বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের বিদেশে পুঁজি বিনিয়োগের স্থিতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫ কোটি ১৪ লাখ ডলার। স্থানীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ৪২৮৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে গত অর্থবছরে নতুন পুঁজি বিনিয়োগ ৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার। আলোচ্য বিনিয়োগের মধ্যে দেশ থেকে নগদ পুঁজি হিসাবে গেছে ১ কোটি ৬৪ লাখ ডলার। এছাড়া উদ্যোক্তাদের কোম্পানিগুলো বিদেশে ব্যবসা থেকে অর্জিত মুনাফা পুনরায় বিনিয়োগ করেছে ৩ কোটি ২০ লাখ ডলার। ওই সময়ে এক কোম্পানি অন্য কোম্পানি থেকে ঋণ নিয়ে কোনো পুঁজি বিনিয়োগ করেনি। উলটো আগের নেওয়া ঋণের মধ্যে ১ কোটি ৩৪ লাখ ডলার পরিশোধ করেছে। বাংলাদেশের কোম্পানিগুলো এখন পর্যন্ত বিশ্বের ১৮টির বেশি দেশে বিনিয়োগ করেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে যেসব পুঁজি বিদেশে বিনিয়োগ করা হয়েছে তার ভিত্তিতে এ হিসাব করা হয়েছে। অর্থাৎ দেশ থেকে বিদেশে নেওয়া বৈধ পুঁজির হিসাব এটি। এর বাইরে অবৈধভাবে বা অর্থ পাচার করে আরও অনেক পুঁজি বিদেশে বিনিয়োগ করা হয়েছে। যার হিসাব এর মধ্যে নেই।
প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের কোম্পানিগুলোর বিদেশে বিনিয়োগ করা পুঁজির স্থিতি ছিল ৩৩ কোটি ৭৩ লাখ ডলার। গত অর্থবছরে তা সামান্য বেড়ে ৩৫ কোটি ১৪ লাখ ডলারে দাঁড়িয়েছে। এক বছরের ব্যবধানে স্থিতি বেড়েছে ১ কোটি ৪১ লাখ ডলার বা ৪ দশমিক ১৯ শতাংশ। এর আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পুঁজির স্থিতি কমেছিল ৪ দশমিক ৮১ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, দেশে বেকারত্বের হার বাড়ছে। কর্মক্ষম জনশক্তি দেশে চাকরি পাচ্ছে না। জিডিপির প্রবৃদ্ধি নিম্নমুখী। যে কারণে বিদেশে পুঁজি না নিয়ে দেশে বিনিয়োগ করলে অর্থনীতি যেমন বেশিমাত্রায় লাভবান হবে, তেমনি জিডিপি, কর্মসংস্থান বাড়বে, কমবে বেকারত্ব। দেশ থেকে পুঁজি নিয়ে বিদেশে বিনিয়োগ করার সুযোগটি পুনর্বিবেচনার প্রস্তাব অর্থনীতিবিদদের।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সম্প্রতি বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর বিভিন্ন কোম্পানির বিদেশে বিনিয়োগের প্রবণতা বেড়েছে। বিপরীতে বাংলাদেশ বিদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে খুব সাবধানে এগিয়ে চলেছে। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে সরকার ১৯৪৭ সালের আইন সংশোধন করে একটি শর্তসাপেক্ষ বিধান যুক্ত করে। যার মাধ্যমে রপ্তানি সম্পর্কিত উদ্যোগের জন্য দেশ থেকে পুঁজি নিয়ে বিদেশে বিনিয়োগ করার সুযোগ তৈরি হয়। এক্ষেত্রে কেবল রপ্তানিকারকরাই বা বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেন এমন কোম্পানিগুলোই বিদেশে বিনিয়োগ করতে পারবে। বিনিয়োগের আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অনুমোদন নিতে হবে। এরপর থেকে বাংলাদেশি কোম্পানিগুলোর বিদেশে বিনিয়োগ বাড়ছে। এখন পর্যন্ত দেশের কোম্পানিগুলো ১৮টির বেশি দেশে বিনিয়োগ করেছে।
প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিদেশে বিনিয়োগ ২ দশমিক ৭৮ শতাংশ কমেছিল। ওই বছর দেশ থেকে নগদ পুঁজি হিসাবে নেওয়া হয়েছিল ১ কোটি ৯৮ লাখ ডলার। বিদেশে কোম্পানিগুলোর অর্জিত মুনাফা থেকে বিনিয়োগ করা হয়েছিল ১ কোটি ২০ লাখ ডলার। এক কোম্পানি থেকে অন্য কোম্পানির আগের নেওয়া ঋণ পরিশোধ করেছিল ৩ কোটি ৪৬ লাখ ডলার। বেশি ঋণ পরিশোধ করার কারণে ওই বছর বিনিয়োগ কমে গিয়েছিল। গত অর্থবছর বিনিয়োগ করা হয়েছে ৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এর মধ্যে পুঁজি হিসাবে নেওয়া হয়েছে ১ কোটি ৬৪ লাখ ডলার, অর্জিত মুনাফা বিনিয়োগ করা হয়েছে ৩ কোটি ২০ লাখ ডলার এবং আগের নেওয়া ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে ১ কোটি ৩৪ লাখ ডলার। আগের অর্থবছরের তুলনায় গত অর্থবছরে পুঁজি বিনিয়োগ বেড়েছে ৩ কোটি ৭৮ লাখ ডলার। আলোচ্য সময়ে দেশ থেকে নিট পুঁজি নেওয়া কমেছে ১৭ দশমিক ১০ শতাংশ। মুনাফা বিনিয়োগ বেড়েছে ১৬৭ দশমিক ৪০ শতাংশ।
গত অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে নেওয়া পুঁজির মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করা হয়েছে ভারতে ২ কোটি ৪৪ লাখ ডলার। দ্বিতীয় সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১ কোটি ৬৯ লাখ ডলার, তৃতীয় সিঙ্গাপুরে ২১ লাখ ডলার। কেনিয়ায় ১৪ লাখ ডলার এবং আয়ারল্যান্ডে ১৫ লাখ ডলার। আলোচ্য সময়ে বিদেশ থেকে দেশে এসেছে ৪ কোটি ৩৩ লাখ ডলার। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি এসেছে ভারত থেকে ৮৩ লাখ ডলার।
সবচেয়ে বেশি পুঁজি নেওয়া হয়েছে বিদেশি আর্থিক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে। পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি মুনাফাও এসেছে এ খাত থেকে। ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোতে নেওয়া হয়েছে ৬ কোটি ৫০ লাখ ডলার, মুনাফা এসেছে ৩ কোটি ৪৩ লাখ ডলার। এ খাতে নিট পুঁজি নেওয়া হয়েছে ২ কোটি ৯৭ লাখ ডলার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পুঁজি নেওয়া হয়েছে খনিজ খাতে ১ কোটি ২ লাখ ডলার। ফিরিয়ে আনা হয়েছে ৬৫ লাখ ডলার, নিট পুঁজি নেওয়া হয় ৩৭ লাখ ডলার। তৃতীয় সর্বোচ্চ পুঁজি নেওয়া হয় ওষুধ ও রসায়ন খাতে ২৯ লাখ ডলার, ফিরিয়ে আনা হয় ১৯ লাখ ডলার, নিট পুঁজি নেওয়া হয় ১০ লাখ ডলার।
দেশ থেকে এখন পর্যন্ত বিদেশে নেওয়া পুঁজির স্থিতির মধ্যে সবচেয়ে বেশি আছে যুক্তরাজ্যে ১০ কোটি ৭৫ লাখ ডলার, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভারতে ১০ কোটি ৫৪ লাখ ডলার, তৃতীয় সর্বোচ্চ হংকংয়ে ৬ কোটি ৮৭ লাখ ডলার। সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৫ কোটি ৮৫ লাখ ডলার, মালয়েশিয়ায় ১ কোটি ১৫ লাখ ডলার, কেনিয়ায় ৭৬ লাখ ডলার, সিঙ্গাপুরে ৬৪ লাখ ডলার, ওমানে ৩৯ লাখ ডলার, আয়ারল্যান্ডে ৩৮ লাখ ডলার, ইথিওপিয়ায় ১৯ লাখ ডলার, মালদ্বীপে ১২ লাখ ডলার, সাউথ আফ্রিকায় ৮ লাখ ডলার, গ্রিসে ৩ লাখ ডলার। যুক্তরাষ্ট্রে আর্থিক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে ৫২ লাখ ডলার পুঁজি নেওয়া হয়। এর বিপরীতে মুনাফা বাবদ ফেরত আসে ২ কোটি ৯৮ লাখ ডলার।