ জন। এক বছরে ৮ মেয়ের বিয়ে হয়েছে। এর মধ্যে একজন বলেছে, সে স্কুলে আসবে।
গরিব মানুষ, ভালো পাত্র পাইছি। তাই দিয়ে দিছি। ওরা (মেয়ের শ্বশুরবাড়ি) আগ্রহ দেখিয়ে নিইয়ে গেছে। ও যখন ছোট, তখন থেকেই বলে রাখত, মেয়েক আমরা নেব।বাল্যবিয়ের শিকার মেয়ের মা
শহরে অবস্থিত ৫০ বছরের পুরোনো পলাশপোল আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোমিনুল ইসলাম বলেন, তাঁর স্কুলে দশম শ্রেণির তিন ছাত্রীর এ বছর বিয়ে হয়ে গেছে।
শহরের কামাল উদয়ন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের এক ছাত্রী জানায়, তারা অষ্টম শ্রেণিতে পড়ত ৪০ জন। নবম শ্রেণিতে এখন ৩৪ জন মেয়ে পড়ে। তাদের ৬ সহপাঠীর বাল্যবিবাহ হয়েছে।
স্কুলের সহকারী শিক্ষক আবুল কাসেম বলেন, এটা দরিদ্র এলাকা। অভিভাবকেরা মেয়েদের বেশি পড়াতে চান না। এ ধরনের অনেক পরিবারের মেয়েদের মধ্যে পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মতো স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয় না। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, কিছু বখাটে ছেলের উৎপাত আছে। কোনো কোনো মেয়ে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে নিজেরাও বিয়ে করে ফেলে।
স্কুলটির দশম শ্রেণির এক ছাত্র জানায়, তাদের ক্লাসে ৬ জন ছাত্রী ছিল। এর মধ্যে ৩ জনের বিয়ে হয়ে গেছে। তাদের ক্লাসে এখন মোট ২২ জন ছাত্রছাত্রী রয়েছে। অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রী জানাল, তার দুই সহপাঠীর একজনের ষষ্ঠ শ্রেণিতে ও আরেকজনের সপ্তম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বিয়ে হয়।
শহরের ৫৭ বছরের পুরোনো সাতক্ষীরা আলিয়া কামিল মাদ্রাসার শিক্ষকেরা স্বীকার করেননি যে সেখানে বাল্যবিবাহ আছে। অধ্যক্ষ মুফতি আখতারুজ্জামান বলেন, নারীর স্বাস্থ্য, শিক্ষা নিয়ে এনজিওরা তাঁদের মাদ্রাসায় এসে কাজ করার সুযোগ পায় বলে তিন বছর ধরে বাল্যবিবাহ বন্ধ রয়েছে।
তবে সাতক্ষীরা জেলা বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কমিটির সদস্য সাকিবুর রহমান বলেন, জেলাজুড়ে এমন কোনো স্কুল পাওয়া যাবে না, যেখানে বাল্যবিবাহ হচ্ছে না। কোনো প্রতিবাদ, প্রতিরোধ নেই। জেলা প্রশাসনের কোনো নজরও নেই। ভোটের প্রত্যাশায় রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা বাল্যবিবাহের পক্ষে অবস্থান নেন।
ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে বাল্যবিবাহ শুরু
শ্যামনগরের সুন্দরবন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির এক ছাত্রী বলল, ওরা ষষ্ঠ শ্রেণিতে ছিল ৩০ জন। এখন আছে ২১ জন। বাকি ৯ জনের বিয়ে হয়ে গেছে।
অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রীর ভাষ্য, তারাও ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ত ৩০ জন। এখন আছে ১৮ জন। বাকি ১২ জনের মধ্যে ১১ জনের বিয়ে হয়ে গেছে এবং একজন মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েছে।
সুন্দরবন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক রণজিত বর্মণ জানান, এই বছর কমপক্ষে ১০ জনের বাল্যবিবাহ হয়েছে। গত দুই বছরে দুটো মেয়ে বিবাহবিচ্ছেদেরও শিকার হয়। এর মধ্যে একটি মেয়ে পড়াশোনা অব্যাহত রেখে এসএসসি পাস করে।
দারিদ্র্য, শিক্ষা নিয়ে অসচেতনতা, মেয়ে নিয়ে নিরাপত্তাহীনতা, প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে মেয়ে নিজে বিয়ে করতে পারে—এই ভয় থেকেই বাল্যবিবাহ হচ্ছে বলে এই শিক্ষক মনে করেন।
শ্যামনগরের বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নে অবস্থিত পোডাকাটলা দীপায়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়। স্কুলে যাওয়ার পথের দুই ধারে কাঁকড়া চাষের ঘের। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যঘেরা তিনতলা স্কুলটিতে গিয়ে কথা হয় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। প্রধান শিক্ষক অনংগ কুমার মণ্ডল জানান, তাঁর স্কুলে মোট শিক্ষার্থী ২৩৯ জন। এর মধ্যে ছাত্রী ১০২ জন। তিনি জানান, এই ইউনিয়নে ১৫–১৬ বছর বয়সে মেয়েদের বিয়ের হার বেশি।
স্কুলটির দশম শ্রেণির এক ছাত্র জানায়, তাদের ক্লাসে ৬ জন ছাত্রী ছিল। এর মধ্যে ৩ জনের বিয়ে হয়ে গেছে। তাদের ক্লাসে এখন মোট ২২ জন ছাত্রছাত্রী রয়েছে। অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রী জানাল, তার দুই সহপাঠীর একজনের ষষ্ঠ শ্রেণিতে ও আরেকজনের সপ্তম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বিয়ে হয়।
শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা গোপাল লক্ষ্মী মেমোরিয়াল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইয়াসমিনুর রহমান জানান, তাঁর স্কুলে গত এক বছরে ২৫ জনের বাল্যবিবাহ হয়েছে। তাঁরা কোনো অবস্থায় বাল্যবিবাহ ঠেকাতে পারছেন না।
২৩ সেপ্টেম্বর তালা উপজেলার কাশিয়াডাংগা দাখিল মাদ্রাসায় গিয়ে কথা হয় ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে। দশম শ্রেণির ছাত্রীরা জানায়, ষষ্ঠ শ্রেণিতে ২৫ জন মেয়ে ছিল; এখন আছে ১৫ জন। ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত বিয়ে হয়েছে ৫ জনের। এ বছর বিয়ে হয়েছে আরও ৫ জনের।
মাদ্রাসার সহকারী সুপার মো. রবিউল ইসলাম বলেন, এ বছর ১০–১২ জনের বিয়ে হয়েছে বলে জানতে পেরেছেন।
তালা উপজেলার খলিশখালী শৈব বালিকা বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির এক ছাত্রী জানায়, ষষ্ঠ শ্রেণিতে তারা ৭৩ জন ছিল। এখন ৪৩ জন আছে। এ বছর ৭ জনের বাল্যবিবাহ হয়েছে। নবম শ্রেণির এক ছাত্রী বলল, ষষ্ঠ শ্রেণিতে ৭৩ জন ছিল, এখন আছে ৫৩ জন। এর মধ্যে ৪ জন অন্য স্কুলে চলে গেছে। বাকি ১৬ জনের বিয়ে হয়ে গেছে।
কোভিডের সময় ৮ মাসে ‘সাতক্ষীরার এক স্কুলেই ৫০ বাল্যবিবাহ’ শিরোনামে ২০২১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। জেলায় এখনো ওই প্রতিবেদনকে রেফারেন্স ধরে আলোচনা হয়। সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ওই স্কুলের নাম আলিপুর আদর্শ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়। স্কুলের প্রধান শিক্ষক আব্দুল লতিফ জানালেন, পরিস্থিতির আগের চেয়ে উন্নতি হয়েছে। তবে এখনো ৭-৮ শতাংশ ছাত্রীর বাল্যবিবাহ হচ্ছে।
ওই স্কুলের দশম শ্রেণির এক ছাত্রী বলল, এ বছর তার ৬ সহপাঠীর বিয়ে হয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় তাদের ক্লাসে ছাত্রী ছিল ৮০ জন। এখন আছে ২৮ জন। নবম শ্রেণির এক ছাত্রী জানায়, এ বছর তাদের ক্লাসের ৪ জনের বিয়ে হয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে তারা ৭২ জন ছাত্রী ছিল, এখন আছে ৫৫ জন।
সাতক্ষীরা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মুহা. আবুল খায়ের তাঁর কার্যালয়ে প্রথম আলোকে বলেন, আশাশুনি ও শ্যামনগর উপকূলীয় এলাকায় স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার বেশি। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছে এমন মেয়েদেরও বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। বিয়ে না দিতে বললে অভিভাবকেরা বলেন, ‘আপনি কি দায়িত্ব নেবেন?’ বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে নজরদারির ঘাটতি রয়েছে স্বীকার করে আবুল খায়ের বলেন, লোকবলের অভাবে নজরদারি কম। সাত উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার পদের ৪টিই শূন্য।
বিবিএসের স্মল এরিয়া এস্টিমেশন প্রতিবেদন অনুসারে, সাতক্ষীরার সাতটি উপজেলার মধ্যে শ্যামনগরে বাল্যবিবাহের হার সবচেয়ে বেশি, এ হার ৬৩ শতাংশ। এ ছাড়া কলারোয়া ও কালীগঞ্জে প্রায় ৬৩ শতাংশ, তালা ও আশাশুনিতে ৬২ ও সাতক্ষীরা সদর ও দেবহাটা উপজেলায় প্রায় ৬২ শতাংশ বাল্যবিবাহ হচ্ছে।
সাতক্ষীরা জেলা শিক্ষা কার্যালয়ের তথ্য অনুসারে, ২২টি নিম্নমাধ্যমিক (ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি) মোট মাধ্যমিক স্কুল রয়েছে ৩১৫টি। মাদ্রাসা রয়েছে ২১৪টি। স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৮৭ হাজার ৭৩৫। এর মধ্যে ছাত্রীর সংখ্যা ৪৭ হাজার ৭৪৭। মাদ্রাসার ৬৩ হাজার ৪৪ জনের মধ্যে ছাত্রী ২৯ হাজার ৫১৬ জন। এ ছাড়া কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আড়াই হাজারের বেশি ছাত্রী রয়েছে।
বিয়ের পর বিপাকে পরিবার
গত আগস্ট মাসে সদর উপজেলার বৈকারী ইউনিয়নের এক মাদ্রাসার নবম শ্রেণির ছাত্রীর বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করে প্রশাসন। ২১ সেপ্টেম্বর বিকেলে মেয়েটির বাড়িতে গেলে তার মা–বাবা প্রথমে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান। একপর্যায়ে কথা বলতে রাজি হন। মা–বাবা জানান, এ বছরের শুরুতে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলেন। ছেলে খারাপ স্বভাবের হওয়ায় ১৫ দিন পর তাঁরা বিবাহবিচ্ছেদ ঘটান। গত মাসে মেয়ের আবার বিয়ের আয়োজন করেন। মেয়ের সাবেক স্বামী প্রশাসনকে ফোন করে বিয়ে ভেঙে দিয়েছে বলে মনে করছেন তাঁরা। মেয়েটির মা বলেন, ‘অন্য কারও বিয়ে কি বন্ধ রইল? খালি আমার মেয়ের বিয়ে বন্ধ রইল।’ মেয়েটি জানায়, তার ৫ সহপাঠীর এ বছর বিয়ে হয়েছে।
একই উপজেলার কুশখালী ইউনিয়নে গিয়ে কথা হয় বাল্যবিবাহ করা এক ছেলের মায়ের সঙ্গে। ওই মা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মেয়ের (দশম শ্রেণির ছাত্রী) বাবা মামলা করায় তিনি, তাঁর স্বামী ও ছেলে সাতক্ষীরা কারাগারে এক মাসের দণ্ড খেটে এসেছেন। পুত্রবধূকে প্রশাসন পাঠিয়ে দিয়েছে বাগেরহাটের সরকারি হোমে। ঘটনাটি জানুয়ারি মাসের। তিনি বলেন, ‘আমাদের দোষ হলো বাড়িতে জায়গা দিলাম তাই। পালায় বিয়ে করছে। বাড়ি এইসে উঠি পা-হাত পা জড়াই ধরে বলে, “আমাদের যদি বের করে দ্যান মরণ ছাড়া কিছু নাই’। এখন মা-বাপ ফেইলে দিত পারে?’
গত বছরের অক্টোবরে কুশখালীতে ১৫ বছরের মেয়ে ও ২০ বছর ছেলের বাল্যবিবাহ হয়। দুজনই প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত প্রশাসনের পক্ষ থেকে যার যার বাড়িতে থাকার মুচলেকা আদায় করা হয়।
তালা উপজেলার মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, সাতক্ষীরা জেলায় চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত ১১২টি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করা হয়েছে। গত বছর প্রথম ৮ মাসে প্রতিরোধ করা হয়েছিল ১৪৩টি।
মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের উপপরিচালক নাজমুন নাহার বলেন, তাঁরা শুধু প্রতিরোধের তথ্য রাখেন। অনেক অভিভাবক অন্য এলাকায় নিয়ে বিয়ে দেয়। প্রতিরোধের সময় মুচলেকা দেওয়া অনেক মা–বাবাও পরে অন্য এলাকায় নিয়ে বিয়ে দেন। তিনি বলেন, ব্যর্থ প্রেমিক আর পারিবারিক ও রাজনৈতিক শত্রুতা রয়েছে—এমন পক্ষগুলো ছাড়া বাল্যবিবাহের খবর কেউ দেয় না। নজরদারির জন্য আলাদা কাঠামো গঠন, লোকবল বাড়ানো, যানবাহন দেওয়া, মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার এখতিয়ার দিলে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কার্যকর ফল পাওয়া যাবে বলে মনে করেন তিনি।
যে পরিবারগুলো ছেলেদের সঙ্গে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের বাল্যবিবাহ দিয়েছে, তারা সরাসরি কোনো মন্তব্য করতে চায়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাজমুন নাহার বলেন, বেশির ভাগ সময় বরের পরিবার বলে, ‘ভুল হয়ে গেছে’। তাদের মনোভাব হচ্ছে, ‘বয়স যত কম, ততই ভালো। প্রেমের সম্পর্কে জড়ানোর সুযোগ পাবে না।’
‘বাল্যবিবাহ সরকারের কাছে গুরুত্ব পায় না’
বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েদের বেশির ভাগই স্কুলে ফিরে আসে না। ফলে একদিকে তাদের সম্ভাবনা নষ্ট হয়, অপরদিকে অল্প বয়সে মা হওয়ার কারণে তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দেয়। অপুষ্ট সন্তানের জন্ম হয়।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, সাতক্ষীরা শুধু নয়, দেশের প্রায় সব জেলার বাল্যবিবাহের চিত্র প্রায় একই রকম। বাল্যবিবাহ রাজনৈতিক বিষয় নয় বলে এটা সরকারের কাছে গুরুত্ব পায় না। তিনি বলেন, বাল্যবিবাহের কারণগুলোর একটি হলো মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষাব্যবস্থা ব্যয়বহুল। দরিদ্র পরিবারগুলো মেয়েদের জন্য এই খরচ টানতে চায় না। মাধ্যমিক স্কুলগুলো বেশ দূরে দূরে অবস্থিত। অনেকখানি পথ হেঁটে আসা–যাওয়া করতে হয় বলে পরিবারগুলো নিরাপত্তাহীনতার কথা ভেবে মেয়েদের পাঠাতে চায় না। এ ছাড়া রয়েছে মেয়েদের বেশি পড়াতে না চাওয়ার মতো সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি।
রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে উপবৃত্তি বাড়াতে হবে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক করতে হবে। কারণ, এরপর কারিগরি শিক্ষায় যাওয়ার সুযোগ থাকে। কার্যকর পরিকল্পনার নেওয়ার জন্য রাখঢাক না করে সরকারের উচিত বাল্যবিবাহের প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করা।
