বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে ঘিরে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় রাজসাক্ষী সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুনকে ৫ বছর কারাদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। সোমবার ঘোষিত রায়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের মৃত্যুদণ্ড হলেও চৌধুরী মামুনের ৫ বছরের সাজার রায় মেনে নিতে পারছেন না জুলাই যোদ্ধা, শহীদ পরিবারসহ সংশ্লিষ্ট সবাই। সাধারণ জনগণও তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, হাসিনার নির্দেশ পালন করা আইজিপি মামুনের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত ছিল। তাকে নিদেনপক্ষে যাবজ্জীবন শাস্তি দেওয়া যেত বলেও মনে করেন তারা। যদিও সোমবার নিজের কানে ৫ বছরের সাজার রায় শোনার পর চৌধুরী মামুন আদালত ও জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছেন।
জুলাই যোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যরা মনে করেন, জুলাই আন্দোলন দমনে শেখ হাসিনার নির্দেশ মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন করেন তৎকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত আইজিপি চৌধুরী মামুন। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পরও তার পুলিশ বাহিনী আশুলিয়া, যাত্রাবাড়ীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলনকারীদের গুলি করে পাখির মতো হত্যা করে। আশুলিয়ায় আন্দোলনকারীদের পুড়িয়েও হত্যা করা হয়। আন্দোলনে ছাত্র-জনতাকে হত্যায় জড়িত চৌধুরী মামুন তার বাহিনীকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেননি। ফলে টানা ৩৬ দিনের আন্দোলনে ১৪০০-র মতো ছাত্র-জনতাকে হত্যা ও ত্রিশ হাজারের মতো মানুষকে আহত করার দায়ে সাবেক আইজিপিরও একইভাবে সর্বোচ্চ সাজা হবে-এমনটি ধারণা করছিলেন শহীদ পরিবার ও আহতরা। রায় ঘোণার পর তারা তাদের অসন্তোষের কথা জানান।
জুলাই আন্দোলনে শহীদ মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধর বাবা মীর মুস্তাফিজুর রহমান রায় শোনার জন্য ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত হয়েছিলেন। তিনি বলেন, শেখ হাসিনার সাজার এই রায়ে আমরা সন্তুষ্ট হলেও পুলিশের আইজি আব্দুল্লাহ আল-মামুনের রায়ে সন্তুষ্ট নই। এই রায় মানি না। তিনি বলেন, সাবেক আইজিপির কমপক্ষে যাবজ্জীবন সাজা দিতে হবে। আমরা প্রয়োজনে আপিল করব।
মীর মুগ্ধর ভাই মীর স্নিগ্ধও সাবেক আইজিপি মামুনের রায়ে খুশি নন। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা ও কামালের রায়ের বিষয়ে আমরা একমত। তবে মামুনের বিষয়ে যে রায় এসেছে তা আমরা প্রত্যাখ্যান করছি। শহীদ পরিবারের পক্ষ থেকে আমরা উচ্চ আদালতে যাব। কমপক্ষে যাবজ্জীবন সাজা চাই তার। ট্রাইব্যুনালে রায় শোনার জন্য উপস্থিত অনেক যোদ্ধা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, চৌধুরী মামুনের যাবজ্জীবন শাস্তি হওয়া উচিত ছিল। ডাকসুর ভিপি সাদিক কায়েম রায় ঘোষণার সময় ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন। তিনি চৌধুরী মামুনের ৫ বছরের শাস্তির বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, তাকে (মামুন) ন্যায্য বিচারের আওতায় আনা হোক। তিনি আইজিপি থাকার সময়ে পুলিশের মাধ্যমে যত গুম-খুন হয়েছে সব অপরাধের দায় তাকেও নিতে হবে।
দেশের বিশিষ্ট আইনজীবী আবু হেনা রাজ্জাকী যুগান্তরকে বলেন, ১৪০০ হত্যার জন্য চৌধুরী মামুনের অন্তত যাবজ্জীবন শাস্তি হতে পারত। সে (চৌধুরী মামুন) তো ১৭ মাস জেল খেটে ফেলেছেন। জেলের নিয়ম অনুসারে আর বাকি আছে ২৮ মাস। এরপর তার পাঁচ বছরের সাজা ভোগ শেষ হয়ে যাবে। এটা কোনো কথা হলো। এমন যদি ঘটে বসে যে, জিয়াউল আহসান এসে বলল সে রাজসাক্ষী হবে, তারও কি একই সাজা হবে-প্রশ্ন তোলেন তিনি।
এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম বলেন, সাবেক আইজিপি চৌধুরী মামুন এ মামলায় আসামিদের অপরাধ প্রমাণে রাজসাক্ষী হয়েছেন। সেই বিবেচনায় তার সাজা হয়েছে।
প্রথমদিকে এ মামলায় চৌধুরী মামুন আসামি ছিলেন না। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেই জুলাই হত্যা ঘটনায় নির্দেশদাতা হিসাবে অভিযোগ আনা হয়। তবে প্রসিকিউশন চলতি বছরের ১৬ মার্চ শেখ হাসিনার পাশাপাশি এ মামলায় সাবেক আইজিপি চৌধুরী মামুনকে আসামি করার আবেদন করে। পরে ট্রাইব্যুনাল তা মঞ্জুর করেন। এ মামলায় তাকে শ্যোন অ্যারেস্ট দেখিয়ে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। তিনি জুলাই হত্যার অন্য অসংখ্য মামলায় আসামি। শেখ হাসিনার সঙ্গে একই মামলায় আসামি হওয়ার পর তিনি মামলায় অভিযোগ গঠনের দিন গত ১০ জুলাই আন্দোলনের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার দায় স্বীকার করে ‘অ্যাপ্রুভার’ বা রাজসাক্ষী হওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করে আবেদন করেন। পরে তা গৃহীত হয় এবং জুলাই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িতদের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেন। মামলার যুক্তিতর্ক শুনানি চলাকালীন চিফ প্রসিকিউটর জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় ভারতে পলাতক শেখ হাসিনা ও কামালের মৃত্যুদণ্ড চান। অপরদিকে রাজসাক্ষী সাবেক আইজিপি চৌধুরী মামুনের খালাস চেয়ে আবেদন করেন তার আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ।
সোমবার দুপুর ১২টা ৪০ মিনিটের দিকে ৪৫৩ পৃষ্ঠার রায়ের প্রথম অংশ পড়েন বিচারিক প্যানেলের সদস্য বিচারপতি মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। ২ ঘণ্টা ১০ মিনিটের সংক্ষিপ্ত রায় পড়া শেষে দুপুর ২টা ৫০ মিনিটে এ রায় ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনাল। রায়ে শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়েছে। রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে সকালে কারাগারে থাকা মামলার একমাত্র আসামি চৌধুরী আব্দু্ল্লাহ আল-মামুনকে ট্রাইব্যুনালে আনা হয়। পরে তাকে রাখা হয় হাজতখানায়। রায় ঘোষণার সময় অনেকটা আধ ঘুমে, ঝিমিয়ে থেকে এবং আসামির ডকে বসেই সামনে থাকা টিভি স্ক্রিনে চোখ রেখে সময় পার করেছেন তিনি। নিজের সাজার রায় শোনার পরও তিনি নিশ্চুপ ছিলেন। রায়ের পরপরই তাকে পুলিশ প্রহরায় পুনরায় ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় নিয়ে যাওয়া হয়। পুরোটা সময় তিনি কারও সঙ্গে কোনো কথা বলেননি। রায়ের পর সাংবাদিকরা দূর থেকে তার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলেও তিনি নিশ্চুপ ছিলেন। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ রায় ঘোষণা করেন।