Image description

প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু বাংলাদেশ সচিবালয়ে এখনও রয়েছে নানামুখী অসন্তোষ। রয়েছে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য। দানা বাঁধছে নতুন পে-স্কেলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে বেতন বৈষম্য কমানোর দাবি। অপরদিকে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নতুন করে মাঠ প্রশাসন সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। দেশে নির্বাচনি হাওয়া বইছে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা প্রশাসনের। কিন্তু বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সেই প্রশাসন কতটা প্রস্তুত? জনমনে এই প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে।

সূত্র জানিয়েছে, প্রশাসনে এক ধরনের স্থবিরতা চলছে। রয়েছে সমন্বয়ের অভাব। পদোন্নতি, ক্যাডার বৈষম্য, মহার্ঘ ভাতাসহ নতুন পে-স্কেলের বৈষম্য কমানোর দাবি জোরদার হচ্ছে। এর বাইরেও সচিবালয়ের কর্মচারীরা সোচ্চার নিজেদের আরও বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে। এর মধ্যে চলছে বাধ্যতামূলক অবসর ও ওএসডি কার্যক্রম। সচিবালয়ে এখনও চলছে ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ শনাক্তের অঘোষিত কার্যক্রম। সচিব বা সিনিয়র সচিব নিয়োগ পাওয়ার পরও বাধার মুখে যোগদান করতে পারছেন না অনেকে।

এসব নিয়ে প্রশাসনে সৃষ্টি হয়েছে চাপা ক্ষোভ ও উত্তেজনা। এই উত্তেজনাকে বাড়িয়ে দিয়েছে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি। এর ফলে সরকারি কাজ-কর্মে স্থবিরতা নেমে এসেছে। এর মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা কতটা সম্ভব, সেই প্রশ্ন রয়েছে।

এদিকে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি মানুষকে নাজেহাল করে তুলছে। অর্থনৈতিক সংকট বাড়ছে। আইনশৃঙ্খলাবাহিনীসহ প্রশাসনকে পুরোপুরি কার্যকর করা যায়নি। ফলে জনজীবনে নিরাপত্তাহীনতা উদ্বেগজনক অবস্থায় রয়েছে। এরপর দেশের বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও নারী নির্যাতনের ঘটনা এই উদ্বেগের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্ষমতা নেওয়ার পর মব ভায়োর‌্যান্সসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণকে ঘিরেই বেশি সমালোচনা ও প্রশ্নের সম্মুখীন হতে দেখা গেছে অন্তর্বর্তী সরকারকে। এসবের জবাবে সরকার কেবল হামলার ঘটনায় নিন্দা প্রকাশ এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েই দায় সারছে বলে সমালোচনা করছেন অনেকে। মব ভায়োল্যান্স বন্ধ করার জন্য যে ধরনের সদিচ্ছা থাকা দরকার, সরকারের কর্মকাণ্ডে সেসব উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ করছেন কেউ কেউ। জবাবে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বিভিন্ন সময় তার ভাষণে বলছেন, মবের বিরুদ্ধে তার সরকারের 'জিরো টলারেন্স' নীতি রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এর কোনও দৃষ্টান্ত দৃশ্যমান হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনি পরিবেশ সৃষ্টি করা বর্তমান সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রশাসন ক্যাডারের উপসচিব পদোন্নতির সুপারিশ নিয়ে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের আপত্তি রয়েছে। প্রশাসন ক্যাডার বাদ দিয়ে বাকি ২৫ ক্যাডার কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের পক্ষ থেকে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের ‘অস্পষ্ট রিপোর্ট ও জনবিরোধী’ প্রস্তাবগুলো প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। ’ক্যাডার যার মন্ত্রণালয় তার’ স্লোগানে ডিএস পুলে কোটা বাতিল এবং সব ক্যাডারের সমতার দাবি জানানো হয়েছে। ‘সংস্কার বা পুনর্গঠন প্রস্তাব’ না থাকায় বিসিএস (পরিবার পরিকল্পনা) সাধারণ ক্যাডার সংশ্লিষ্ট বিবৃতিসহ বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (পরিবার পরিকল্পনা) অ্যাসোসিয়েশন ৫ দফা দাবি জানিয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীদের ৩ দফা রয়েছে। এছাড়া প্রশাসনের প্রথম থেকে দশম গ্রেডের কর্মকর্তারা ২০ শতাংশ এবং ১১তম থেকে ২০তম গ্রেডের কর্মচারীরা ৩০ শতাংশ হারে মহার্ঘ ভাতার দাবি জানিয়েছেন। এসব নিয়ে প্রশাসনে চলছে চরম অসন্তোষ ও অস্থিরতা।

বিসিএস (পরিসংখ্যান) ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশন, বিসিএস (তথ্য-সাধারণ) ক্যাডার কর্মকর্তাদের সংগঠন বিসিএস ইনফরমেশন অ্যাসোসিয়েশন সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে নিজ নিজ সংগঠনের অসন্তোষের কথা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে।

এছাড়াও নির্বাচনে বড় ভূমিকা রাখা বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষকরা তাদের নানা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনে যুক্ত রয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে তাদের নির্বাচনি কাজে যুক্ত করা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে ‘মব’ কালচার, হত্যা, চাঁদাবাজি, ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে জনমনে ভয় ও শঙ্কা রয়েই গেছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন অনেকে।

এদিকে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নতুন করে মাঠ প্রশাসন সাজানোর উদ্যোগের অংশ হিসেবে উপসচিবদের মধ্য থেকে জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদে পদায়নের জন্য নতুন তালিকা তৈরি করছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলা প্রশাসক পদে পদায়নের জন্য ২৯ অক্টোবর ১০ জন উপসচিবের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। গত ৩০ অক্টোবর ২০ জন উপসচিবের সাক্ষাৎ নেওয়া হয়েছে। আর ৩১ অক্টোবর (শুক্রবার) সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও নেওয়া হয়েছে আরও ১০ জনের সাক্ষাৎকার। যে ৪০ জনের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে তাদের বেশিরভাগই বিসিএস ২৯তম ব্যাচের কর্মকর্তা। এদের মধ্য থেকে যারা ডিসি পদে নিযুক্ত হবেন তারাই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা করবেন।

জানা গেছে, গত ২৯ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে নির্বাচনি প্রস্তুতি-সংক্রান্ত বৈঠক করেছেন। ওই বৈঠকে সবচেয়ে ‘ফিট’ কর্মকর্তাকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় ডিসি পদে পদায়ন করা হবে বলে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন তিনি। নিজ জেলা বা শ্বশুরবাড়ির এলাকায় কাউকে পদায়ন করা হবে না। তাদের কোনও আত্মীয়স্বজন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন কিনা পদায়নের ক্ষেত্রে সে বিষয়টিও লক্ষ রাখা হবে। গত ১ নভেম্বর থেকে এ কার্যক্রম শুরু হয়েছে বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।

ডিসি, এডিসি, ইউএনওসহ বিচারিক দায়িত্বে এমন কাউকে পদায়ন করা হবে না, যিনি গত তিনটি নির্বাচনি কাজে যুক্ত ছিলেন। আগের তিন নির্বাচনে ন্যূনতম ভূমিকা থাকলেও তাকে এই নির্বাচনে দায়িত্বে রাখা হবে না। পদায়নের ক্ষেত্রে কর্মকর্তার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা, শারীরিক যোগ্যতা, কর্মদক্ষতা, গণমাধ্যমে অনিয়মের প্রতিবেদন হয়েছে কিনা, তা দেখা হবে বলেও জানিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার দফতর।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব জানিয়েছেন, ৬৪ জেলায় ডিসি নিয়োগ করা যায়, এমন একটি ফিট লিস্ট ইতোমধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের হাতে আছে। এরপরও সরকারের শীর্ষপর্যায় থেকে আরও কর্মকর্তাদের বাছাই করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যাতে নিরপেক্ষতা ও দক্ষতা নিশ্চিত করার জন্য সরকারের হাতে বেশি অপশন থাকে। সে অনুযায়ী নতুন ‘ফিট লিস্ট’ তৈরি করা হচ্ছে। চলতি নভেম্বরের মধ্যেই অধিকাংশ ডিসি পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

এ প্রসঙ্গে একজন সাবেক ক্যাবিনেট সচিব বলেন, ‘প্রশাসনে কোনও ধরনের রাজনৈতিক ইন্ধন থাকা উচিত নয়। একটি সুন্দর নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত প্রশাসন দরকার। এটি ঠিক করা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।’

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. এহছানুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘একটা সুন্দর নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে দক্ষ প্রশাসনের কোনও বিকল্প নাই। আমরা সেই প্রচেষ্টাই করছি। শুধু ডিসি নয়, একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে সরকার পুরো প্রশাসন ঢেলে সাজানোর কাজে যুক্ত হয়েছে।’

এদিকে, বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম মাঠ পর্যায়ে নির্বাচনি প্রশিক্ষণ কার্যক্রম সরেজমিন পরিদর্শনের জন্য গত রবিবার (২ নভেম্বর) রাজশাহী ও বগুড়া সফর করেছেন। তিনি সেখানে নির্বাচনি প্রশিক্ষণ কর্মশালায় প্রশিক্ষণার্থী পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন এবং প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেন।

এ সময় আইজিপি বলেন, ‘আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ পুলিশ সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে।’