Image description

দেশব্যাপী জুলাই আন্দোলনে রংপুরে ১৯ জুলাই রংপুর সিটি বাজারের সামনে পুলিশের গুলিতে চারজন নিহতের ঘটনায় পুলিশ কনস্টেবল আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করেছেন।

 

সিআইডির হাতে গ্রেফতার ওই কনস্টেবল আমিরুল ইসলাম সম্প্রতি আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে ওই হত্যার দায় স্বীকার করেছে বলে মামলার তদন্ত সূত্রে জানা গেছে।

ঘটনার সময় কোন পরিস্থিতিতে তিনি গুলি চালাতে বাধ্য হন তারও বর্ণনা দিয়েছেন পুলিশের ওই সদস্য। ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে রাইফেল থেকে ৫০ রাউন্ড গুলি ছুড়তে বাধ্য হয়েছেন তিনি।

এ ঘটনায় তদন্তে নেমে তৎকালীন পুলিশ কমিশনার মনিরুজ্জামান, পুলিশের ডিসি (অপরাধ) আবু মারুফ হোসেনসহ মেট্রোপলিটন পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততা পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। একই সঙ্গে যে রাইফেল দিয়ে সেদিন গুলি করা হয়েছিল সেই চায়না রাইফেলও সিআইডি তাদের হেফাজতে নিয়েছে। যার ফরেনসিক রিপোর্টও পেয়েছে তদন্ত সংস্থা। সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তা সূত্রে তা জানা গেছে।

রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের রিজার্ভ অফিসে কর্মরত পুলিশ সদস্য আমিরুল ইসলাম ৫ আগস্ট পরবর্তী বদলি নিয়ে খাগড়াছড়ি এপিবিএনে স্পেশালিস্ট ট্রেনিং সেন্টারে প্রশিক্ষণরত ছিলেন। খাগড়াছড়ি থেকেই গত ৬ সেপ্টেম্বর তাকে গ্রেফতার করে রংপুর সিআইডি।

এরপর ৭ সেপ্টেম্বর তাকে রংপুর চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে নেওয়া হলে সেখানে রিমান্ড আবেদন করেন সিআইডি তদন্ত কর্মকর্তা। আদালত তাকে ১ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। ওই দিনই তিনি আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন।

এর আগে পুলিশ সদস্য আমিরুল ইসলামকে ফল বিক্রেতা মেরাজুল ইসলাম হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। তিনি এজাহারনামীয় আসামি ছিলেন না। বর্তমানে তিনি রংপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন। চাকরি থেকে সাময়িক বহিষ্কার হয়েছেন।

জানা গেছে, রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের রিজার্ভ অফিসে কর্মরত ছিলেন সিআইডির হাতে গ্রেফতার পুলিশ সদস্য আমিরুল ইসলাম। ঘটনার সময় তাকে মেট্রোপলিটন পুলিশের সাদা এপিসিতে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ওই এপিসিতে আমিরুল ইসলাম ছাড়াও মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (অপরাধ) আবু মারুফ হোসেনসহ ৬ পুলিশ সদস্য ছিলেন।

তিনি পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশে গুলি চালিয়েছেন। তবে তার গুলিতেই ওই চারজন নিহত হয়েছেন কিনা তা তিনি উল্লেখ করেননি। এ সময় মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার অফিসের সামনে কোন কোন কর্মকর্তা কী নির্দেশনা দিয়েছেন তা তিনি উল্লেখ করেছেন জবানবন্দিতে।

ওই দিন ঘটনাস্থলে মেট্রোপলিটন পুলিশ, জেলা পুলিশ, ডিবি, এপিবিএনের সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন। মেট্রোপলিটন পুলিশের এপিসি ছাড়াও জেলা পুলিশের এপিসিতে নেতৃত্বে দিয়েছেন তৎকালীন পুলিশ সুপার শাজাহান আলী এবং জেলা পুলিশের সদস্যরাও। যৌথভাবে তারা আন্দোলন মোকাবেলা করার চেষ্টা চালিয়েছেন। যার ফুটেজ ও অন্যান্য তথ্য সংগ্রহ করে ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িতদের চিহ্নিত করেছেন তদন্ত সংস্থা।

এদিকে ওই ঘটনায় রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার আবু মারুফ হোসেনকে গ্রেফতার করার অনুমতি চেয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি দিয়েছে সিআইডি। একই সঙ্গে অভিযুক্ত অন্যান্যদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গত ১৬ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যার পর উত্তাল হয়ে উঠে রংপুর। ১৮ ও ১৯ জুলাই তীব্র সংঘর্ষ চলে দিনভর। ১৯ জুলাই বিকালের সংঘর্ষে রংপুর সিটি বাজারের সবজি বিক্রেতা সাজ্জাদ হোসেন, ফল বিক্রেতা মেরাজুল ইসলাম, স্বর্ণ কারিগর মোসলেম উদ্দিন মিলন ও শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল তাহির খুন হন।

সাজ্জাদ হোসেন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় স্ত্রী জিতু বেগম পুলিশের ৬ কর্মকর্তাসহ ২১ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন। ফল বিক্রেতা মেরাজুল ইসলাম হত্যাকাণ্ডে মা আম্বিয়া খাতুন রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার উৎপল কুমার রায়, সহকারী কমিশনার ইমরান হোসেন, সহকারী কমিশনার আরিফুজ্জামান আরিফ, এসআই মামুন, এসআই গণেশ, এসআই মজনু, ২০নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর তৌহিদুল ইসলাম, ২৪নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর রফিকুল আলমসহ ২১ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন।

স্বর্ণ কারিগর মোসলেম উদ্দিন মিলন হত্যা মামলায় বিভাগীয় কমিশনার জাকির হোসেন, সাবেক ডিআইজি আব্দুল বাতেন, সাবেক পুলিশ কমিশনার মনিরুজ্জামান, সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, সাবেক স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীসহ ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন।

শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল তাহির হত্যা মামলায় শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক রংপুর পুলিশ কমিশনার মনিরুজ্জামানসহ আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ দলের ৪০ জনের নাম উল্লেখ করে রংপুর মেট্রোপলিটন কোতোয়ালি থানায় মামলা দায়ের করেন তার বাবা আব্দুর রহমান।

এসব মামলায় অধিকতর তদন্তের জন্য মামলার তদন্ত ভার পায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

রংপুর সিআইডির পুলিশ সুপার (ভারপ্রাপ্ত) সুমিত চৌধুরী জানিয়েছেন, আইজিপি ও সিআইডি চিফের নির্দেশনা রয়েছে নিরপেক্ষ থেকে মামলার তদন্ত সম্পন্ন করতে। কেউ যেন হয়রানি না হন। বিভিন্ন ডিভাইসের ফরেনসিক রিপোর্ট, ব্যালেসটিক রিপোর্ট আমরা পেয়েছি। আমাদের কাছে সমস্ত ডিজিটাল প্রমাণ আছে। সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিয়েছেন, ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন।

তিনি বলেন, আমাদের মূল কাজ শেষ। প্রতিটি মামলায় প্রায় দেড় দুই শতাধিক আসামি। প্রত্যেকের বিষয়ে যাচাই-বাছাই চলছে। আমরা দ্রুতই অভিযোগপত্র দাখিল করব।