Image description

দেশের বহুল সমালোচিত বেক্সিমকো গ্রুপের কোম্পানি বেক্সটেক্স (বেক্সিমকো টেক্সটাইল) বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। এর মালিকানায় যুক্ত হচ্ছে-জাপানভিত্তিক প্রবাসীদের প্রতিষ্ঠান রিভাইভাল গ্রুপ এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রবাসীদের প্রতিষ্ঠান ইকোমিল্লি। প্রাথমিকভাবে তারা বেক্সিমকো টেক্সটাইল লিজ নিচ্ছে। বর্তমানে বন্ধ থাকা এই কোম্পানি চালু করতে দুই কোটি ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে; স্থানীয় মুদ্রায় যা ২৫০ কোটি টাকা। এতে ২৫ হাজার লোক কর্মসংস্থান ফিরে পাবে। উদ্যোগটি সফল হলে আরও কোম্পানি নেবে তারা। লিজ নেওয়ার বিষয়টি বেক্সিমকোর পক্ষ থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয়েছে। তবে তারা মালিকানা বদল বলতে রাজি নয়। উদ্যোগের সঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক জড়িত রয়েছে। ব্যাংকটিতে বেক্সিমকোর ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ। আর বেক্সিমকো টেক্সটাইলের নামে ঋণ রয়েছে ৮৬০ কোটি টাকা। এর পুরোটাই খেলাপি। ব্যাংক সূত্র বলছে, সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে তারা (জনতা ব্যাংক) রাজি হয়েছে।

বেক্সিমকোর মালিক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি খাত ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বর্তমানে জেলে রয়েছেন। তবে বিষয়টি সম্পর্কে তিনি (সালমান এফ রহমান) অবগত বলে বেক্সিমকোর একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। গত বছরের ৫ আগস্টের পর গ্রুপটির তিন কোম্পানিতে প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছিল সরকার। তবে চলতি বছরের ১২ মার্চ উচ্চ আদালত তা বাতিল করে।

জানতে চাইলে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘এখানে আমাদের অনুমোদন বা নির্দেশের কোনো বিষয় নেই। কোম্পানি বেচাকেনার মধ্যে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কোনো বিষয় নেই। আমরা শুধু মধ্যস্থতা করে দিয়েছি। সম্ভবত একটি মিটিং হয়েছিল। এখন বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) দেখছে।’ তিনি বলেন, ‘কোম্পানি বেচাকেনায়- ক্রেতা, বিক্রেতা ও ব্যাংক জড়িত। মন্ত্রণালয়ের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।’ তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডার ঊর্ধ্বতন সূত্র যুগান্তরকে জানায়, ‘এই বিক্রির সঙ্গে আমরা সম্পৃক্ত নই। যেহেতু এখানে বিনিয়োগের কোনো বিষয় নেই, তাই এই প্রক্রিয়ায় বিডা জড়িত নয়। এটি ব্যাংক ও কোম্পানির ব্যাপার।’

জানা যায় রিভাইভাল প্রজেক্টস লিমিটেড, বেক্সিমকো ও জনতা ব্যাংকের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তির খসড়া গত ৮ অক্টোবর জমা দেওয়া হয়েছে। আগামীকাল মঙ্গলবার জনতা ব্যাংকের বোর্ড সভায় এর পর্যালোচনা হবে। চলতি মাসেই চুক্তি সইয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। রিভাইভাল ও ইকোমিল্লির শীর্ষ কর্মকর্তারা নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে ঢাকায় এসে আনুষ্ঠানিক স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। প্রথম ধাপে রিভাইভাল ও ইকোমিল্লি দুই কোটি ডলার ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি সহায়তা দেবে। প্রয়োজনে তা ১০ কোটি ডলার পর্যন্ত বাড়ানো হবে। কোম্পানিটি আশা করছে, ২০২৭ সালের মধ্যে বছরে ৫০০ কোটি টাকা মুনাফা অর্জন করতে পারবে, যা বকেয়া ঋণ পরিশোধ এবং শিল্পটির দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে। জানতে চাইলে জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান এম ফজলুর রহমান রোববার যুগান্তরকে বলেন, ‘চুক্তির আগে এ নিয়ে আগাম কোনো মন্তব্য করব না।’

এদিকে রিভাইভাল প্রজেক্টস লিমিটেড একটি অখ্যাত প্রতিষ্ঠান। এর সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক দলের সম্পর্ক রয়েছে। রিভাইভালের দাবি দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা বেক্সিমকো টেক্সটাইল ডিভিশন লিজ নিয়ে তারা পুনরায় চালু করবে। চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে উৎপাদন শুরু হবে। প্রথম ধাপে রিভাইভাল ও ইকোমিল্লি দুই কোটি ডলার ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি সহায়তা দেবে। প্রয়োজনে তা ১০ কোটি ডলার পর্যন্ত বাড়ানো হবে। এতে ২৫ হাজারের বেশি শ্রমিক আবার কাজে ফিরতে পারবেন। রিভাইভাল আশা করছে, ২০২৭ সালের মধ্যে বছরে ৫০০ কোটি টাকা মুনাফা অর্জন করতে পারবে, যা বকেয়া ঋণ পরিশোধ এবং শিল্পটির দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে। তারা বেক্সিমকোর আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের সঙ্গে আবার সংযোগ স্থাপন করতে চায়। নতুন বৈশ্বিক অংশীদারও যুক্ত করার আশা।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, রিভাইভালের দর্শন ‘স্থানীয় ডিজাইন, বৈশ্বিক বাজার’ (লোকালি ডিজাইন, সেল গ্লোবালি)- বাংলাদেশি পণ্যে নতুন উচ্চমান যুক্ত করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করছে। এ লক্ষ্যে রিভাইভাল দেশে উন্নতমানের প্রশিক্ষণ, আন্তর্জাতিক সার্টিফিকেট কোর্স এবং তরুণ ডিজাইনারদের জন্য প্রথমবারের মতো একটি পূর্ণাঙ্গ ডিজাইন ইনস্টিটিউট স্থাপনের পরিকল্পনা করছে। জাপান, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিশেষজ্ঞরা সেখানে পাঠদান করবেন; যা ভবিষ্যতের সৃজনশীল শিল্পে নতুন নেতৃত্ব তৈরি করবে।

রিভাইভালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হুদা মোহাম্মদ ফয়সাল বলেন, ‘এটি শুধু কারখানা চালু করা নয়, হাজারো পরিবারের মর্যাদা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ। ফিরে আসা প্রতিটি চাকরি নতুন করে আস্থা এবং আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলবে।’ ইকোমিল্লির প্রেসিডেন্ট ড. ফারহান এস করিম বলেন, ‘একজন প্রবাসী বাংলাদেশি হিসাবে দেশের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা পুনরায় চালু করতে সহায়তা করতে পেরে আমি গর্বিত। এটি ব্রেইন ড্রেইনের গল্প নয়, এটি ব্রেইন গেইনের গল্প। আমরা একসঙ্গে মানুষের জীবিকা ফেরানোর পাশাপাশি দেশের শিল্প খাতকে নতুন প্রাণ দিতে চাই।’

বেক্সিমকো লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওসমান কায়সার চৌধুরী বলেন, ‘সরকারের নির্দেশে বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত আমাদের টেক্সটাইল বিভাগ সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ চালিয়ে গেছে। ৪২ হাজার কর্মী ও কর্মকর্তার চাকরি রক্ষা করা এবং প্রতি মাসে প্রায় চার কোটি ডলারের রফতানি ধরে রাখা ছিল আমাদের প্রধান দায়িত্ব। আর্থিক সংকটের মধ্যেও আমরা অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিগুলো সচল রেখেছি, যাতে যেকোনো মুহূর্তে কারখানা চালু করা যায়। রিভাইভালের উদ্যোগে সেটি এখন সম্ভব হচ্ছে।’

দেশের আর্থিক খাতে অভিশপ্ত নাম সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপ। ঋণখেলাপি, জমি জালিয়াতি, অর্থ পাচার, শেয়ারবাজার কেলেংকারি বললেই তার নাম সবার আগে। তার হাত ধরেই দেশের ঋণখেলাপির সংস্কৃতির বিকাশ হয়। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত তার ২৮ প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জনতা ব্যাংকে বেক্সিমকো টেক্সটাইলের রয়েছে ৮৬০ কোটি টাকা। সরকার পতনের আগে ৩ বছরে শেয়ারবাজার থেকে দৃশ্যমান ৬ হাজার ৬০০ কোটি টাকা নিয়েছেন তিনি। এর মধ্যে বেক্সিমকো সুকুক বন্ড ৩ হাজার কোটি, আইএফআইসি আমার বন্ড ১ হাজার কোটি এবং বেক্সিমকো জিরো কুপন বন্ড ছেড়ে ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা নিয়েছেন। তবে অদৃশ্য ও বেনামি মিলিয়ে ৩ বছরেই ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এদিকে সুকুক বন্ড কেনার জন্য বিভিন্ন ব্যাংককে বাধ্য করা হয়। বেক্সিমকোর শেয়ারে কারসাজির দায়ে গত বছরের ১ অক্টোবর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ৪২৮ কোটি টাকা জরিমানা করে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কারণে ৫ আগস্ট বিদেশে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে দেশেই পালিয়ে ছিলেন তার বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। সরকার পতনের কয়েক দিনের মধ্যেই নারায়ণগঞ্জে কোস্ট গার্ডের হাতে গ্রেফতার হন তিনি।