Image description

স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত তিনটি গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে, কিন্তু কোনও দলের পক্ষেই সেগুলোর মাধ্যমে সফলতা বা বিজয় অর্জিত হয়নি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশে এই গণভোটগুলো গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলেও প্রতিবারই গণভোটে জনগণের আস্থা আদায় করতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার বা রাজনৈতিক দলগুলো। সর্বশেষ, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সনদ বাস্তবায়ন সংক্রান্ত সুপারিশে গণভোটের প্রস্তাব দিয়েছে, তবে এটি কবে অনুষ্ঠিত হবে সরকার সেটি রাজনৈতিকদলগুলোর ওপর ছেড়ে দিয়েছে এবং এক সপ্তাহে সময় বেধে দিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোকে সিদ্ধান্তে আসার।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, গণভোট এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে জনগণ সরাসরি অংশগ্রহণ করে ব্যালটে ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ ভোটের মাধ্যমে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে মতামত দেয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনমত যাচাই করার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম এই গণভোট। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাসে মোট তিনবার গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে দুটি ছিল প্রশাসনিক এবং একটি সাংবিধানিক গণভোট। তবে কোনটিতেই ‌‌‘না’ জয়যুক্ত হয়নি, প্রতিটিতেই ‘হ্যা’ জয়যুক্ত হয়। 

জানা যায়, ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে প্রথম গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই সময় জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান থেকে রাষ্ট্রপতি হয়ে তাঁর শাসনব্যবস্থার বৈধতা যাচাই করার জন্য এই গণভোট আয়োজন করেছিলেন। ১৯৭৭ সালের ২২ এপ্রিল গণভোটের ঘোষণা দেন জিয়াউর রহমান। সেদিন দেশে ২১ হাজার ৬৮৫টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয় এবং মোট ভোটার ছিলেন ৩ কোটি ৮৪ লাখ। ফলাফলে দেখা যায়, ৮৮.১ শতাংশ ভোটার ভোট দেন। এর মধ্যে ‘হ্যাঁ’ ভোট ছিল ৯৮.৯ শতাংশ, আর ‘না’ ভোট ছিল মাত্র ১.১ শতাংশ।

দ্বিতীয় গণভোট ১৯৮৫ সালে রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের শাসনামলে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই গণভোটের মাধ্যমে তার শাসনব্যবস্থার ওপর জনগণের মতামত জানতে চাওয়া হয়েছিল। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের নীতি ও কর্মসূচির বৈধতা যাচাইয়ের জন্যই এ গণভোট আয়োজন করা হয়। ভোটাররা যদি তার প্রতি আস্থা প্রকাশ করেন, তাহলে জেনারেল এরশাদের ছবিসহ ‘হ্যাঁ’ বাক্সে ভোট দেন, আর আস্থা না থাকলে ‘না’ বাক্সে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ভোটার অংশগ্রহণের হার ছিল ৭২.২ শতাংশ। এর মধ্যে ৯৪.৫ শতাংশ ভোট ছিল ‘হ্যাঁ’ এবং ৫.৫ শতাংশ ভোট পড়েছিল ‘না’।

তৃতীয় গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৯১ সালে। এসময় হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সরকারের পতনের পর দেশে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা হতে যাচ্ছিল। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের নেতারা এটি তাদের লক্ষ্য অর্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক উদ্যোগ হিসেবে দেখেছিলেন। গণআন্দোলনের চাপের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পদত্যাগ করেন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। এরপর অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি বিজয়ী হয়। 

দীর্ঘ ১৬ বছরের রাষ্ট্রপতিশাসিত শাসন থেকে প্রধানমন্ত্রী শাসিত সংসদীয় ব্যবস্থায় রূপান্তরের জন্য ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট সংসদে সংশ্লিষ্ট বিল পাস করা হয়। সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতি সম্মতি দেবেন কি না তা নির্ধারণের জন্য ওই বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। এতে ভোটার অংশগ্রহণের হার ছিল ৩৫.২ শতাংশ। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৮৪.৩৮ শতাংশ ‘হ্যাঁ’ ভোট দিয়ে সংসদীয় প্রজাতন্ত্রকে সমর্থন করেন, আর ১৫.৬২ শতাংশ ভোটার ‘না’ ভোট দেন।

এদিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সম্প্রতি জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে একটি সুপারিশ জমা দিয়েছে, যার মধ্যে সংবিধান সংশোধন বিষয়ে গণভোট আয়োজনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সনদে ৪৮টি সংবিধান সংশোধন প্রস্তাবিত হলেও এটি বাস্তবায়নে সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে। কমিশন সরকারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে যে, গণভোটটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে হবে, নাকি নির্বাচন দিবসেই অনুষ্ঠিত হবে। জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিস সহ অন্যান্য রাজনৈতিকগুলো নভেম্বরে গণভোট চাইলেও বিএনপি সেটি জাতীয় নির্বাচনের দিনেই চায়। 

যদি এ গণভোট অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে দেশের ইতিহাসে আরেকটি অর্থাৎ চতুর্থ গণভোট হতে যাচ্ছে। তবে কবে সে গণভোট অনুষ্ঠিত হবে তা নিয়ে মতানৈক্যে পৌঁছাতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্তে আসার কথা বলেছেন। অন্যথায় সরকার এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিবেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশের ইতিহাসে গণভোটের আয়োজন একাধিক রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে হলেও প্রতিবারই তা বিতর্কিত হয়েছে। গণভোটের ফলাফলগুলি সরকার বা রাজনৈতিক দলগুলোর জনপ্রিয়তা নিশ্চিত করতে পারেনি, বরং রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বিভেদ বাড়িয়েছে। সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের প্রস্তাবটি আবারও রাজনৈতিক মহলে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে, এবং এটি দেশের রাজনৈতিক পরিবেশে নতুন সংকট তৈরি করতে পারে।