Image description

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিক সহিংসতার মামলার অভিযোগপত্রে মৃত , নিখোঁজ ও অনিবাসী ব্যক্তির নাম এবং বিচারে তাঁদের সাজা হওয়ার কিছু নজির রয়েছে । জুলাই অভ্যুত্থানের পরও কিছু মামলায় মৃত ব্যক্তিদের আসামি করার অভিযোগ উঠেছে । অভিযোগপত্রে মৃত , অনাবাসী ব্যক্তির নাম ঠেকাতে পুলিশ সদর দপ্তর ৯ টি নির্দেশনা দিয়েছে । সূত্র বলেছে , নির্দেশনায় বলা হয়েছে , কোনো মৃত ব্যক্তিকে আদালতে দেওয়া চূড়ান্ত অভিযোগপত্রে বা তদন্ত প্রতিবেদনে আসামি করা হলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে । তাঁদের শাস্তি পেতে হবে । অভিযোগপত্রে মৃত , নিখোঁজ ও ঘটনার সময় প্রবাসী ব্যক্তিদের নাম থাকাকে তদন্তে ঘাটতি , গাফিলতি বলছেন বিশেষজ্ঞরা । 

তবে পুলিশ সদর দপ্তর বলছে , গত ( দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ) নির্বাচনের আগে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির চাপের কারণে এসব ঘটনা ঘটেছে । পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক ( আইজিপি ) নুরুল হুদা বলেন , মৃত ও অনিবাসী মানুষকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেওয়া শুধু প্রশাসনিক ত্রুটি নয় , এটি আইনি প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থার সংকট তৈরি করে । পুলিশ সদর দপ্তরের নজরদারির উদ্যোগ ইতিবাচক হলেও বাস্তবে কতটা পরিবর্তন আসবে , সময়ই তা বলে দেবে ।

পুলিশের সূত্র জানায় , বৈষম্য- বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে হত্যা , হত্যাচেষ্টা , হামলা , লুট , অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন অভিযোগে সারা দেশের থানায় ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর অসংখ্য ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে । আসামির তালিকায় মৃত ব্যক্তির নামও দিয়েছেন বাদীরা । এ নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়ে পুলিশ । এ জন্যই পুলিশ সদর দপ্তর ইউনিটগুলোকে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছে ।

পুলিশ সদর দপ্তরের রিসার্চ , প্ল্যানিং ও ইনোভেশন বিভাগের সহকারী মহাপরিদর্শক ( এআইজি ) আহমেদুল কবীর স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে সম্প্রতি পুলিশের সব ইউনিটকে এই নিৰ্দেশনা দেওয়া হয় । নির্দেশনার ৩ নম্বর ক্রমিকে বলা হয়েছে , ভুয়া , গায়েবি মামলায় অনিবাসী , মৃত , নিরাপরাধ নাগরিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিলের বিষয়টি প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য হবে । কোনো পুলিশ সদস্য যদি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে কাউকে এ ধরনের মামলায় হয়রানি করেন , তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে । এ ছাড়া ওই নির্দেশনায় বলা হয়েছে , চাকরির জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশন এক মাসের মধ্যেই দিতে হবে । বাংলাদেশের ফৌজদারি আইনে স্পষ্ট বলা আছে , অভিযুক্ত ব্যক্তি মারা গেলে তাঁর বিরুদ্ধে মামলারও নিষ্পত্তি হয়ে যায় । কিন্তু পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্র জানায় , ২০২২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন থানার তদন্তকারী কর্মকর্তারা অন্তত ১১ জন মৃত ব্যক্তির নাম অভিযোগপত্রে অন্তর্ভুক্ত করেছেন । তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন রাজনৈতিক নেতা-কর্মী । এ ছাড়া অভিযোগের ঘটনার সময় নিখোঁজ বা প্রবাসে ছিলেন এমন বেশ কয়েকজনের নামও রয়েছে আদালতে দেওয়া কিছু অভিযোগপত্রে ।

তাঁরা মারা যাওয়ার , নিখোঁজ ও প্রবাসে থাকার বিষয়টি পুলিশ অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেনি । ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগপর্যন্ত ১১ মৃত ব্যক্তির নামে অভিযোগপত্র দাখিল ও সাজা হওয়ার ঘটনা ঘটে । যেমন রাজধানীর নিউমার্কেট থানার ১৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন মো . আবু তাহের দাইয়া । তাঁর মৃত্যুর চার বছর পর ২০২৩ সালের নভেম্বরে একটি রাজনৈতিক মামলায় তাঁকে ঢাকার একটি আদালত দেড় বছরের কারাদণ্ড দেন । তাঁর বিরুদ্ধে সাজা পরোয়ানাসহ গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করেন আদালত । অভিযোগপত্র ও মামলার নথিতে তাঁর মৃত্যুর বিষয়টি উল্লেখ করেনি পুলিশ । বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমন ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর বনানী থেকে নিখোঁজ হন । তেজগাঁও কলেজ ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম জাকির ২০১৫ সালের এপ্রিলে নিখোঁজ হন । তাঁদের বিরুদ্ধেও পুলিশ অভিযোগপত্ৰ দেয় । সেই অভিযোগপত্র ও সাক্ষ্যের ভিত্তিতে এ দুজনের সাজাও হয় । এসব ঘটনায় পুলিশের তদন্তপ্রক্রিয়া নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন ওঠে ।

ফৌজদারি অপরাধ বিশেষজ্ঞ এস এম শাহজাহান বলেন , এমন ঘটনায় পুলিশের তদন্ত কার্যক্রম নিয়ে সাধারণ মানুষের চরম আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে । ভুলক্রমে মৃত মানুষের নাম অভিযোগপত্রে উঠে আসা কেবল প্রশাসনিক ত্রুটি নয় , এটি তদন্তপ্রক্রিয়ার গভীর অব্যবস্থাপনার ইঙ্গিত । এদিকে জুলাই - আগস্টের হত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগে করা কিছু মামলায় মৃত ব্যক্তিদের আসামি করার অভিযোগ উঠেছে ।

পুলিশ জানায় , ফৌজদারি মামলায় নিষ্পত্তির আগে আসামির নাম প্রত্যাহারের সুযোগ নেই । তদন্ত শেষে অভিযোগপত্রে এমন ব্যক্তিদের অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করা যায় । আর অভিযোগপত্রে নাম থাকলে মামলা নিষ্পত্তি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে । এমন কোনো কোনো মামলার বাদী ভুল স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন । ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গাজীপুরের শ্রীপুরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে কলেজছাত্র আসীর ইনতিশারুল হক ( ২১ ) হত্যার ঘটনায় ওই বছরের ৬ অক্টোবর শ্রীপুর থানায় মামলা করেন তাঁর বাবা । ওই মামলায় অন্যদের সঙ্গে আবুল কালাম ওরফে কালা মিয়ার (৫৫) নামও আসামি হিসেবে দেওয়া হয় । তবে তিনি মামলা করার আগেই ২৫ সেপ্টেম্বর মারা যান । এ নিয়ে ক্ষোভ জানান মৃত কালামের ছেলে আলমগীর হোসেন ।

এ প্রসঙ্গে শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ( ওসি ) জয়নাল আবেদীন মণ্ডল বলেন , নাম দেওয়ার বিষয়টি একমাত্র বাদীর এখতিয়ার । বাদীর দেওয়া অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা রুজু হয় । মৃত ব্যক্তির নাম মামলায় থাকলে তদন্ত করে বাদ দেওয়া হবে । চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় একটি হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে ২০২১ সালের ১৮ মার্চ মারা যাওয়া চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের চকবাজারের সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর সায়িদ গোলাম হায়দার মিন্টুকে । ২০২৪ সালের ৪ আগস্টের একটি হত্যার অভিযোগে চলতি বছরের ২২ মার্চ এনামুল হক নামের এক ছাত্রপ্রতিনিধি বাদী হয়ে কক্সবাজার সদর মডেল থানায় একটি মামলা করেন । এই মামলার আসামির তালিকায় রয়েছে জাফর আলমের নাম । জাফর আলম মারা গেছেন বলে জানান তাঁর ছেলে সাইফুল ইসলাম ।

তিনি জানান , তাঁর বাবা জাফর আলম ঈদগাঁও উপজেলার ৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন । পুলিশের সূত্র জানায় , মামলায় মৃত , নিখোঁজ ও অনিবাসী ব্যক্তির নাম থাকলেও অভিযোগপত্রে যেন না থাকে সে জন্যই পুলিশ সদর দপ্তর এই উদ্যোগ নিয়েছে । পুলিশ সদর দপ্তরের একটি সূত্র জানায় , বড় ধরনের রাজনৈতিক সহিংসতার পর দ্রুত অভিযোগপত্র দেওয়ার চাপ থাকে তদন্ত কর্মকর্তাদের ওপর । এই তাড়াহুড়োয় যাচাই- বাছাইয়ের সুযোগ কম থাকে । এতে ‘ তালিকা - নির্ভর ' ও ' কপি - পেস্ট ' তথ্য ব্যবহার করা হয় । ফলে মৃত বা অনুপস্থিত ব্যক্তির নাম ঢুকে যায় অভিযোগপত্রে । সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা আজকের পত্রিকাকে বলেন , এই ভুলগুলোকে দুর্ঘটনা বলা যায় না । তদন্তে গাফিলতি বা অসততা আছে কি না , তা সদর দপ্তরের অভ্যন্তরীণ তদন্তে বের করা দরকার ।