Image description
ফাহাম আব্দুস সালাম জুলাই সনদকে মানা বা না মানা নিয়ে একটি একাডেমিক এবং তাত্ত্বিক আলোচনা তুলেছেন, যা নিয়ে আমি আমার তাত্ত্বিক জবাব দিচ্ছি। এটা কোনো ব্যক্তিগত আক্রমণ নয়, বরং যুক্তিভিত্তিক কাউন্টার-আর্গুমেন্ট। আমি ফাহামের প্রশ্নগুলোর সারাংশ দিয়ে শুরু করব, তারপর লিগাল, রাজনৈতিক এবং দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করব, যাতে লজিক্যাল ফ্যালসি বা ওভারসিম্পলিফিকেশন বা ফিয়ার-মঙ্গারিং সংশোধিত হয়।
ফাহামের প্রশ্নের সারাংশ:
প্রথম প্রশ্ন: গণভোটে “না-ভোট” জিতলে স্ট্যাটাস কো কী হবে? সংবিধান সংশোধন করা উচিত কি না? ফাহাম বলছেন, “না” জিতলে হয় আগের সংবিধানে (হাসিনা-যুগের) ফিরে যাওয়া (যা আওয়ামী লীগের ইমপ্লিসিট পজিশন), নয়তো অন্য সংস্কার—কিন্তু ঝুঁকি আছে যে কোনো সংস্কারই হবে না, বিশেষ করে সুপার মেজরিটি না থাকলে “কনস্টিটিউশনাল লিম্বো” তৈরি হবে। তিনি এটাকে “ভয়ঙ্কর বিপদ” বলছেন।
দ্বিতীয় প্রশ্ন: গণভোটের রিস্ক কেন নেওয়া? কী লাভ হবে? ফাহাম বলছেন, গণভোট মোরালি বাইন্ডিং, লিগালি নয়—এবং “না” জিতলে সংস্কার বন্ধ হয়ে যাবে, আওয়ামী লীগ লেজিটিমেট হয়। বিএনপি/জামায়াত শুধু তাদের প্রমিস মানবে, এবং “হ্যাঁ” জিতলেও কোনো আইনি ভিত্তি নেই। কেন এই রিস্ক?
প্রথমেই লিগাল এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে স্পষ্ট করি যে, বাংলাদেশের সংবিধান (আর্টিকল ১৪২) অনুসারে, সংবিধান সংশোধনের জন্য সংসদে ২/৩ মেজরিটি দরকার, এবং কিছু মৌলিক অংশ (যেমন প্রিএম্বল, আর্টিকল ৮, ৪৮, ৫৬ ইত্যাদি) সংশোধনের জন্য গণভোটও দরকার। জুলাই সনদ যেহেতু এই মৌলিক অংশগুলোর সংস্কার প্রস্তাব করে (যেমন PM-এর ক্ষমতা হ্রাস, নির্বাচনী সংস্কার), তাই এর বাস্তবায়নের জন্য গণভোট অপরিহার্য।
এটাও ঠিক যে গণভোটের ফলাফল লিগালি বাইন্ডিং নয় (যদি না সংবিধানে স্পষ্টভাবে বলা থাকে), বরং এটা একটা অ্যাডভাইজরি রেফারেন্ডাম—যা পার্লামেন্টকে গাইড করে, কিন্তু বাধ্য করে না। কিন্তু গণভোট জনগণের ইচ্ছা প্রতিফলিত করে, যাকে ইগনোর করলে রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজনৈতিক মূল্য দিতে হবে—এটা জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা বলে গণ্য হবে। যদিও সবকিছু লিগাল এবং রাজনৈতিক ইন্টারপ্রিটেশনের উপর নির্ভর করে।
গণভোট কোনো রিস্ক নয়, বরং নেসেসিটি—কারণ গণভোট ছাড়া সংস্কারের লেজিটিমেসি নেই। লিগালি অ্যাডভাইজরি হলেও এটা পলিটিকাল ম্যান্ডেট দেয়, যা কোর্টে চ্যালেঞ্জ করা কঠিন (যেমন বাংলাদেশের ৫ম সংশোধনী কেসে সুপ্রিম কোর্ট ম্যান্ডেটকে কনসিডার করেছে)। বিএনপির নিজেদের শুরুর ইতিহাসেও গণভোটের মাধ্যমে সংস্কার হয়েছে।
গণভোটে যদি “হ্যাঁ” জিতে, তাহলে এটা শুধু জুলাই সনদকে অনুমোদন করে না, বরং সামগ্রিক সংস্কার প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করে। নিচে সুস্পষ্ট পয়েন্টস:
১) এটা মোরালি বাইন্ডিং হয়ে লিগাল প্রসেসকে অ্যাক্সেলারেট করে—সংসদে সংশোধনী বিল দ্রুত পাস হতে পারে।
২) রাজনৈতিক দলগুলোর উপর (যেমন বিএনপি/জামায়াত) সংস্কার মানতে প্রেসার পড়বে (দরকার হলে ডিসেন্ট সহকারে), যা এলিট -ড্রিভেন রিফর্মের পরিবর্তে জনমুখী হয়।
৩) বিপ্লবী ছাত্রদের দল এনসিপির অবস্থানকে লেভারেজ দেয়, যা ট্রানজিশনাল পিরিয়ডে স্টেবিলিটি বাড়ায়।
৪) আওয়ামী লীগের অটোক্রেটিক-যুগের স্বৈরাচারকে চিরতরে খারিজ করে, যা জুলাই বিপ্লবের ম্যান্ডেটকে সুসংহত করে।
৫) সংস্কারের দ্রুত বাস্তবায়ন সম্ভব হয়—যেমন PM-এর ক্ষমতা হ্রাস, নির্বাচনী সংস্কার—যা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনে।
৬) আন্তর্জাতিক সাপোর্ট বাড়বে (যেমন ডোনার দেশগুলো থেকে), কারণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া দেখে তারা আরও সহায়তা দেবে।
৭) ট্রানজিশনাল জাস্টিস (যেমন অতীত অত্যাচারের বিচার) সহজ হয়, যা সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে।
৮) দীর্ঘমেয়াদে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি মজবুত হয়, যা ভবিষ্যতের অটোক্রেসি প্রতিরোধ করে।
গণভোটে যদি “না” জিতে, তাহলে এটা সংস্কারের শেষ নয়, বরং নতুন দিকনির্দেশনা। ফাহামের অ্যাসাম্পশন যে এটা “ভয়ঙ্কর বিপদ” বা সবকিছু বন্ধ করে দেবে—এটা লজিক্যাল ফ্যালসি (ওভারসিম্পলিফিকেশন এবং ফিয়ার-মঙ্গারিং), কারণ গণভোট অ্যাডভাইজরি। নিচে সুস্পষ্ট পয়েন্টস:
১) নতুন সরকার আগের সংবিধান (হাসিনা-যুগের) চালাতে পারে, কিন্তু তা পলিটিক্যালি ঝুঁকিপূর্ণ—তাই সংশোধনের চেষ্টা “উচিত” হবে, কারণ সংবিধান একটা লিভিং ডকুমেন্ট (বেসিক স্ট্রাকচার অপরিবর্তনীয়, কিন্তু অ্যাডাপ্টেশন সম্ভব)।
২) “সংস্কার করা যাবে না”টা লিগালি ভুল—পার্লামেন্ট সুপার মেজরিটি পেলে যেকোনো সংশোধন করতে পারে, গণভোটের ফলকে ইগনোর করে (যদিও মোরালি ঝুঁকিপূর্ণ)।
৩) “না” জিতলে এটা শুধু জুলাই সনদকে খারিজ করে, সব সংস্কারকে নয়—অন্য প্রস্তাব (যেমন গণপরিষদ বা ইসলামী সংস্কার) আনা যাবে। লিগালি, এটা “লিম্বো” নয়, বরং গণতান্ত্রিক ফ্লেক্সিবিলিটি।
৪) রেফারেন্ডামের ফল একটা “ম্যান্ডেট” দেয়, কিন্তু বাইনারি নয়— “না” জিতলে এটা ইম্প্লাই করতে পারে যে জনগণ সংস্কার চায়, কিন্তু জুলাই সনদের ফর্ম্যাটে নয়। উদাহরণ: স্কটল্যান্ডের ইন্ডিপেন্ডেন্স রেফারেন্ডাম (২০১৪)—“না” জিতলেও (৫৫% থেকে ৪৫%), এটা ডেভলিউশনকে অ্যাক্সেলারেট করেছে, না যে সবকিছু স্ট্যাটাস কোতে ফিরেছে।
৫) সুপার মেজরিটি না থাকলে “লিম্বো” নয়, বরং কোয়ালিশন গভর্নমেন্ট—যা পলিটিকাল সায়েন্সে “কনসেনসাস ডেমোক্রেসি” (আরেন্ড লিপহার্টের মডেল) বলে পরিচিত, যা সরকারের স্টেবিলিটি বাড়ায়।
৬) “না” জিতলে আওয়ামী লীগকে লেজিটিমাইজ করে না—বরং জুলাই বিপ্লবের আন্দোলন জীবিত রাখে। আওয়ামী লীগ এখন ডিসক্রেডিটেড, এবং “না” তাদেরকে আরও দুর্বল করে (কারণ এটা হাসিনা-সংবিধানকে চ্যালেঞ্জ করে, পঞ্চদশ সংশোধনী)।
প্র্যাকটিকালি, নতুন পার্লামেন্ট “সংস্কার করতে হবে”কে প্রায়োরিটাইজ করতে পারে। উদাহরণ: ১৯৯০-এর এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনের পর সংস্কার হয়েছে গণভোট ছাড়াই, কিন্তু আজকের কনটেক্সটে গণভোট ছাড়া ইমপোজ করলে দলগুলো সংসদে এবং ছাত্র-জনতা রাস্তায় প্রতিবাদ করবে, যা অস্থিরতা আনবে।
রাজনৈতিক বিজ্ঞানে (ডাহলের পলিআর্কি), গণভোট পাবলিক ওপিনিয়ন মেজার করে ট্রানজিশনাল পিরিয়ডে স্টেবিলিটি আনে। রিস্ক আছে, কিন্তু না নিলে এলিট-ড্রিভেন রিফর্ম (যেমন ঐক্য কমিশন) ফেল হয়। উদাহরণ: তিউনিসিয়ার আরব স্প্রিং-এর পর (২০১১-এর বিপ্লব), কনস্টিটিউশনাল অ্যাসেম্বলি এবং ইলেকশনের মাধ্যমে সংস্কার সফল হয়েছে, যা আরব স্প্রিং-এর একমাত্র সাক্সেস স্টোরি।
গণভোটের ভোট পার্সেন্টেজ দেখে বোঝা যাবে জনগণ সংস্কার চায় কি না, কিন্তু “না” ভোট আওয়ামী লীগকে লেজিটিমেসি দেয় না—কারণ এটা সংবিধানের প্রশ্ন, রাজনৈতিক দলের নয়।
দার্শনিকভাবে (জন লকের সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট বা রুসোর “জেনারেল উইল”), সংবিধান জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন—গণভোট সেই ইচ্ছাকে টেস্ট করে। ফাহামের “ফল না মানলে বিপদ” সত্য, কিন্তু জনগণের ইচ্ছা ডাইনামিক—একটা “না” সবকিছু বন্ধ করে না, বরং নতুন ডায়ালগ খোলে।
এটা “আত্মহত্যামূলক” নয়, বরং এথিক্যাল। গণভোট না করে ইমপোজ করা অথরিটারিয়ানিজম। কান্টের ক্যাটাগরিক্যাল ইম্পেরেটিভ - জনগণকে মিনস হিসাবে নয়, বরং এন্ড হিসেবে ট্রিট করো। হেগেলের ডায়ালেকটিক অনুসারে, গণভোট থিসিস-অ্যান্টিথিসিস—যা সিন্থেসিস , এবং ভালো সংস্কার আনে। রিস্ক না নিলে সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট ভাঙে। সর্বোপরি লাভ হবে মোরাল অথরিটির, যা স্বৈরাচারকে চ্যালেঞ্জ করে।
ফাহামের প্রশ্নগুলোতে ঝুঁকির ওভারএমফাসিস আছে, কিন্তু গণভোট গণতন্ত্রের হার্ট—এটা ছাড়া সংস্কার অস্থায়ী। “হ্যাঁ” জিতলে সংস্কার অ্যাক্সেলারেট হয়, “না” জিতলে নতুন করে সংস্কারের ডিবেট শুরু হয়—শেষ নয়।
 
 
লেখকঃ সাবিনা আহমেদ