মিয়ানমার থেকে আসছে ভয়ংকর মাদক হেরোইন তৈরির কাঁচামাল। বাংলাদেশকে রুট হিসেবে ব্যবহার করে তা চলে যাচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে। পরবর্তীতে ভারতের কারখানায় ‘হেরোইন’ উৎপন্ন হওয়ার পর ফের তা প্রবেশ করছে বাংলাদেশে। সম্প্রতি চাঞ্চল্যকর এ বিষয়টি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরকে অবহিত করেছে একটি আঞ্চলিক কার্যালয়। অন্যদিকে, হেরোইনের বীজের বিষয়টি নতুন করে দেশে উদ্বেগ ছড়িয়েছে। নানা কৌশলে শুল্ক কর্তৃপক্ষসহ নানা সংস্থার সদস্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে এসব বীজ দেশে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। একই সঙ্গে রোহিঙ্গা ক্যাম্প হয়ে ড্রাগ চোরাচালানের ঘটনাও ঘটছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাদক পাচার ঠেকাতে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে কঠোর নজরদারির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বীজ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি) চট্টগ্রাম বিভাগের উপ-পরিচালক হুমায়ুন কবীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জব্দকৃত পপি বীজ নিয়ে কাস্টমস বিভাগ কাজ করছে। আমাদের রাসায়নিক ইউনিটের পরীক্ষায় এগুলোর অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা পাওয়া যায়নি। জব্দকৃত বীজের নমুনা এরই মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয়েছে।
ডিএনসি সূত্র বলছে, রাজশাহী আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে আসা গোপনীয় এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা ও টেকনাফ হয়ে স্থল পথে পণ্যবাহী যানবাহন ব্যবহার করে আফিমের কাঁচামাল বড় পরিসরে রাজশাহীর সীমান্তবর্তী সুলতানগঞ্জ বন্দর হয়ে ভারতে যাচ্ছে। তৎকালীন উপ-পরিচালক জিল্লুর রহমান স্বাক্ষরিত ওই গোপনীয় প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশ মাদক উৎপাদনকারী দেশ নয়, কিন্তু বর্তমানে মাদকের করাল গ্রাসে আক্রান্ত। হেরোইন তৈরির প্রধানতম কাঁচামাল হচ্ছে আফিম। আগে আফগানিস্তান হতে অন্য দেশ হয়ে ভারতের সীমান্ত পেরিয়ে রাজশাহীর গোদাগাড়ী এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাগভাঙ্গা ও শিবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে হেরোইনের অনুপ্রবেশ ঘটত। কিন্তু জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমার বিশ্বে আফিম উৎপাদনে শীর্ষে অবস্থান করছে। গোয়েন্দা তথ্যানুযায়ী, মিয়ানমারের সীমান্ত দিয়ে বিশেষত পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা এবং টেকনাফ হয়ে স্থল পথে পণ্যবাহী যানবাহনে করে হেরোইনের কাঁচামাল আফিমের বৃহৎ চালান রাজশাহীর সীমান্তবর্তী উপজেলা গোদাগাড়ীর সুলতানগঞ্জ বন্দর দিয়ে অবৈধ পথে ভারতে যাচ্ছে। ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকায় গোপন ল্যাবে বা কারখানায় তা প্রক্রিয়াজাত করে হেরোইন হয়ে প্যাকেট আকারে পুনরায় বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। এ চক্রের সঙ্গে চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং রাজশাহীর কয়েকটি সিন্ডিকেট জড়িত।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, সম্প্রতি রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী থানার সুলতানগঞ্জ নদীবন্দর চালু হয়েছে, যার মাধ্যমে পণ্য আনা-নেওয়ার আড়ালে এই চোরাচালান কার্যক্রম চলমান। হেরোইন চোরাচালানের সিন্ডিকেটসহ নতুন এই কৌশলের বিষয়ে রাজশাহী বিভাগীয় গোয়েন্দা কার্যালয় তৎপর রয়েছে। গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, ২২ এপ্রিল হেরোইন চোরাচালান সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রক ও মাদক গডফাদার তারেককে গোদাগাড়ী হতে ৬.৫ কেজি হেরোইন ও নগদ অর্থ ১৩ লাখ টাকাসহ গ্রেপ্তার করা হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাদক উৎপাদনকারী দেশ না হয়েও ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশ মাদকের বড় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এশিয়ার গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল, গোল্ডেন ক্রিসেন্ট ও গোল্ডেন ওয়েজ নামে পরিচিত মাদক চোরাচালানের তিনটি প্রধান অঞ্চলের কেন্দ্রে বাংলাদেশের অবস্থান। তাই আন্তর্জাতিক মাদক কারবারিরাও বাংলাদেশকে ট্রানজিট হিসেবে সহজে ব্যবহার করছেন।
অনুসন্ধান এবং একাধিক সূত্র বলছে, পপি ফল থেকে সংগৃহীত আঠালো কষ, যা অর্ধ তরল অবস্থায় ড্রামে ভরে পাচার করছে মাদক মাফিয়ারা। মিায়ানমার থেকে আসা এসব অর্ধতরল পদার্থ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তাদের অনেকে বুঝতেই পারেন না সেগুলো ভয়ংকর ড্রাগস হেরোইনের কাঁচামাল। বান্দরবনের গহিন অরণ্যে চাষকৃত পপি থেকে সংগৃহীত আঠালো পদার্থের বিষয়টিও অনেক মাদক কর্মকর্তারা চিনতে পারেন না। ড্রাগস মাফিয়ারা এগুলোকে রাবার গাছ থেকে সংগৃহীত রাবার তৈরির কাঁচামাল বলে ধোঁকা দিয়ে আসছে। কেউ কেউ মাছের খাবার তৈরির উপকরণও বলছে। কারখানায় নেওয়ার পর হেরোইনের এই কাঁচামাল ‘এসিটিক এনহাইড্রেট’ এর মাধ্যমে বিক্রিয়া করে আফিম তৈরি করা হয়। এ সময় প্রচুর ধোঁয়া উৎপন্ন হয়। আরও বিশুদ্ধ হেরোইন পেতে ফের এসিটিক এনহাইড্রেট এর সংস্পর্শে নেওয়া হয়।
ডিএনসির সাবেক পরিচালক আবু তালেব এ প্রতিবেদককে বলেন, অন্তত চট্টগ্রাম বিভাগে কাজ করা বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত। যাতে তাদের মাদক ব্যবসায়ীরা ধোঁকা না দিতে পারে। নইলে পপি ফল থেকে সংগৃহীত কষকে নানাভাবে ফাঁকি দিতে পারে মাদক পাচারকারীরা। তিনি আরও বলেন, গত কয়েক বছর ধরে গহিন অরণ্যে বিজিবি এবং সেনা সদস্যরা একরের পর একর পপি খেত ধ্বংস করছে। অনেক এলাকা এতটাই দুর্গম যে সেখানে পৌঁছাও সম্ভব হয় না। উৎপাদিত পপিও কিন্তু আতংকের বিষয় আমাদের জন্য। তবে পপি বীজ থেকে কোনো ফরমেটেই মাদক তৈরি সম্ভব নয় বলছেন তিনি।
এদিকে পাখির খাদ্য ঘোষণা দিয়ে পাকিস্তান থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে আসা দুই কনটেইনারে আমদানি নিষিদ্ধ পপি বীজ অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা আছে কি না- তা নিয়ে চলছে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ। চট্টগ্রামের কোরবানিগঞ্জের মেসার্স আদিব ট্রেডিং এ চালানটি আমদানি করে। আমদানি নথিতে ৩২ টন পাখির খাদ্য আমদানির তথ্য ছিল। গত ৯ অক্টোবর দুই কনটেইনারের চালানটি চট্টগ্রাম বন্দরে নামানো হয়। এরপর খালাসের জন্য বেসরকারি ডিপো ছাবের আহম্মেদ টিম্বার কোম্পানি লিমিটেডে নেওয়া হয়।
ডিএনসির অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমার থেকে স্থল ও নৌপথে মোট ৬৬টি পয়েন্ট ব্যবহার করে বিপজ্জনক মাদকজাতীয় দ্রব্য বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। দেশের ২৭১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের সীমান্তের উল্লেখযোগ্য অংশ অরক্ষিত থাকায় পাচারকারীরা দীর্ঘদিন ধরে তা কাজে লাগাচ্ছে এবং এ কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, ডিএনসির পাঠানো গোপন প্রতিবেদন অনুযায়ী রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ও সীমান্ত এলাকায় সীমান্তরক্ষী বাহিনী, পুলিশ ও অন্যান্য সংস্থার মধ্যে সমন্বয় বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ক্যাম্পে কর্মরত সংস্থাগুলোর কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার কথা বলা হয়েছে।