চব্বিশের কোটাবিরোধী আন্দোলন যখন জুলাইয়ের মাঝামাঝিতে তীব্র হয়ে ওঠে, তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অতিরিক্ত বল প্রয়োগ শুরু করে। এ সময় আন্দোলনকারীদের দমনে নির্বিচারে গুলি চালানো হয়। এতে নিহত হন অসংখ্য মানুষ। সে সময় হাসিনা সরকারের আপ্রাণ চেষ্টা ছিল নিহতদের প্রকৃত সংখ্যা লুকানো। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের মাধ্যমে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের রায়েরবাজার কবরস্থানে বেওয়ারিশ হিসেবে গণকবরে দাফন করা হয় ১১৪ জনকে। হাসিনার পলায়নের পর প্রায় দেড় বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত তাদের পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি।
গত এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকার এবং জুলাই বিপ্লবে নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তি ও সংগঠকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে সমাধান পাননি স্বজনরা। বারবার আশ্বাস দিলেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় বিপ্লবের ১৫ মাস পরও অজানা রয়ে গেছে সেসব শহীদের পরিচয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর ঢাকার যাত্রাবাড়ী থানার আমলি আদালতে একটি মামলা করে জুলাই বিপ্লবে আন্দোলনে অংশ নিয়ে নিখোঁজ হওয়া ব্যবসায়ী সোহেল রানার পরিবার। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও মামলার কোনো তদন্ত প্রতিবেদন জমা না দেওয়ায় সোহেল রানার পরিবার আদালতে আবার আবেদন করে। তারা মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে সোহেল রানাসহ অজ্ঞাত ১১৩ জনের লাশ উত্তোলন, ময়নাতদন্ত ও পরিচয় শনাক্তের জন্য ডিএনএ প্রোফাইল সংরক্ষণের আবেদন করেন। এরপর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিজেও আদালতে একটি আবেদন করেন। আদালত গত ৩০ জুলাই দুটি আবেদনই মঞ্জুর করে। আদালতের ওই নির্দেশনার পর সরকার ১১৪ জনের লাশের ময়নাতদন্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়।
গত ২ আগস্ট গণকবর পরিদর্শন করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। ওই সময় তিনি জানান, ‘শুরুতে কবরগুলো থেকে লাশ তুলতে স্বজনরা রাজি না হলেও পরে মত দিয়েছেন। ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে লাশগুলো শনাক্ত করা হবে। পরিচয় শনাক্তের পর কোনো স্বজন লাশ নিয়ে যেতে চাইলে দেওয়া হবে।’
গত ৩০ অক্টোবর রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ‘উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে রায়েরবাজার শহীদ কবরস্থানে জুলাই শহীদদের অজ্ঞাত লাশ শনাক্তে বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় একটি ল্যাব স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়েছে।’
তবে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন সূত্রে জানা গেছে, উদ্যোগ নিলেও বিষয়টি সহসাই বাস্তবায়ন হচ্ছে না। আগামী বছরের জানুয়ারিতে এটি হতে পারে বলে ফাউন্ডেশন থেকে জানানো হয়েছে। কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন হওয়ায় এ সময়ের মধ্যেও তার বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় দেখছেন মানবাধিকারকর্মীরা।
১১৪ লাশের মধ্যে কোন হাসপাতাল থেকে কত
আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ১৯ জুলাই থেকে আগস্ট পর্যন্ত রায়েরবাজারে দাফন হয় ১১৪টি লাশ। এর মধ্যে জুলাইয়ে আসে ৮০টি। আগস্টে কবরস্থ করা হয় আরো ৩৪টি লাশ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসব নিখোঁজ লাশের অধিকাংশই জুলাই বিপ্লবে আহত হলেও কেউ কেউ অন্যভাবেও আঘাতপ্রাপ্ত ছিলেন। আঞ্জুমান থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকেও বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।
ঢাকা মেডিকেল মর্গ সূত্রে জানা গেছে, জুলাই বিপ্লবে এ হাসপাতালে ৯৮টি লাশের রেকর্ড রয়েছে। এর বাইরে গত বছরের ১৫ জুলাই পর্যন্ত মর্গে ছিল ২৮টি লাশ। এরপর ২২ ও ২৩ জুলাই আসে আরো ৮টি। তৎকালীন সরকারের চাপে অনেকটা তড়িঘড়ি করে রায়েরবাজারে দাফন করা হয় লাশগুলো।
অন্যদিকে, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ৪৭টি লাশের রেকর্ড রয়েছে। হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পর ওই হাসপাতালে গিয়ে তৎকালীন পরিচালক ডা. শফিউর রহমানের কাছে ঢাকা ও এর আশপাশের জেলাগুলো থেকে বেওয়ারিশ লাশের সন্ধানে স্বজনদের আসতে দেখেন এই প্রতিবেদক। তবে হাসপাতালটির বর্তমান পরিচালক ডা. সেহাব উদ্দিন জানান, বেওয়ারিশ লাশের ব্যাপারে তার কাছে কোনো তথ্য নেই।
তবে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম সূত্রে পাওয়া তথ্য বলছে, জুলাই বিপ্লবে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল থেকে বেওয়ারিশ লাশ পাওয়া গেছে ১৫টি। এর মধ্যে ২২ ও ২৭ জুলাই ৯টি এবং ২১ আগস্ট ছয়টি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালটির সার্জারি বিভাগের একজন সহকারী অধ্যাপক বলেন, ‘হাসপাতালে শুধু রেকর্ড লাশের তথ্য রয়েছে। বিপ্লবের সময় অনেক লাশ রেকর্ড ছাড়াই ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, কেউবা ঝামেলা এড়াতে নিজে থেকেই স্বজনদের লাশ নিয়ে যান। ৫ আগস্টের পর ২৫টির মতো লাশ ছিল। এর মধ্যে অনেকে তাদের স্বজনের লাশ শনাক্ত করে নিয়ে গেছেন। বাকিদের আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কাছে দিয়ে দেওয়া হয়।’
এ দুই হাসপাতাল ছাড়াও পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ (মিটফোর্ড) হাসপাতাল ১৪টি, গাজীপুরের তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল চারটি, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল থেকে একটি লাশ পেয়েছে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। বাকিদের পাওয়া যায় বিভিন্ন থানা ও এলাকা থেকে।
আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের দাফন সেবা কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম আমার দেশকে বলেন, ‘লাশগুলোর পরিচয় শনাক্তে আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। জুলাই ও আগস্টে যেহেতু একটা বিশেষ পরিস্থিতি ছিল, তাই সে সময়ের লাশগুলোর ছবি তুলে রাখা হয়েছে। অনেক স্বজন সেখান থেকে তাদের পরিচয় শনাক্ত করেছেন। প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও থেকে স্বজনদের ফোন আসে। যেসব লাশ গণকবর দেওয়া হয়েছে, সেখানে জুলাই বিপ্লবে শহীদরা যেমন আছেন, অন্যান্য ঘটনায় আঘাতপ্রাপ্তরাও থাকতে পারেন। সেটি শনাক্ত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।’
দ্বারে দ্বারে ঘুরেও অপেক্ষা শেষ হয় না স্বজনদের
গাড়িচালক আসাদুল্লাহ। দুই সন্তানের জনক তিনি। গত বছরের ১৯ জুলাই আসরের নামাজ পড়তে গিয়ে উত্তরার বাউনিয়ায় পুলিশের গুলিতে আহত হন ৩০ বছর বয়সি এই ব্যক্তি। পরে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। অবস্থা গুরুতর হয়ে পড়ার পর লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হলেও বাঁচানো যায়নি আসাদুল্লাহকে। পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তড়িঘড়ি করে লাশ আঞ্জুমান মুফিদুলে দিলে ২৪ জুলাই আসাদুল্লাহসহ আটজনকে রায়েরবাজারে গণকবর দেওয়া হয়।
আসাদুল্লাহর স্ত্রী ফারজানা আক্তার আমার দেশকে বলেন, অনেক খুঁজেও না পেয়ে শেষ পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেলে যোগাযোগ করা হয়। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে পরিচয় শনাক্ত করার পর আঞ্জুমানে যোগাযোগ করলে জানা যায়, তাকে ইতোমধ্যে দাফন করা হয়েছে। কিন্তু আজ প্রায় দেড় বছর হতে চলেছে, স্বামী মারা গেছেন নিশ্চিত হলেও কোন কবরটি তার—সেটি জানতে পারিনি। সন্তানরাও জানে না তাদের বাবার কবর কোনটি। শুধু অপেক্ষাই বাড়ছে।’
অন্যদিকে, গত বছরের ১৮ জুলাই যাত্রাবাড়ীর দক্ষিণ কাজলা এলাকায় শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে অংশ নিয়ে নিখোঁজ হন কাপড় ব্যবসায়ী সোহেল রানা। পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন স্থান ও হাসপাতালে খোঁজ করেও তার কোনো সন্ধান পাননি। পরবর্তীতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত ভিডিও থেকে সোহেলের পরিচয় শনাক্ত করে তার পরিবার। সপ্তাহ দুয়েক পর অপরিচিত নম্বর থেকে করা ফোনকলের মাধ্যমে জানতে পারেন, আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের সহায়তায় রায়েরবাজারে অনেকগুলো লাশ দাফন করা হয়েছে। যার মধ্যে সোহেল রানার ছবিও দেখা গেছে। পরে সেখানে গিয়ে সোহেল রানার পরিচয় নিশ্চিত হন তার পরিবার। তবে সে ঘটনার এক বছর পেরিয়ে গেলেও আজও তাদের অপেক্ষা শেষ হয়নি।
সোহেলের ছোট ভাই নাবিলের অভিযোগ, ‘গত ৩০ সেপ্টেম্বর নিখোঁজ স্বজনদের অপেক্ষায়—এমন পরিবারের আটজনকে নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি সভা ডাকা হলেও উপদেষ্টার দেখা পাননি তারা। পরে মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, লাশ উত্তোলনের কাজ আগামী ১ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে হবে। এত দেরির কারণ জানতে চাইলে মন্ত্রণালয় জানায়, স্পেন ও আর্জেন্টিনা থেকে ফরেনসিক টিম আসছে। আর এখন বর্ষাকাল, তাই কাজ করা সম্ভব হবে না।’
তিনি বলেন, ‘লাশ উত্তোলন নিয়ে প্রশাসন আমাদের সঙ্গে টালবাহানা করছে। এমনকি বিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়া নাহিদ ইসলামরাও দ্রুত কাজ করার আশ্বাস দিয়েছিলেন, কিন্তু তারাও কথা রাখেননি। সবাই শুধু ক্ষমতার পেছনে পড়ে আছেন। যারা জীবন দিয়েছেন, তাদের লাশটা পর্যন্ত পরিবারকে বুঝিয়ে দেওয়ার পদক্ষেপ নিচ্ছে না।’
ময়নাতদন্ত শুরু হবে কবে
কবে নাগাদ ময়নাতদন্ত শুরু হচ্ছে, তা সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এখন পর্যন্ত জানানো হয়নি। যদিও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে আগামী বছরের জানুয়ারিতে ময়নাতদন্ত হতে পারে বলে জানানো হয়েছে।
এ বিষয়ে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) প্রধান ছিবগাত উল্লাহ আমার দেশকে জানান, ‘লাশগুলো শনাক্তে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়েছে। শিগগির কাজ শুরু হবে। আমরা চাচ্ছি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনেই তা হোক। সে অনুযায়ী আন্তর্জাতিক একটি ফরেনসিক টিম আসবে শিগগির। আমাদের প্রস্তুতি প্রায় শেষদিকে। আশা করি দ্রুত শুরু করতে পারব।’
জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা লে. কর্নেল (অব.) কামাল আকবর বলেন, ‘ময়নাতদন্ত না হওয়ায় পরিচয়বিহীন লাশগুলো ১৮ থেকে ১৯ জুলাইয়ের মধ্যে দাফনে সরকার উদ্যোগ নিয়েছিল। এজন্য বধ্যভূমিতে একটি ফরেনসিক বিভাগ খোলার দাবি জানানো হয়েছে। সেখানেই ময়নাতদন্ত হবে। সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে আগামী বছরের জানুয়ারি নাগাদ প্রক্রিয়া শুরু হবে। তবে নতুন কোনো অবকাঠামো না করে আশপাশে থাকা ভবনগুলোকে উপযোগী করে দ্রুত সময়ের মধ্যে করার দাবি জানিয়েছি আমরা।’
অন্তর্বর্তী সরকারের চূড়ান্ত ব্যর্থতা
দীর্ঘ সময় পেয়েও নিহত জুলাইযোদ্ধাদের পরিচয় শনাক্ত করতে না পারাকে অন্তর্বর্তী সরকারের চূড়ান্ত ব্যর্থতা বলে মনে করছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দলটির যুগ্ম আহ্বায়ক ও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের লিগ্যাল অ্যাডভাইজর মুজাহিদুল ইসলাম শাহীন আমার দেশকে বলেন, ‘আমরা মনে করি এখন পর্যন্ত এই লাশগুলো শনাক্ত না হওয়ার বিষয়টি বর্তমান সরকারের চূড়ান্ত ব্যর্থতা। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে লাশগুলো (শহীদদের) শনাক্তের ব্যবস্থা করা এবং প্রত্যেক পরিবারকে তাদের কষ্ট লাঘবে কিছুটা হলেও সুযোগ করে দেওয়া উচিত ছিল।
সরকারের লজ্জা পাওয়া উচিত—মানবাধিকারকর্মী এলিনা খান
প্রায় দেড় বছরেও ১১৪ লাশের পরিচয় শনাক্ত করতে না পারায় সরকারের লজ্জা পাওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন মানবাধিকারকর্মী ও হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট এলিনা খান। আমার দেশকে তিনি বলেন, সরকারের উচিত ছিল দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই লাশগুলো পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া। কিন্তু দায়িত্ব নেওয়ার প্রায় দেড় বছর হতে চলল, এতদিনে লাশগুলোয় মাংস নেই নিশ্চয়ই, হাড়গুলো হয়তো আছে। অথচ সরকারের এটি নিয়ে সদিচ্ছা তেমন দেখা যাচ্ছে না। এজন্য সরকারের লজ্জা পাওয়া উচিত।