Image description
রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক

গণ-অভ্যুত্থানের পর প্রশাসন ও পুলিশের মতো দীর্ঘদিন পদোন্নতিবঞ্চিত ৭ হাজারের বেশি কর্মকর্তাকে সুপারনিউমারারি পদোন্নতি দিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক সোনালী, রূপালী, জনতা ও অগ্রণী। অভিযোগ রয়েছে, এসব ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) একপ্রকার জিম্মি করে সুপারনিউমারারি পদে পদোন্নতির অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। একই ঘটনা ঘটেছে বেসরকারি খাতের কয়েকটি ব্যাংকেও। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংকে গণহারে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এমন পদোন্নতিতে অনেক দক্ষ ও যোগ্য কর্মকর্তা পদোন্নতিবঞ্চিত হয়েছেন। এ নিয়ে ব্যাংকগুলোয় অসন্তোষ ও ক্ষোভ সৃষ্টি করছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, সুপারনিউমারারি পদে পদোন্নতির কারণে শুধু জনতা ব্যাংকেই বঞ্চিতের সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। আর সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে বঞ্চিতের সংখ্যা ৫ হাজারের বেশি। বঞ্চিত এসব ব্যাংকার সুপারনিউমারারি এবং অর্গানোগ্রাম মেধাভিত্তিক পদোন্নতি চলমান রাখার দাবি জানিয়েছেন। যদিও লজিস্টিক, গাড়ি সুবিধাসহ মর্যাদার প্রশ্নে সুপার ও মেধায় পদোন্নতি নিয়ে অন্তর্দ্বন্দ্ব এখন তুঙ্গে।

সোনালী, রূপালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকার বদলের পর বিভিন্ন ব্যাংকে বৈষম্যের অভিযোগ ওঠে। বৈষম্য রোধে একটি বড় অংশ সুপারনিউমারারি পদোন্নতির জন্য আন্দোলন করেন। ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এমডিকে অবরুদ্ধের ঘটনাও ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এই চার ব্যাংকে মেধা ও সুপারনিউমারারি পদোন্নতি দেওয়া হয়। তবে জনতা ব্যাংক একেবারে কমসংখ্যককে পদোন্নতি দিয়েছে বলে বঞ্চিতদের অভিযোগ।

অন্যদিকে ইসলামী ব্যাংকে প্রথমে মেসেজ পাঠিয়ে পদোন্নতি দেওয়া হয়। পরে তা বাতিল করে ‘নামকাওয়াস্তে’ সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে পদোন্নতি দেওয়া হয়। একইভাবে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংকসহ অন্য ডজনখানেক ব্যাংকে খেয়ালখুশিমতো পদোন্নতির ঘটনা ঘটেছে।

ব্যাংকগুলোর তথ্য বলছে, সম্প্রতি রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোয় দীর্ঘদিনের বৈষম্য ও জট দূরীকরণে সুপারনিউমারারি পদোন্নতি প্রদান করা হয়েছে। এসব ব্যাংকের মধ্যে সোনালী ব্যাংক ২ হাজার ২০০ জনকে, অগ্রণী ব্যাংক ৩ হাজার ৮৪ জনকে এবং রূপালী ব্যাংক ৩ হাজার ২০৯ জনকে পদোন্নতি দিয়েছে। জনতা ব্যাংক সুপারনিউমারারি পদোন্নতি দিয়েছে ৫৭৯ জনকে। মূলত উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম), সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম), সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার (এসপিও), প্রিন্সিপাল অফিসার (পিও) ও সিনিয়র অফিসার (এসও) পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়।

জনতা ব্যাংকের কয়েক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দীর্ঘদিনের পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তারা পুনরায় বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। এ নিয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশা ও চাপা ক্ষোভ রয়েছে। বৈষম্য দূরীকরণে সব ব্যাংকে মেধা ও সুপারনিউমারারি পদোন্নতি চলমান রাখতে হবে। নয়তো ব্যাংকের স্বাভাবিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হতে পারে।

এদিকে সুপারনিউমারারি পদে পদোন্নতি দিয়ে প্রচলিত বিধিবিধান লঙ্ঘন করায় রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের এমডিকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। এতে বলা হয়, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের বিধিবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের সাংগঠনিক কাঠামোর বাইরে সুপারনিউমারারি পদ সৃষ্টি করে পদোন্নতির সুযোগ নেই। কিন্তু প্রচলিত এ বিধিবিধানের ব্যত্যয় ঘটিয়ে পদ না থাকা সত্ত্বেও সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদনক্রমে সুপারনিউমারারি পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এটি প্রচলিত বিধিবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

এ বিষয়ে সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান মুসলিম চৌধুরী বলেন, ‘নিয়ম মেনে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। মূলত কর্মকর্তাদের বৈষম্য দূরীকরণ এবং পদোন্নতি বঞ্চিতদের দাবি পূরণে মেধা এবং সুপারনিউমারারি ভিত্তিতে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। নির্দিষ্ট দক্ষতা ও যোগ্যতা অনুযায়ী তা করা হয়েছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ কারণ দর্শনোর নোটিশ দিয়েছে। এর জবাব দেওয়া হবে। তবে নোটিশ একটা বিব্রতকর।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনতা ব্যাংকের এক পরিচালক বলেন, ‘জনতা ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা খুবই নাজুক। পরিস্থিতি উত্তরণের বিষয়ে আলোচনা না করে সবাই নিজের পদ-পদবির জন্য আন্দোলন করেন। তৎকালীন এমডিকে অবরুদ্ধ করা হয়।’

অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ বলেন, ‘বিগত সরকারের সময় পদোন্নতিবঞ্চিতদের পদোন্নতি দেওয়া হয়। কিন্তু পদোন্নতির একটি নিয়ম আছে। ঢালাও পদোন্নতি দিলে যাঁরা ভালো কাজ করেন, তাঁরা নিরুৎসাহিত হন। যে কারণে একটি নিয়ম মেনে পদোন্নতি দেওয়া হয়।’

সরকারি আরেক ব্যাংকের এমডি বলেন, ‘ব্যাংকগুলোয় বহুসংখ্যক কর্মকর্তাকে এসপিও থেকে এজিএম বানানো হয়েছে, যা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর নির্বাহী পদের প্রথম ধাপ। বেতন-ভাতা ও পদমর্যাদা বৃদ্ধির পাশাপাশি এজিএম হওয়া প্রত্যেক কর্মকর্তা ব্যক্তিগত গাড়ি কেনার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংক থেকে সুদমুক্ত ৩০ লাখ টাকা ঋণ পান। ক্রয়কৃত গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ প্রতি মাসে খরচ পান। এ ছাড়া এজিএমদের জন্য ব্যক্তিগত কক্ষও (রুম) বরাদ্দ থাকে। পদের অতিরিক্ত পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত কক্ষ ও চেয়ার-টেবিল দিতেই ব্যাংকগুলো এখন হিমশিম খাচ্ছে। মেধা ও সুপারনিউমারারি ভিত্তিতে পদোন্নতিপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে তুমুল অন্তর্দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার।’