Image description

গাজীপুরে একের পর এক রিসোর্ট ও বাগানবাড়ির সন্ধান মিলছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানা পরিবারের সদস্যদের। বিভিন্ন সময়ে কেনা এসব রিসোর্ট ও বাগানবাড়ি করা হয় অবসর সময় কাটানোর জন্য। সরকার পতনের পর কয়েকটি রিসোর্ট ও বাগানবাড়িতে বিক্ষুব্ধ মানুষের হামলার ঘটনাও ঘটে। যুক্তরাজ্যে রেহানাকন্যা টিউলিপের বিরুদ্ধে অনৈতিক সুবিধা নেয়ার অভিযোগ ওঠা এবং তার পদত্যাগের পর দেশেও রেহানা পরিবারের সদস্যদের সম্পদের খোঁজ করছে দুর্নীতি দমন কমিশন। প্রাথমিক অনুসন্ধানে বিপুল পরিমাণ সম্পদের তথ্য মিলেছে। 

গাজীপুর মহানগরীর কানাইয়া। জয়দেবপুর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এলাকাটি। কাঁচা-পাকা রাস্তা আর সারি সারি গাছপালা। অনেকটা সবুজে ঘেরা এই কানাইয়ায় গড়ে উঠেছে শেখ হাসিনার ভাগ্নি ও সদ্য পদত্যাগ করা বৃটিশমন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিকের নামে একটি বাগানবাড়ি। প্রায় ৩৫ বিঘার ওপর নির্মিত বাগানবাড়িতে কী নেই! বাংলো, পুকুর, হরেক রকমের ফুল ও ফলের গাছ। এর নামকরণও করা হয়েছে টিউলিপের নামে ‘টিউলিপ’স টেরিটরি’। 

সরজমিন ঘুরে জানা যায়, শুধু টিউলিপ সিদ্দিকের নামে বাগানবাড়ি নয়, গাজীপুরের বিভিন্ন স্থানে দেড়শ’ কোটি টাকারও বেশি মূল্যের সম্পদ রয়েছে শেখ রেহানা পরিবারের। বাংলো, পুকুর আর সবুজে ঘেরা এসব বাগানবাড়ি নির্মাণ করে রাখা হয়েছে শুধুমাত্র নিজেদের একান্ত সময় কাটানোর জন্য। 
বাগানবাড়ির দায়িত্বরতদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শেখ হাসিনার পতনের পর কেউই আসেননি টিউিলিপ’স টেরিটরিতে। তারা আরও জানান, শেখ রেহানার স্বামী শফিক সিদ্দিক এ বাগানবাড়ি তত্ত্বাবধান করেন। দায়িত্বে থাকা নিরাপত্তারক্ষী ও মালিকদের বেতন-ভাতাও তিনি পরিশোধ করেন। 
সরজমিনে আরও জানা যায়, টিউলিপ’স টেরিটরির দায়িত্বে রয়েছেন একজন নিরাপত্তারক্ষী আর দু’জন মালি। রোববার সেখানে গিয়ে নিরাপত্তারক্ষী আবদুর রহিম ও মালি নজরুল ভূঁইয়ার দেখা মেলে। 

নজরুল ভূঁইয়া জানান, তিন বছর ধরে টিউলিপ’স টেরিটরির মালির দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বলেন, এই বাগানবাড়ির মালিক শফিক সিদ্দিক। স্যার এখানে আসেন না। আগে পরিবারের সদস্যরা সবাই আসতেন আবার চলে যেতেন। ৫ই আগস্টের পর তারা আর কেউ আসেনিন। 
বেতন কীভাবে পান জানতে চাইলে নজরুল বলেন, বেতন আগেও স্যার পাঠিয়ে দিতেন এখনো ওভাবেই দেন। 

বাগানবাড়িটির দায়িত্বে থাকা আবদুর রহিম মানবজমিনকে বলেন, আমি পাঁচ বছর ধরে এখানে থাকি। গণ্ডগোলের পর থেকে কেউ আসেনি। ৫ই আগস্ট কারা যেন এসে দুটো বাংলো ভাঙচুর করে। গ্লাস ভেঙে গুঁড়ো করে দিয়ে গেছে। ভেতরে আসবাবপত্র ছিল লুটপাট করছে। আমরা তো নিরীহ মানুষ কাউকে কিছু বলতে পারিনি। 

কানাইয়া এলাকার স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের আগেও এই বাগানবাড়ি ঘিরে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল। বাইরে থেকে পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা নিরাপত্তা দিতেন। এ ছাড়া যেদিন শেখ রেহানা পরিবারের সদস্যরা বেড়াতে আসতেন সরকারি নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হতো। 

স্থানীয় বাসিন্দা ওয়াদুদ হোসেন মানবজমিনকে বলেন, এখানে বাগানটা ১৭ থেকে ১৮ বছর ধরে দেখছি। শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানাদের। এলাকার মানুষের কাছ থেকে জমি কিনে কিনে বিশাল বাগানবাড়ি বানিয়েছে। যারা কাজকর্ম করতো তাদের কাছে শুনেছি পার্কের মতো সুন্দর করে সাজানো। আমরা লোকাল মানুষ কখনো ঢুকতে পারিনি। 

আবদুস সোবহান নামে এক বাসিন্দা বলেন, এই জায়গা আনুমানিক ৩৫ বিঘার ওপর আছে। 

কানাইয়ার বাসিন্দা হাফিজ উদ্দিন বলেন, আমরা গরিব মানুষ। কথা বললে যদি কোনো বিপদ হয়। এই বাগানবাড়ি শেখ রেহানার মেয়েদের নামে বানানো। আসল মালিক তার স্বামী শফিক সিদ্দিক। 

এদিকে গাজীপুর মহানগরীর বাঙালগাছ এলাকায় ২৫ বিঘা জমির ওপর বাগানবিলাস, ২৩ বিঘা জমির ওপর ফাওকাল বাগানবাড়ি, ১৫ থেকে ১৬ বিঘা জমির ওপর কালিয়াকৈরে মৌচাকের বাগানবাড়ির তথ্য পেয়েছে দুদকের অনুসন্ধান দল। সূত্র জানায়, স্থানীয়রা এগুলো শেখ রেহানার বাগানবাড়ি বলেন জানতেন, তবে  এগুলোর মালিকানায় রয়েছেন তার স্বামী শফিক আহমেদ সিদ্দিক, দেবর তারিক আহমেদ সিদ্দিক ও তাদের নিকট আত্মীয়-স্বজনের।
দুদকের তথ্য অনুযায়ী, গাজীপুর মহানগরীর ফাওকাল এলাকায় বাংলাদেশ সমরাস্ত্র ও টাকশালের পাশেই ২৩ বিঘা জমি নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে একটি বাগানবাড়ি। বড় সীমানা প্রাচীরে ঘেরা, ভেতরে নান্দনিক ডুপ্লেক্স বাড়ি রয়েছে সেখানে। ২০১২ সালে সনাতন ধর্মাবলম্বী স্থানীয় অনিল ও অক্ষয়দের থেকে কিনে এই বাংলো তৈরি করা হয়। ৩৫ লাখ টাকা বিঘা মূল্য ১৪ বিঘা জমি ক্রয় করা হয় এবং কাগজপত্রে সমস্যা থাকায় ৮ বিঘার কোনো দাম দেয়া হয়নি। বর্তমানে সেখানকার বিঘা প্রতি জমির মূল্য আড়াই কোটি টাকা। জমিটি স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যবসায়ী স্বপনের মধ্যস্থতায় কেনেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও শেখ রেহানার দেবর তারিক সিদ্দিক।

মহানগরীর বাঙালগাছ এলাকায় প্রায় ২৫ বিঘা জমিতে নির্মাণ করা হয়েছে আরেকটি বাংলো বাড়ি। এর নামকরণ করা হয়েছে ‘বাগান বিলাস’। কয়েকশ’ গাছ নিয়ে বাংলোর ভেতরে চমৎকার পরিবেশ। অবকাশ যাপনের জন্য আছে তিন রুমের একটি দোচালা ঘর। পাশেই ছোট আরেকটি ঘর। সামনে বড় পুকুর, বিল। এ ছাড়া একটি ওয়াচ-টাওয়ারও রয়েছে ভেতরে। 

ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে বাংলাদেশ স্কাউট প্রশিক্ষণের পূর্ব পাশে অবস্থিত ১৫-১৬ বিঘা জমির ওপরে আরেকটি বাংলো রয়েছে। যেটি শেখ রেহানার। প্রতি বছর শেখ রেহানার পরিবারের সদস্যরা একান্ত সময় কাটাতে আসতেন। এ ছাড়াও সাবেক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকসহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নিয়মিত বৈঠক করতেন এখানে।

দুদক জানায়, টিউলিপ’স টেরিটরিসহ শেখ রেহানা পরিবারের বেশ কিছু স্থাপনার তথ্য পাওয়া গেছে সংস্থাটির অনুসন্ধানে। এসব স্থাপনার আনুমানিক মূল্য ১৬৫ কোটি টাকার বেশি। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, এখন পর্যন্ত চারটি বাগানবাড়ির তথ্য আমাদের অনুসন্ধানে রয়েছে। এগুলো সরজমিন দেখা হচ্ছে।