Image description

বগুড়ার মসলা গবেষণা কেন্দ্রের উদ্ভাবনের তালিকায় আছে ২৭ প্রজাতির ৫৮টি জাত। কর্মকর্তাদের দাবি মাঠপর্যায়ে কৃষির বাস্তবায়ন সহায়ক করতে তারা উদ্ভাবন করেছে ৬৬টি উন্নত প্রযুক্তি। কিন্তু এর কোনোটিরই সুফল পাচ্ছে না সাধারণ মানুষ। মাঠপর্যায়েও নেই তেমন প্রতিফলন। যেটুকু আছে তা যেন বিপুল উদ্যোগে তুচ্ছ অর্জন। এতে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) অধীন এ প্রতিষ্ঠানটির তার উদ্দেশ্য পূরণে কতটুকু ভূমিকা রাখছে, এ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটির উদ্ভাবিত বেশিরভাগ জাতের নামও জানেন না কৃষকরা। আর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও দুই-তিনটি মসলা ছাড়া মাঠে অন্য জাত চাষের বিস্তারিত তথ্য জানাতে পারছে না। বীজ সংরক্ষণ ও বিতরণের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান বিএডিসি গত দুই বছরে এই কেন্দ্র থেকে কোনো বীজ কেনেনি।

মসলা গবেষকরা বলছেন, দেশে প্রায় ৪.২৯ হেক্টর জমিতে মসলা চাষ হয়। উৎপাদিত মসলার পরিমাণ প্রায় ৩৫.৯৩ টন। অর্থাৎ বিশ্বের প্রায় ৯ শতাংশ মসলা বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়। দেশে মসলার মোট চাহিদা ৫৮ দশমিক ৫০ লাখ মেট্রিক টন। এরমধ্যে আমদানি হয় ৪৪ দশমিক ৯৬ লাখ মেট্রিক টন। এরপরেও ঘাটতি থেকে যায় আরও ১৩ দশমিক ৫৪ লাখ টন। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে গবেষকেরা জানান, দেশে বছরে গড়ে প্রায় ৮ থেকে ৯ হাজার কোটি টাকার মসলা আমদানি করা হয়।

 

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) অধীনে ১৯৯৪ সাল থেকে কাজ করছে বগুড়ার মসলা গবেষণা কেন্দ্র। মরিচ, আদা, রসুন, হলুদ, পেঁয়াজ, ধনিয়া, জিরা, মেথি, মৌরি, কালো জিরা, সরিষা, এলাচসহ মোট ২৭ ধরনের মসলা জাতীয় ফসলের জাত উদ্ভাবন করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

ল্যাবেই বন্দি উদ্ভাবন, প্রয়োগ নেই মাঠে

অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রতিবছর গড়ে ২-৩টি জাত উদ্ভাবনের কাগজপত্র প্রস্তুত হলেও, সেগুলো মাঠে বাস্তবায়নের জন্য কোনো কর্মপরিকল্পনা বা পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা নেই।

‘কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা কৃষককে নিয়ে মাঠে কাজ করি। তবে এসব জাত ছড়িয়ে পড়ার সরকারি কোনো ট্র্যাকিং বা বাস্তব দৃষ্টান্ত নেই। আমরা ফান্ড পেলে মাঠ কর্মকর্তাদের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ করণের কাজ করে থাকি।’

প্রতিষ্ঠানটির প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আশিকুল ইসলাম দাবি করেন, তাদের উদ্ভাবিত জাত পাবনা, ফরিদপুর, মেহেরপুর, কুমিল্লা, এমনকি পার্বত্য চট্টগ্রামেও চাষ হচ্ছে। কিন্তু মাঠ ঘুরে দেখা গেছে, দুই-চারজন ছাড়া বেশির ভাগ কৃষকেরা সরকারি বীজ পান না, বরং বাজার বা আগের মৌসুমের ফসল থেকে নিজেরাই বীজ সংরক্ষণ করে থাকেন।

বগুড়ার শেরপুর উপজেলার দুইজন আদা চাষি বলেন, সরকারি বা গবেষণার কোনো জাত পাই না, নামও জানি না। নিজেরাই বীজ রাখি বা হাট থেকে কিনি। তবে এখন বস্তায় আদা চাষ হচ্ছে বলে শুনেছি। এখনো কৃষি বিভাগ থেকে এই বিষয়টি আমাদের দেখানো হয়নি।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, মসলা গবেষণা কেন্দ্র আমাদের কাছে জাত পাঠায় না, তাই কোনো প্রশিক্ষণ বা প্রদর্শনীও হয় না। কার্যক্রম না থাকলে কৃষকের কাছে যাওয়া যায় না।

বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক সোহেল মো. শাসসুদ্দীন ফিরোজ জানান, কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা কৃষককে নিয়ে মাঠে কাজ করি। তবে এসব জাত ছড়িয়ে পড়ার সরকারি কোনো ট্র্যাকিং বা বাস্তব দৃষ্টান্ত নেই। আমরা ফান্ড পেলে মাঠ কর্মকর্তাদের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ করণের কাজ করে থাকি।

ল্যাবেই বন্দি উদ্ভাবন, প্রয়োগ নেই মাঠে

বিএডিসির (বীজ) উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) কমল কান্তি বর্মন বলেন, যেকোনো গবেষণার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও মসলার বিষয়টি কিছুটা ধীরগতির। বিগত ২০২৪ সালে তারা বগুড়া থেকে কোনো মসলা বীজ ক্রয় করেনি। ওই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি।

কাগজে জাত, মাঠে শূন্যতা

উদ্ভাবিত জাত মাঠে ছড়িয়ে দেওয়ার কথা বিএডিসি ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের। তবে বিএডিসি ২০২৪ সালে মসলা গবেষণা কেন্দ্র থেকে কোনো বীজ কেনেনি। অন্যদিকে কৃষকদের প্রশিক্ষণ, প্রদর্শনী, মাঠ দিবস বা উদ্বুদ্ধকরণও এক দশকের বেশি সময় ধরে বন্ধ। এই কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আশিকুল ইসলাম বলেন, গবেষণার বাইরে বাজেট নেই, এ কারণে সম্প্রসারণ কাজ করা যায় না। এমনকি জাত বিস্তারের জন্য নিজস্ব প্লট বা আউটরিচ কার্যক্রমও নেই।

নিজেকে বস্তায় আদাচাষের উদ্ভাবক দাবি করে তিনি বলেন, এটি আধুনিক ও সময়োপযোগী পদ্ধতি। পতিত জমি ও অব্যবহৃত জায়গা ব্যবহার করে ব্যাপক উৎপাদন সম্ভব। এখন এই পদ্ধতির কারণে কৃষক উপকার পাচ্ছেন।

‘গবেষণাগারে জাত উদ্ভাবন হচ্ছে, কিন্তু কৃষকের মাঠে তার কোনো অস্তিত্ব নেই। বিস্তারের পরিকল্পনা নেই, বাজেট নেই, পর্যবেক্ষণ নেই। ফলে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি প্রযুক্তি রয়েছে কেবল রিপোর্ট আর কাগজে। ফলে গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহি, কার্যকারিতা ও কৃষকভিত্তিক বাস্তবতা নিয়ে স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্ন ওঠে।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই প্রতিষ্ঠানের সেবার তালিকাও কাগুজে। দাপ্তরিক নথিতে কৃষক ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের জন্য যেসব সেবা থাকার কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে, বিভিন্ন মসলা জাতীয় ফসলের প্রজনন বীজ সরকারি প্রতিষ্ঠান (বিএডিসি, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ইত্যাদি), বেসরকারি সংস্থা এবং কৃষক পর্যায়ে বিতরণ করা। লিফলেট, মেনুয়াল প্রভৃতির মাধ্যমে জনসাধারণের মাঝে উদ্ভাবিত মসলা জাতীয় ফসলের জাত ও প্রযুক্তি সম্পর্কে অবহিত করণ। মাঠ দিবস ও কৃষক প্রশিক্ষণ প্রদান। মতবিনিময় সভা, প্রশিক্ষণ ও ওয়ার্কশপ আয়োজনের মাধ্যমে সরকারি, বেসরকারি পর্যায়ে জাত ও প্রযুক্তি সম্পর্কে অবহিত করণ। সরেজমিনে মাঠ পরিদর্শন বা টেলিফোন আলাপনের মাধ্যমে কৃষকের সমস্যা সমাধান প্রদান এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ কবলিত এলাকায় মসলা জাতীয় ফসলের বীজ ও চারা প্রদানের মাধ্যমে সহায়তা প্রদান।

ল্যাবেই বন্দি উদ্ভাবন, প্রয়োগ নেই মাঠে

তবে বাস্তবে এসব কার্যক্রমের কিছু কিছু থাকলেও বড় ধরনের কোনো উদাহরণ মাঠে মেলেনি। প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলা শতকরা ৯৫ ভাগ কৃষক জানান, তারা কোনোদিনই মসলা গবেষণা কেন্দ্রের কারো মুখোমুখি হননি। স্থানীয় কৃষি অফিসও বলছে, প্রতিষ্ঠানটি বীজ প্রদানের চাইতে গবেষণাতেই বেশি মনোযোগী।

বরাদ্দের অর্থ যায় কোথায়?

প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক বাজেট নিয়ে প্রশ্ন করা হলে মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. জুলফিকার হায়দার প্রধান তথ্য দিতে রাজি হননি। তবে সরকারি দলিল ও পূর্বের হিসাব অনুযায়ী, বারি’র অধীনে থাকা কেন্দ্রগুলোর গবেষণার বার্ষিক ব্যয় গড়ে ২-৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে মসলা গবেষণা কেন্দ্রের বাজেট দেড় থেকে থেকে দুই কোটি টাকা বলে নিশ্চিত করেছে কেন্দ্রের একাধিক সূত্র।

জানা যায়, গবেষণা কেন্দ্র এখনো যুগ যুগ ধরে এলাচ, মৌরি, কালো এলাচের মতো ফসল নিয়ে কাজ করে, যেগুলো বাংলাদেশের মাটিতে পরীক্ষিতভাবে সফল নয়। কর্মকর্তারা বলেন, মাটির গুণাগুণের কারণে সাদা ও কালো এলাচের জাত উদ্ভাবন সম্ভব নয়। তবে হবে না জানার পরেও এই মসলায় বছরের পর বছর গবেষণায় কেন বাজেট খরচ হচ্ছে ? এমন প্রশ্নের জবাব দেননি তারা। কেন্দ্রের এক কর্মকর্তা বলেন, গবেষণার তালিকায় থাকলেই যে চাষযোগ্য হবে তা নয়। কিন্তু কেন অযোগ্য মাটিতে বছরের পর বছর গবেষণা চলবে এই প্রশ্নে তারা উত্তর দেননি।

দেশে মসলা উৎপাদনে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের দাবি কর্মকর্তাদের

গবেষণা কেন্দ্রের ভাষ্যমতে, এ পর্যন্ত তাদের উদ্ভাবিত জাত কৃষক পর্যায়ে ব্যাপকভাবে চাষ হচ্ছে। শুধু জাত নয়, মাঠ পর্যায়ে কৃষির বাস্তবায়ন সহায়ক করতে তারা উদ্ভাবন করেছে ৬৬টি উন্নত প্রযুক্তি। এর মধ্যে রয়েছে আন্তঃফসল চাষের কৌশল, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাত প্রযুক্তি, রোগ-পোকা দমন পদ্ধতি ও মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদনের কৌশল।

কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য মতে, ১৯৯৫-৯৬ সালে দেশে মসলা জাতীয় ফসলের উৎপাদন ছিল ৩ লাখ মেট্রিক টন। বর্তমানে উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫.৯৩ লাখ মেট্রিক টনে। অর্থাৎ উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ১২ গুণ। তাদের উদ্ভাবিত জাতগুলো শুধু উৎপাদন নয়, জলবায়ু পরিবর্তন, চরাঞ্চলের খরাপ্রবণ এলাকা ও সীমিত সম্পদের কৃষকদের জন্য উপযোগী করে তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া বাজারজাতকরণ ও কৃষকের সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়নে উদ্ভাবিত জাত ও প্রযুক্তির প্রভাব পর্যালোচনার জন্য আরও কয়েকটি গবেষণা প্রকল্প চলমান রয়েছে।

ল্যাবেই বন্দি উদ্ভাবন, প্রয়োগ নেই মাঠে

মাঠে পুরোনো জাত

প্রতিবছর কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে আদা, রসুন, পেঁয়াজের দাম দ্বিগুণ হয়ে যায়। অথচ কৃষকরা এখনও ২০-৩০ বছর আগের পুরোনো জাতেই চাষ করছেন। তারা বলেন, গবেষণা কেন্দ্রের উদ্ভাবন মাঠে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া গেলে উৎপাদন বাড়তো, বাজারে চাপ কমতো, কৃষকও পেতেন লাভবান হওয়ার সুযোগ। কিন্তু নানা জটিলতায় এই বীজ তাদের হাত পর্যন্ত এসে পৌঁছায় না।

সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযান (সুপ্র) এর বগুড়ার সম্পাদক কেজিএম ফারুক বলেন, গবেষণাগারে জাত উদ্ভাবন হচ্ছে, কিন্তু কৃষকের মাঠে তার কোনো অস্তিত্ব নেই। বিস্তারের পরিকল্পনা নেই, বাজেট নেই, পর্যবেক্ষণ নেই। ফলে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি প্রযুক্তি রয়েছে কেবল রিপোর্ট আর কাগজে। ফলে গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহি, কার্যকারিতা ও কৃষকভিত্তিক বাস্তবতা নিয়ে স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্ন ওঠে।