‘আমরা আপনার বাবার ভোটার’- কথাটি শুনেই চমকে উঠলেন খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির। সিলেট-১ আসনে বিএনপি’র প্রার্থী। চমকে ওঠারই কথা। এখনো ভোটের মাঠে আছে তার পিতা খন্দকার আব্দুল মালিকের নাম। পিতার সূত্র ধরেই তাকে অনেকে চেনেন। সাদরে গ্রহণ করছেন। সিলেট সদর উপজেলার একটি মেঠোপথ ধরে হাঁটছিলেন। যাচ্ছিলেন একটি নির্বাচনী মতবিনিময় সভায়। পথিমধ্যে তাকে দেখে দৌড়ে এসে হাত মেলান কয়েকজন বৃদ্ধ। পিতার কথা বলতেই চোখ তুলে তাকান মুক্তাদির। বললেন, ‘আমাকেও পার করতে হবে।’ খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির ভোটের মাঠে প্রায়ই এ কথা শোনেন। সবচেয়ে বেশি শুনেছেন ২০১৮ সালের নির্বাচনে। তখন পরিস্থিতি জটিল। কোনো কিছুই অনুকূলে নয়। তবে আশা জিইয়ে রেখেছিলেন ভোটাররা। ওই নির্বাচনে খন্দকার মুক্তাদির আওয়ামী লীগের প্রার্থীর শত বাধার মুখেও নির্বাচনী প্রচারণা চালান। প্রশাসনের ভয়ে সঙ্গে থাকতে পারেননি নেতাকর্মীরা। তবুও তিনি ছিলেন অবিচল। হেঁটেছেন একা একা। সিলেট সদর ও সিটি করপোরেশনের অনেক জায়গা যখন গিয়েছিলেন, তখন মানুষ তাকে সাদরে বরণ করেছিলেন। ‘খন্দকার সাহেবের’ ছেলে বলে সম্বোধন করেছিলেন। বিশেষ করে মুরুব্বিরা তাকে আগলে রাখেন। আর করবেনই না কেন? খন্দকার আব্দুল মালিক তো ছিলেন সিলেটের মাটি ও মানুষের নেতা। সিলেটে বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তিনি। নিজের সবকিছু উজাড় করে দিয়েছিলেন দলের জন্য। এক সময় সিলেট বিএনপি’র একক নেতাও ছিলেন তিনি। দলের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। দলের দুঃসময়েও কাণ্ডারি হয়ে কাজ করেছেন। বিশেষ করে তৎকালীন সদর উপজেলার মানুষের মধ্যমণি ছিলেন খন্দকার আব্দুল মালিক। তার বদৌলতেই সিলেট সদর উপজেলা হয়ে উঠেছিল বিএনপি’র অন্যতম শক্তিশালী ভোট ব্যাংক। যেটি এখন পর্যন্ত বজায় রয়েছে। গ্রামের সহজ-সরল মানুষের কাছে খন্দকার আব্দুল মালিক এখনো উন্নয়নের ‘আইডল’।
পরবর্তীতে খন্দকার আব্দুল মালিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সন্তানরা ছিলেন সদর উপজেলার মানুষের কাছাকাছি। ফলে ভোটের মাঠে মুক্তাদিরকে পেয়ে তারা খুশিও। ২০১৮ সালের নির্বাচনে সদর উপজেলা নিয়ে ভয় ছিল আওয়ামী লীগ প্রার্থীর। এ কারণে রাতে ভোট করতে প্রশাসনকে নিয়ে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছিল। তবুও মাত্র দুই ঘণ্টার ভোটে মুক্তাদিরের বাক্সে ধানের শীষের ভোটে টুইটম্বুর হয়ে পড়ে। ভোটারের উপস্থিতি দেখে ভড়কে যান আওয়ামী লীগ প্রার্থী। পরে প্রশাসনকে ব্যবহার করে মুক্তাদিরকে ভোটের মাঠ থেকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। একেক করে মুক্তাদিরের সঙ্গে থাকা নেতাকর্মীদের আটক করা হয়। ২০১৮ সাল থেকে ২০২৫ সাল। অনেক পরিবর্তন। আওয়ামী লীগ পলাতক। মুক্তাদির ভোটের মাঠে। তিনি হচ্ছেন মর্যাদাপূর্ণ এ আসনের বিএনপি’র প্রার্থী। প্রথম থেকেই ভোটাররা তাকে প্রার্থী ধরেই মাঠে সক্রিয় ছিলেন। দলের তরফ থেকে নাম ঘোষণার পর এখন দ্বিগুণ গতিতে প্রচারণা শুরু করা হয়েছে। ভোটে সরগরম সিলেটের নগর ও গ্রামীণ জনপদ। সিলেট-১ আসনে মুক্তাদিরেই সব ফোকাস। তিনি বসে নেই। অনেক এলাকা এখনো প্রত্যন্ত। হাঁটার রাস্তা। সেসব এলাকায় ছুটে যাচ্ছেন মুক্তাদির। বিশেষ করে তরুণ সমাজ ও শিক্ষার্থীদের দিকে তার নজর বেশি। এর পরেই তার নজর গ্রামীণ জনপদের উন্নয়নে। সিলেট সিটি করপোরেশনের পাশে সদর উপজেলার অবস্থান। নগরে নতুন করে ১৫টি ওয়ার্ড হলেও সেগুলোতে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। সমস্যার অন্ত নেই এসব এলাকায়। সেটি ভালো করেই জানেন মুক্তাদির। এ কারণে তিনি ছুটে যাচ্ছেন বঞ্চনার শিকার হওয়া মানুষের কাছাকাছি। এতে তিনি পাচ্ছেন ব্যাপক সাড়া। তবে তিনি শুধু যে ভোটের জন্যই যাচ্ছেন তা নয়, এখন তার যাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে সমস্যাবলী চিহ্নিত করা।
পরিকল্পিত উন্নয়ন হয়নি এসব এলাকায়। এখনো রয়েছে অনেক মাটির সড়ক। সেসব পথেই তিনি হাঁটছেন। শিক্ষায় নজর তার। গ্রামীণ এলাকায় যেখানেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পাচ্ছেন সেখানেই ঢুঁ মারছেন। হোক সেটি স্কুল কিংবা মাদ্রাসা। উন্নয়ন ঘটাতে হবে। কিন্তু মুখে বলছেন না। কী করতে হবে সেটি নোটে রাখছেন। নগরের পাড়া-মহল্লায় ছুটছেন। উঠান বৈঠক করছেন। এতদিন দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে বৈঠক করেছেন। প্রার্থী ঘোষণার পর এখন হচ্ছে জনগণের সঙ্গে মতবিনিময়। নগরেও তরুণ ভোটারে নজর তার। জালালাবাদ গ্যাস অডিটোরিয়ামে ইতিমধ্যে তরুণ ভোটারদের নিয়ে বৈঠক করেছেন। তাদের সঙ্গে মিশেছেন। কথা শুনেছেন। তাদের চোখে থাকা আগামী সিলেটের পরিকল্পনা কী সেটিও অবগত হয়েছেন। পেশাজীবী সহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে বসছেন। সিলেট বিএনপি তার পক্ষে একাট্টা। দলের ভেতরে বিরোধ নেই। সবাই ধানের শীষের বিজয়ে ঐক্যবদ্ধ। এটা হচ্ছে মুক্তাদিরের প্লাস পয়েন্ট। সিলেট-১ আসনে এমপি ছিলেন খন্দকার আব্দুল মালিক। এরপর একেক করে এমপি হয়েছেন প্রয়াত স্পিকার হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী, সাবেক অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী এম সাইফুর রহমান, সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। মুক্তাদিরের সঙ্গে রাতের ভোটে জয়ী হয়েছিলেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। সবাই ভিআইপি প্রার্থী ছিলেন। তাদের দেখা স্বপ্নেই সিলেট এখন উন্নত জনপদ। প্রবাসী শহর হিসেবে অনেক এগিয়েছে সিলেট। প্রয়াত স্পিকার ১৯৯৬ সালে সিলেটের যে উন্নয়ন কাজ শুরু করেছিলেন, সেটি সমাপ্ত হয়েছে সাবেক অর্থমন্ত্রী মুহিতের হাত ধরে। এরপর সিলেটের উন্নয়নে নতুন করে উন্নয়নের কোনো রূপরেখা হয়নি। এবার মুক্তাদিরের কণ্ঠে সেই সুর। ভোটের দিকে নজরের চেয়ে উন্নয়ন পরিকল্পনার দিকে নজর বেশি। ইতিমধ্যে কেমন সিলেট চাই প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন ভোটারের কাছে। জানতে চান- সিলেটকে নিয়ে মানুষের ভাবনা। এ প্রশ্নের উত্তর জানতে নগর জুড়ে সাঁটিয়েছেন ফেস্টুন। অনলাইনে প্রশ্ন দেয়ার প্রস্তুতি চলছে। খন্দকার মুক্তাদির নিজেও বলেছেন, পরিবর্তন করতে হবে। সিলেটের তরুণরা কী চায়, কেমন সিলেট তাদের স্বপ্ন- এসব জানতে যেমন আগ্রহী তেমনি গ্রামের কৃষকের উন্নয়ন ভাবনা জানতে তিনি মাঠে রয়েছেন। আর জনগণের ভাবনা থেকেই পরিকল্পিত সিলেট গড়া হবে তার অঙ্গীকার।