স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ইতিমধ্যেই জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। ঢাকা-১০ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে এমপি নির্বাচন করবেন তিনি। গত ৯ নভেম্বর তিনি এ ঘোষণা দেন। এর আগে এক বক্তৃতায় তিনি বলেছেন, এমপি নির্বাচন করতে অন্ততঃ ১০ থেকে ২০ কোটি টাকা লাগবে। তবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, উপদেষ্টা সজীব ভূঁইয়া শুধুমাত্র একজন প্রকৌশলীর কাছ থেকেই হাতিয়ে নিয়েছেন অন্ততঃ ৬০ কোটি টাকা। মো. তবিবুর রহমান তালুকদার নামে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের এই প্রকৌশলীকে একসঙ্গে দুটি প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক পদে নিয়োগের বিনিময়ে আলাদা দুটি ঘটনায় ২০ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। সর্বশেষ এখন তাকে রুটিন দায়িত্বে প্রধান প্রকৌশলী পদে নিয়োগ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এ বাবদ তার কাছ থেকে এক দাগে ৪০ কোটি টাকা আদায় করা হয়েছে এবং এই পদে নিয়োগের প্রক্রিয়া এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে।
প্রকৌশলী মো. তবিবুর রহমান তালুকদার একজন শীর্ষ দুর্নীতিবাজ, ফ্যাসিস্ট এবং শেখ হাসিনা ঘনিষ্ঠ বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদের সদস্য হিসেবে চিহ্নিত। ২০২১ সাল থেকে তিনি স্থানীয় সরকার বিভাগের আওতাধীন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর (ডিপিএইচই)-এর ১ হাজার ৮৮৩ কোটি টাকার "মানবসম্পদ উন্নয়নে গ্রামীণ পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধি প্রকল্প"-এর প্রকল্প পরিচালক। বিশ^ব্যাংকের অর্থায়নের এই প্রকল্পে ব্যাপকহারে অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে বলে সরকারের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের মূল্যায়ন প্রতিবেদনেই উল্লেখ করা হয়েছে। এই প্রকল্পের দুর্নীতি নিয়ে দুদকও তদন্ত শুরু করেছে। যদিও প্রকল্প পরিচালক তবিবুর রহমান দুদকের তদন্ত কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে দুর্নীতি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন। তবিবুর রহমানের এই প্রকল্পে এত ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে যে, বেশির ভাগ কাজেই দরপত্রের স্পেসিফিকেশন মানা হয়নি, টেন্ডারে পিপিআর লঙ্ঘন করা হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় নির্মিত ৮০ ভাগ পাবলিক টয়লেট ইতোমধ্যেই অব্যবহৃত, পরিত্যক্ত। অভিযোগ আছে- ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজশে প্রকল্পের টাকা লোপাট করে দেশে-বিদেশে অঢেল সম্পদ গড়ে তুলেছেন প্রকল্পটির একচ্ছত্র অধিপতি প্রকল্প পরিচালক (পিডি) মো. তবিবুর রহমান তালুকদার। আর এই অর্থে কিনে নিয়েছেন উপদেষ্টা সজীব ভূঁইয়াকেও। একটি প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক থাকা অবস্থায় ‘গ্রামীণ স্যানিটেশন প্রকল্প’ নামে নতুন আরেকটি প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হয়েছেন নগদ ১৫ কোটি টাকায়। নতুন প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ১,৯৮৯ কোটি টাকা।
নিয়ম অনুযায়ী একসঙ্গে দুটি প্রকল্পের পরিচালক পদে থাকা সম্ভব নয়। তাই আগের “মানবসম্পদ উন্নয়নে গ্রামীণ পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধি প্রকল্প” এর জন্য নতুন পিডি নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করে মন্ত্রণালয়। প্রধান প্রকৌশলী মীর আব্দুর সাহিদকে মন্ত্রণালয়ের সচিব নির্দেশনা দিলে তিনি তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (চ.দা.) মো: ফিরোজ আলম চৌধুরীর নাম প্রস্তাব করে মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেন। কিন্তু হতবাক করার বিষয় হলো, আন্তঃমন্ত্রণালয় মিটিং হওয়ার পর নথি উপদেষ্টার বাসায় গেলে উপদেষ্টা তবিবুরকে ডেকে বলেন কি করব? তবিবুর বলেন, আমি প্রকল্প দিবো না, আপনার জন্য কি করতে হবে বলুন। তখন উপদেষ্টা বলেন, মাহফুজের (উপদেষ্টার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা, যিনি উপদেষ্টার পক্ষ থেকে মন্ত্রণালয়ের ভেতরকার আনঅফিসিয়াল লেনদেনের কাজগুলো করে থাকেন) সাথে কথা বলেন। এরপর ১০ দিন নথিটি আটকে থাকলো উপদেষ্টার দপ্তরে। ১০ দিন আটকে রাখার পর উপদেষ্টা সজীব ভূঁইয়া নথিতে 'আলোচনা করুন' লিখে শাখায় নথিটি পাঠিয়ে দিলেন।
নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে, ৫ কোটি টাকায় উপদেষ্টা সজীব ভূঁইয়া আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভার সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে নতুন পিডি নিয়োগের সিদ্ধান্ত আটকে দেন। আওয়ামী লীগ আমলে নেয়া ১,৮৮২ কোটি টাকা বরাদ্দের মানব সম্পদ উন্নয়নের বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট এই প্রকল্পের পিডি থাকাকালে তবিবুর রহমান শত শত কোটি টাকা লুটপাট করেছেন। এই পর্যায়ে এসে প্রকল্পটিতে নতুন পিডি নিয়োগ করা হলে তার ইতিপূর্বের দুর্নীতি-অপকর্মের সব তথ্য বের হয়ে আসবে। তাই তিনি প্রকল্পটি হাত ছাড়া করছেন না। একই কর্মকর্তার হাতে এখন ৩,৮৭১ কোটি টাকার দু’টি বিশাল প্রকল্পের দায়িত্ব। এই দুটি প্রকল্পের দায়িত্ব হাতে রাখতে গিয়ে প্রকৌশলী মো. তবিবুর রহমান তালুকদারকে দুই দাগে মোট ২০ কোটি টাকা খরচ করতে হয়েছে।
এখন আবার তিনি মাঠে নেমেছেন সংস্থাটির শীর্ষ পদ অর্থাৎ প্রধান প্রকৌশলী হওয়ার প্রতিযোগিতায়। এ বাবদ তবিবুর রহমানের বরাদ্দ ৪০ কোটি টাকা। গত ১১ নভেম্বর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীর রুটিন দায়িত্বে থাকা মীর আব্দুর সাহিদ পিআরএল গমন করেন। তারপরেই অত্যন্ত জোরেশোরে মাঠে নামেন প্রকৌশলী তবিবর। ৪০ কোটির বিনিময়ে তবিবুরকে প্রধান প্রকৌশলী পদে রুটিন দায়িত্বে নিয়োগ দিতে রাজি হয়েছেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। অর্থেরও লেনদেন হয়ে গেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে। এবং এর পরেই প্রধান প্রকৌশলী পদে তবিবুর রহমান তালুকদারকে নিয়োগের নথি উপস্থাপনের নির্দেশ দেন উপদেষ্টা। নথিটি গতকাল বুধবার অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে অগ্রসর হয় বলে জানা যায়। আজই চূড়ান্ত অনুমোদনের পর প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে। যদিও তবিবুর রহমান এই পদের জন্য মোটেই যোগ্য নন।
জানা গেছে, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর (ডিপিএইচই) এর জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে তৈরি করা গ্রেডেশন তালিকার ক্রমিক নং ২৫-এ রয়েছে প্রকৌশলী তবিবুর রহমান তালুকদারের নাম। অর্থাৎ সিনিয়র ২৪ জন কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে তিনি প্রধান প্রকৌশলীর চেয়ারে বসতে চান। যদিও এখনো তিনি নির্বাহী প্রকৌশলী পদেই আছেন। তার আগের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা রয়েছেন যারা তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদে চলতি দায়িত্বে কাজ করছেন। তাছাড়া অধিদপ্তরে প্রকৌশলী তবিবুর একজন শীর্ষ দুর্নীতিবাজ হিসেবেও চিহ্নিত। এমনকি তিনি হাসিনা ঘনিষ্ঠ ফ্যাসিস্ট সংগঠন বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদেরও সক্রিয় সদস্য। এই সংগঠনের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য হিসেবে তিনি অফিসিয়ালি আছেন ২০২১ সাল থেকে। অথচ এই ফ্যাসিস্ট কর্মকর্তাকেই পছন্দ উপদেষ্টা সজীব ভূঁইয়ার, যিনি জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্বদানের অন্যতম দাবিদার এবং সুবিধাভোগী।
সূত্র জানিয়েছে, সজীব ভূ্ইঁয়ার পরামর্শেই তবিবুর রহমান সম্প্রতি দৈনিক জাতীয় পত্রিকাগুলোয় ব্যক্তিগত অর্থ খরচ করে বিজ্ঞাপন দিয়ে ফলাও করে জানান দিয়েছেন যে, তার অজ্ঞাতসারে বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদের সদস্য হিসেবে নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এরজন্য বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে তিনি প্রতিবাদ করেছেন। যা অত্যন্ত হাস্যকর। ২০২১ সালের ৩ আগস্ট অনুমোদিত ডিপিএইচই’র ১১ সদস্যবিশিষ্ট বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদের কমিটিতে তিনি ৯ নম্বর সদস্য হিসেবে অফিসিয়ালি অন্তর্ভুক্ত আছেন। অথচ ২০২৫ সালে এসে প্রকৌশলী তবিবুর পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে দাবি করছেন, তার অজ্ঞাতসারে বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদের কমিটিতে নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। “আমার অজ্ঞাতে বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদের তালিকায় সদস্য হিসেবে নাম অন্তর্ভুক্তির প্রতিবাদলিপি” শিরোনামে গত ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক নয়াদিগন্ত, দৈনিক কালেরকণ্ঠসহ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় এই বিজ্ঞাপনটি প্রকাশ করা হয়। উপদেষ্টা সজীব ভূঁইয়ার লজ্জা লাগছিলো, তাই তিনি প্রকৌশলী তবিবুরকে ফ্যাসিস্ট চিহ্নটা মুছে ফেলার এই অদ্ভূত পরামর্শ দেন। যদিও এ দ্বারা ফ্যাসিস্ট চিহ্ন মোছার আদৌ কোনো সুযোগ নেই।
উল্লেখ্য, গত শুক্রবার (৭ নভেম্বর) জাতীয় প্রেসক্লাবে এক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তব্যদানকালে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেছেন, “বর্তমান বাস্তবতায় ১০-২০ কোটি টাকা না থাকলে সংসদ নির্বাচন করা সম্ভব নয়।” বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আয়োজিত ওই গোলটেবিল বৈঠকের শিরোনাম ছিল ‘নভেম্বর থেকে জুলাই : বিপ্লব থেকে বিপ্লবে’। উপদেষ্টা সজীব ভূঁইয়ার ওই বক্তব্যটি গণমাধ্যমে বেশ ফলাও করেই প্রচারিত হয়। এর একদিন পরে ৯ নভেম্বর তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেন। দেখা যাচ্ছে, তিনি শুধুমাত্র এক প্রকৌশলীর কাছ থেকেই ৬০ কোটি টাকা পেয়েছেন। এখন নিশ্চয়ই নির্বাচন করতে আর কোনো সমস্যা হবে না, বলছেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
শীর্ষনিউজ