বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে শাসকদের মৃত্যুদণ্ডের রায় খুব বেশি নয়, তবে প্রতিটি ঘটনাই ছিল তুমুল আলোচিত ও ক্ষমতার লড়াইয়ের গুরুত্বপূর্ণ দলিল। ইউরোপ থেকে এশিয়া, বিভিন্ন দেশে ক্ষমতায় থাকা বা ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকা বহু শাসক আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছেন, আর অনেকেই সেই বিচারে পেয়েছেন সর্বোচ্চ শাস্তি— মৃত্যুদণ্ড।
সোমবার (১৭ নভেম্বর) বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ রায় দিয়েছেন আদালত। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে গণ অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় ক্ষমতাচ্যুত ও ভারতে পলাতক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। একই সঙ্গে আসামি থেকে দায় স্বীকার করে ‘রাজসাক্ষী’ হওয়া পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে পাঁচ বছর কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
হাসিনার আগে কোন কোন শাসক এমন দণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন? প্রশ্নের উত্তরে প্রথমেই আসে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো ও ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের নাম। তবে ঐতিহাসিক রায় নিয়ে যেহেতু এ প্রতিবেদন, তাই ১৮৬৭ সালের একটি রায় দিয়েই শুরু করা যাক।
মেক্সিকোর সম্রাট ম্যাক্সিমিলিয়ানের মৃত্যুদণ্ড
১৮৬৭ সালে মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হয়েছিলেন মেক্সিকোর সম্রাট ম্যাক্সিমিলিয়ান। অস্ট্রিয়ার আর্চডিউক হিসেবে জন্ম নেওয়া ম্যাক্সিমিলিয়ান ১৮৬৪ সালে দ্বিতীয় মেক্সিকান সাম্রাজ্যের সম্রাট হন। তার ক্ষমতার শুরু থেকেই অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল। তার সাম্রাজ্যকে যুক্তরাষ্ট্র কখনই স্বীকৃতি দেয়নি। বরং মেক্সিকোর আরেক নেতা বেনিতো হুয়ারেজকে সমর্থন দেয়।
ম্যাক্সিমিলিয়ানকে সমর্থন দিয়েছিল ফ্রান্স। কিন্তু দ্রুতই তিনি সমর্থন হারান এবং ব্যাপক বিপর্যয়ের মুখে পড়েন। পরে মেক্সিকান বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন সম্রাট ম্যাক্সিমিলিয়ান। তার বিচার হয় সামরিক আদালতে। প্রজাতন্ত্র উৎখাতের প্রচেষ্টার অভিযোগে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ১৯ জুন ১৮৬৭ সালে ফায়ারিং স্কোয়াডে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়।
নরওয়ের রাজনীতিবিদ ভিডকুন কুইসলিংয়ের বিচার
নরওয়ের রাজনীতিবিদ ভিডকুন কুইসলিং ইতিহাসে ‘বিশ্বাসঘাতক’ শব্দটির প্রতিশব্দ হয়ে আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি নাৎসি জার্মানির দখলদার বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করে একটি পুতুল সরকার গঠন করেন। যুদ্ধ শেষে তাকে গ্রেপ্তার করে রাষ্ট্রদ্রোহ, হত্যা ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে বিচার করা হয়। ১৯৪৫ সালে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার মধ্য দিয়ে কুইসলিংয়ের অধ্যায় শেষ হয়।
ফায়ারিং স্কোয়াডে হত্যা কর হয় গিনির প্রেসিডেন্ট ন্গুয়েমাকে
ইকুয়েটোরিয়াল গিনির প্রেসিডেন্ট ফ্রান্সিসকো মাচিয়াস ন্গুয়েমা সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন ১৯৭৯ সালে। পরে সামরিক ট্রাইব্যুনাল তাকে প্রতীকীভাবে ‘১০১ বার’ মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে এবং ২৯ সেপ্টেম্বর ফায়ারিং স্কোয়াডে তাকে হত্যা করা হয়।
আলোচিত ছিল জুলফিকার আলী ভুট্টোর দণ্ডও
দক্ষিণ এশিয়ায় আলোচিত মৃত্যুদণ্ডগুলোর মধ্যে অন্যতম পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর ঘটনা। ১৯৭৭ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বিতর্কিত নির্বাচনী কারচুপির প্রেক্ষাপটে জেনারেল জিয়া-উল-হকের নেতৃত্বে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করলে পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) নেতা ভুট্টোকে গ্রেপ্তার করা হয়। অভিযোগ ওঠে, তিনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আহমদ রেজা কাসুরীর বাবাকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ভুট্টো অভিযোগ অস্বীকার করলেও আন্তর্জাতিক মহল বিচার প্রক্রিয়াকে পক্ষপাতদুষ্ট ও ত্রুটিপূর্ণ বলে সমালোচনা করে। পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট ৪–৩ ভোটে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে এবং ১৯৭৯ সালের ৪ এপ্রিল তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়। পরবর্তীতে এই বিচারকে বহু বিশ্লেষক ‘বিচারিক হত্যা’ বলে উল্লেখ করেন।
জনআক্রোশ, দমনপীড়ন ও অর্থনৈতিক সংকট তৈরিতে দোষী হন নিকোলায় চউশেস্কু
ইউরোপের আরেক অধ্যায় রচিত হয় রোমানিয়ায়। ১৯৬৫ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকা কমিউনিস্ট নেতা নিকোলায় চউশেস্কু দীর্ঘদিন ধরে জনআক্রোশ, দমনপীড়ন ও অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করেন। ১৯৮৯ সালে ব্যাপক গণবিক্ষোভ ও পূর্ব ইউরোপের বিপ্লবের ঢেউ একসময় তাকে পতনের মুখে ঠেলে দেয়। পালাতে গিয়ে ধরা পড়ার পর চউশেস্কু ও তার স্ত্রী এলেনা চউশেস্কুকে অতি স্বল্প সময়ের সামরিক বিচারে ‘গণহত্যা’, ক্ষমতার অপব্যবহার ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ২৫ ডিসেম্বর ১৯৮৯ সালে একইদিনে তাদের ফায়ারিং স্কোয়াডে হত্যা করা হয়। বিচারহীনতা এবং দ্রুততার কারণে এই রায় আজও বিতর্কিত।
১৯৯৮ সালে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় ফ্রোদোয়াল্ড কারামিরার
আফ্রিকার রোয়ান্ডায় ১৯৯৪ সালের গণহত্যায় ভূমিকার অভিযোগে চরমপন্থী ‘হুতু পাওয়ার’ রাজনীতিবিদ ফ্রোদোয়াল্ড কারামিরাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। ১৯৯৮ সালে তাকে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
১৪৮ মানুষ হত্যার দায়ে ফাঁসি হয় সাদ্দামের
ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন ১৯৭৯ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত দেশটি শাসন করেন। তার নেতৃত্বে ইরাক ছিল কঠোর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণে থাকা বাথ পার্টির শাসনে। শাসনামলজুড়ে ইরান–ইরাক যুদ্ধ, উপসাগরীয় যুদ্ধ, ভিন্নমত দমন এবং ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ইরাককে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিতর্কের কেন্দ্রে রাখে। রাজধানী বাগদাদের পতনের পর তিনি কিছুদিন আত্মগোপনে ছিলেন। পরে তাকে তিকরিতের কাছে একটি ছোট ঘাঁটিতে গ্রেপ্তার করে মার্কিনবাহিনী।
গ্রেপ্তারের পর তাকে হাজির করা হয় বিশেষভাবে গঠিত ইরাকি স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে। ২০০৬ সালে আদালত তাকে ১৯৮২ সালে দুজাইল এলাকায় ১৪৮ গ্রামবাসী হত্যাকাণ্ডের দায়ে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধে’ দোষী সাব্যস্ত করে। আদালত মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করলে একই বছরের ৩০ ডিসেম্বর ভোরে বাগদাদের একটি গোপন স্থানে তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়। আন্তর্জাতিক মহলের বড় অংশ বিচার প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক প্রভাবাধীন বলে সমালোচনা করে। বহু মানবাধিকার সংস্থা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক এই বিচারকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ এবং ‘ক্যাঙ্গারু কোর্টের রায়’ বলে উল্লেখ করে। তাদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনের ছায়া পুরো বিচার প্রক্রিয়ায় স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল এবং ন্যায়বিচারের মানদণ্ড নিয়ে গভীর প্রশ্ন থেকে যায়।
মুরসির মৃত্যু
২০১২ সালে আরব বসন্তের পর ক্ষমতায় আসেন মোহামেদ মুরসি। তিনি মিসরের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তবে এক বছরের মাথায়, ২০১৩ সালের জুলাইয়ে তীব্র রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে সেনাবাহিনী তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে। পরে তাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তার বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি, সহিংসতায় উসকানি, এমনকি ২০১১ সালের কুখ্যাত কারাগার ভাঙার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়। ২০১৫ সালে এক মিসরীয় আদালত কারাগার ভাঙা মামলায় মুরসিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। রায়টি মানবাধিকার সংস্থা, পশ্চিমা দেশসমূহ এবং আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞদের কাছে “রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত” বলে বিবেচিত হয়।
তবে ২০১৬ সালের নভেম্বরে—মিসরের সর্বোচ্চ আপিল কোর্ট কোর্ট অব কাসেশন সেই মৃত্যুদণ্ড বাতিল করে এবং মামলাটি পুনর্বিচারের নির্দেশ দেয়। কিন্তু বন্দিদশায় থেকে মুরসি একের পর এক মামলা লড়ছিলেন। ২০১৯ সালের ১৭ জুন আদালত কক্ষে বিবৃতি দেওয়ার সময় আচমকা জ্ঞান হারানি তিনি। হাসপাতালে নেওয়ার আগেই তার মৃত্যু হয়। সরকারি বিবরণে এটি ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ হিসেবে উল্লেখিত হলেও আন্তর্জাতিক মহলে এটি নিয়ে বেশ সমালোচনার জন্ম দেয়।
‘রেড টেরর’ অভিযানের দায়ে মৃত্যুদণ্ড হয় মেনগিস্তু হায়েলে মারিয়ামের
মেনগিস্তু হাইলে মারিয়াম ইথিওপিয়ার দার্গ সামরিক জান্তার প্রধান এবং ১৯৭৭ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত দেশটি শাসন করেন। তার শাসনামল ছিল কঠোর মার্কসবাদ-লেনিনবাদী নীতি, রাজনৈতিক দমন-পীড়ন, জোরপূর্বক পুনর্বাসন এবং কুখ্যাত ‘রেড টেরর’র কারণে বিশ্বজুড়ে সমালোচিত। হাজার হাজার রাজনৈতিক বিরোধী, ছাত্র, বুদ্ধিজীবী এবং সম্ভাব্য প্রতিপক্ষ এই সময় নিখোঁজ হন বা নিহত হন।
১৯৯১ সালে দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের মুখে তার সরকার পতন হলে মেনগিস্তু পালিয়ে আশ্রয় নেন জিম্বাবুয়েতে। প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবে তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেন এবং তখন থেকেই তিনি সেখানেই রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার সুরক্ষায় বসবাস করছেন। ২০০৬ সালের ডিসেম্বর, ইথিওপিয়ার একটি আদালত অনুপস্থিত অবস্থায় মেনগিস্তুকে গণহত্যা এবং রেড টেরর অভিযানের সময় সংঘটিত একাধিক মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে। আদালত তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। কিন্তু ২০০৮ সালের মে মাসে ইথিওপিয়ার সুপ্রিম কোর্ট রায়টি আরও কঠোর করে—জেল থেকে মৃত্যুদণ্ডে রূপান্তর করে।
মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে কঙ্গোর সাবেক প্রেসিডেন্ট জোসেফ কাবিলাকেও
জোসেফ কাবিলা ছিলেন ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোর সাবেক প্রেসিডেন্ট। ক্ষমতা হারানোর পর তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ, যুদ্ধাপরাধ এবং বিদ্রোহ উসকে দেওয়ার অভিযোগে সামরিক আদালতে বিচার শুরু হয়।
২০২৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর, কঙ্গোর একটি সামরিক আদালত তাকে অনুপস্থিত অবস্থায় মৃত্যুদণ্ড দেয়। আদালতের অভিযোগ অনুযায়ী, কালিবা বিদ্রোহী গোষ্ঠী এম-টোয়েন্টিথ্রি এবং তার রাজনৈতিক শাখা কংগো রিভার অ্যালায়েন্সের (এএফসি) সঙ্গে যোগসাজশে একটি সশস্ত্র বিদ্রোহ সংগঠিত করেন, যার উদ্দেশ্য ছিল সরকার উৎখাত এবং দেশজুড়ে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করা।
রায়ে বলা হয়, কালিবার পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় সশস্ত্র সংঘর্ষ তীব্রতর হয়, সাধারণ মানুষ নিহত হয়, এবং রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে সমন্বিত হামলা পরিচালিত হয়। এইসব কর্মকাণ্ডকে আদালত রাষ্ট্রদ্রোহ ও যুদ্ধাপরাধের পর্যায়ে গণ্য করে। রায় ঘোষণার সময় কালিবা তার দেশে অনুপস্থিত ছিলেন। আন্তর্জাতিক মহলে এই রায় নিয়ে ইতিমধ্যে নানামুখী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে— কেউ একে ন্যায়বিচারের অগ্রগতি হিসেবে দেখছেন, আবার কেউ এটিকে রাজনৈতিক প্রতিশোধের অংশ মনে করছেন।
সূত্র: ইন্টারনেট ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম