Image description

বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ম্যানেজিং বোর্ড পুনর্গঠনকে কেন্দ্র করে সংগঠনটির ভেতরে ও বাইরে ব্যাপক আলোচনা চলছে। বিভিন্ন সূত্রের অভিযোগ, বর্তমান বোর্ডের মেয়াদ বহাল থাকা অবস্থায় হঠাৎ করে নতুন বোর্ড গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, যা প্রতিষ্ঠানটির অভ্যন্তরীণ স্বচ্ছতা ও নীতিমালার সাথে সাংঘর্ষিক। প্রস্তাবিত কিছু নাম নিয়ে সংগঠনের সদস্য, স্বেচ্ছাসেবী এবং আজীবন সদস্যদের একটি অংশ উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কারণ, তাদের মতে, কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে পূর্বের অনিয়ম, রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা কিংবা স্বজনপ্রীতির গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। এমনকি এই নতুন বোর্ড গঠনের প্রক্রিয়ায় বড় অংকের আর্থিক লেনদেনেরও অভিযোগ উঠেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, অতীতে বোর্ড থেকে পদত্যাগ করা কয়েকজন সাবেক সদস্যকেও পুনরায় অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা চলছে। সংগঠনের অধিকাংশ সদস্যই মনে করছেন, বোর্ডে পদত্যাগকারী বা বিতর্কিত ব্যক্তিদের ফের যুক্ত করা হলে প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তি প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে।

সূত্রমতে, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির বর্তমান ম্যানেজিং বোর্ডের মেয়াদ থাকার পরেও অন্যায় ও সম্পূর্ণ অবৈধভাবে বোর্ড ভেঙে দিয়ে দুর্নীতি এবং অর্থের বিনিময়ে শেখ হাসিনা ঘনিষ্ঠ আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের নেতৃত্বে নতুন বোর্ড গঠনের চক্রান্ত চলছে। খোদ স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমের ইচ্ছায়ই এই অবৈধ কর্মটি হচ্ছে। উপদেষ্টার এক বান্ধবীও এরসঙ্গে জড়িত রয়েছেন, যিনি ইতিপূর্বে এই পরিচালনা বোর্ডে ছিলেন এবং বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জের হিসেবে এক পর্যায়ে পদত্যাগ করেছেন। সূত্রের দাবি, ফ্যাসিস্টদের সমন্বয়ে বোর্ড গঠনের প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে অনেকটা এগিয়ে গেছে এবং এ বাবদ বড় অংকের অর্থের লেনদেনও হয়ে গেছে।

নির্ভরযোগসূত্রে জানা গেছে, নতুন ম্যানেজিং বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে যার নাম প্রস্তাব করা হয়েছে তিনি হলেন ডা. হালিদা হানুম আখতার, যিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠজন এবং ফ্যাসিস্ট আওয়ামী আমলে সরকারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ থেকে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন। হালিদা হানুম আখতার বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির বিগত বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান তাসনিম আজিমের বান্ধবী। হালিদা হানুমের আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনা সংশ্লিষ্টতার বেশকিছু ছবি শীর্ষনিউজ ও শীর্ষকাগজ কর্তৃপক্ষের হাতে এসেছে। একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে তিনি ২০২৩ সালে তৎকালীন ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে পুরস্কার নিচ্ছেন। আরেকটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, “বঙ্গবন্ধুর স্বাস্থ্য কথন” বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তৃতা দিচ্ছেন ডা. হালিদা হানুম আখতার। শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট আমলের যখন চূড়ান্ত সময়, ২০২৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি এই অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়। বইটির লেখক ছিলেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. আ ফ ম রুহুল হক। এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন। অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে বেশ কিছুক্ষণ ধরে ফটোসেশন হয়। চিহ্নিত ফ্যাসিস্ট এবং ফ্যাসিস্টদের দোসররাই ওই ফটোসেশনে অংশ নেন। ফ্যাসিস্টদের সঙ্গে এসব ফটোসেশনে বেশ হাসিখুশি দেখা গেছে এই ডা. হালিদা হানুম আখতারকে। অথচ তাকেই এই অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে রেড ক্রিসেন্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার চেয়ারম্যান করার চক্রান্ত চলছে। হালিদা হানুম আখতার আওয়ামী ঘনিষ্ঠ একাধিক এনজিও’র সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রয়েছেন বলেও জানা গেছে।

সম্ভাব্য এই পরিচালনা বোর্ডে একই ঘরানার আরো একজনের নাম শোনা যাচ্ছে, তিনি হলেন আরেফিন অমল। উনিও একজন এনজিও কর্মী, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিভিন্ন কার্যক্রমে তাকে আওয়ামী সরকারের গুণকীর্তন করতে দেখা গেছে। বিভিন্নজনের কাছে এ রকমের বেশ কিছু ছবি এবং ভিডিও সংরক্ষিত রয়েছে, যেসব ঘটনা প্রমাণিত হয় আরেফিন অমল মূলতঃ ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের একজন অ্যাক্টিভিস্ট ছিলেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই দুই ফ্যাসিস্ট হালিদা হানুম এবং আরেফিন অমলকে সোসাইটির বোর্ডে নেয়া হলে প্রতিষ্ঠানটির আজীবন সদস্য এবং যুব সদস্যরা তীব্র আন্দোলন এবং প্রতিবাদ বিক্ষোভে ফেটে পড়বেন, আর এর দায় দায়িত্ব স্বাস্থ্য উপদেষ্টাকে নিতে হবে। এবারে আসা যাক অন্য প্রস্তাবিত তিনজনের বিষয়ে, যারা ইতোমধ্যেই নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জের হিসেবে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ম্যানেজিং বোর্ড থেকে পদত্যাগ করেছেন। নিয়ম অনুযায়ী, পদত্যাগকারী ব্যক্তিদের আবারও বোর্ডে দেয়া সম্পূর্ণ অন্যায় এবং অবৈধ। আওয়ামী আমলের মতো নতুনভাবে দুর্নীতি-লুটপাট শুরু করার জন্যই তাদেরকে আবারও অর্থের বিনিময়ে বোর্ডে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। এদের সম্পর্কে অতীতে দুর্নীতির অনেক অভিযোগ রয়েছে এবং এ বিষয়ে গণমাধ্যমে খবরও প্রকাশিত হয়েছে।

এদের একজন হলেন সাবেক ট্রেজারার আমিনুল ইসলাম। তিনি ইতিপূর্বে অত্যন্ত দুর্নীতিবাজ, অর্থলোভী, কুচক্রী কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। আওয়ামী লীগের প্রাক্তন মেয়র কামরানের বিশ্বস্ত এবং সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম নাদেলের পরিচয়ে চলতেন। এছাড়াও আওয়ামী লীগের অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তির সঙ্গে তার সখ্যতা, উঠাবসা ও কাজ-কারবার ছিল। এমন বেশকিছু ভিডিও এবং ছবি সংরক্ষিত আছে বিভিন্নজনের কাছে। এই দুর্নীতিবাজ আমিনুল ইসলাম সিলেট মাতৃসদন হাসপাতালে দুর্নীতি করার অপরাধে পরিচালনা পর্ষদের কমিটি থেকে বাদ পড়েছেন। সম্প্রতি এ ব্যাপারে দুদক তদন্ত করছে এবং জানা যাচ্ছে, দুর্নীতির মামলায় তাকে শীঘ্রই গ্রেফতার করা হতে পারে।

সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান তাসনিম আজিমের নামও প্রস্তাবিত বোর্ডে রয়েছে, যিনি বর্তমান স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী এবং অধিকাংশ সময়ই দেশের বাইরে থাকেন। রেড ক্রিসেন্টের সদস্যরা বলছেন, বাস্তবে দেশের সাথে কোন সংযোগ নেই তাসনিম আজিমের। রেড ক্রিসেন্টের ইতিবাচক কাজকর্মের ব্যাপারে তিনি মোটেই আগ্রহী নন। তবে দুর্নীতি-লুটপাটের বিষয়গুলোতে অতি আগ্রহ রয়েছে। এখানকার অর্থ হাতিয়ে নিয়ে বিদেশে পাচার করার কাজে পারদর্শী। ইতিপূর্বে ভাইস চেয়ারম্যান পদে থাকাকালে তা-ই দেখা গেছে। তিনিই মূলতঃ নতুন এই অবৈধ কমিটি ঘঠনের বিষয়ে উপদেষ্টার সঙ্গে যোগাযোগ এবং বোঝাপড়ার কাজগুলো সম্পন্ন করছেন। রেড ক্রিসেন্ট সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই বিতর্কিত ব্যক্তিকে জোরপূর্বক বান্ধবী পরিচয় বোর্ডে আনা হলে প্রতিবাদের আগুন জ্বলবে। রেড ক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবী এবং আজীবন সদস্যরা সারাদেশে আন্দোলন ও বিক্ষোভ করার আশংকা রয়েছে।

আরেকজন, যার নাম শোনা যাচ্ছে তিনি হলেন তানিম আহমেদ শাওন। বয়সের বিচারে অত্যন্ত অপরিপক্ক, স্বাস্থ্য উপদেষ্টার ব্যক্তিগত মামলার ফাইল বহনের পুরস্কারস্বরূপ অন্যায়ভাবে তাকে বোর্ড মেম্বার করা হয়েছিল ইতিপূর্বে। তবে বয়সের বিচারে অপরিপক্ক হলেও দুর্নীতিতে তিনি অত্যন্ত পরিপক্ষ এবং বেপরোয়া, যা ইতিমধ্যেই পরিচালক পদে থাকাকালে প্রমাণ দিয়েছেন। এমনকি তিনি জালিয়াত হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছেন। এই দুর্নীতিবাজ, অপরিপক্ক এবং জালিয়াত তানিম আহমেদ রেড ক্রিসেন্টে থাকা অবস্থায় এ ধরনের নানা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এই দুর্নীতিবাজ তানিমকে পুনরায় বোর্ডে আনার চেষ্টা করা হলে তার সাথে বর্তমান স্বাস্থ্য উপদেষ্টার কি ধরনের সম্পর্ক রয়েছে সে বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের ছবিগুলো সবার সামনে চলে আসবে বলে সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন।

এসব কারণে রেড ক্রিসেন্টের সদস্যরা সতর্ক করে বলেছেন, বোর্ড পুনর্গঠনের প্রয়োজন হলে তা অবশ্যই স্বচ্ছ ও নীতিনিষ্ঠ হতে হবে; অন্যথায় তারা আন্দোলন, বিক্ষোভ ও সংবাদ সম্মেলনসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে যেতে বাধ্য হবেন। তাদের মতে, রেড ক্রিসেন্টের মতো মানবিক সংস্থায় বোর্ড গঠনের ক্ষেত্রে ব্যক্তিস্বার্থের পরিবর্তে যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও নিরপেক্ষতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া উচিত। দেশ ও জাতির স্বার্থে এ ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা, হীন চক্রান্ত এবং দুর্নীতি থেকে গুরুত্বপূর্ণ এ সংস্থাটিকে দূরে রাখার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।

শীর্ষনিউজ