Image description
নেই পূর্ণাঙ্গ প্রশাসক গুরুত্বপূর্ণ ১০ পদ শূন্য

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) এক কোটির বেশি নাগরিক বসবাস করেন। দেশের সবচেয়ে জনবহুল এ সিটি করপোরেশনে নাগরিক সেবা পেতে সেবাগ্রহীতাদের চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। ক্ষমতার পালাবদলের পর গত ১৫ মাসেও সংস্থাটিতে পূর্ণাঙ্গ প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ১০টি গুরুত্বপূর্ণ পদ শূন্য রয়েছে। একজন কর্মকর্তার কাঁধে চাপানো হচ্ছে একাধিক দায়িত্ব। পর্যাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী না থাকায় জোড়াতালি দিয়ে চলছে সিটি করপোরেশন। সড়ক মেরামত, মশা নিয়ন্ত্রণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্যসেবা—সবখানেই অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এতে নগরবাসীর মধ্যে প্রবল অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একই ব্যক্তি একাধিক প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পালন করায় প্রশাসনিক জটিলতা বেড়েছে।

গতকাল সোমবার ডিএসসিসির প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা, পরিবীক্ষণ, মূল্যায়ন ও পরিদর্শন অনুবিভাগের মহাপরিচালক মো. মাহমুদুল হাসান। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, নিয়োগপ্রাপ্ত প্রশাসক স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৪-এর ধারা ২৫(ক) উপধারা (৩) অনুযায়ী ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রের ক্ষমতা প্রয়োগ ও দায়িত্ব পালন করবেন। তিনি নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসেবে এ দায়িত্ব পালন করবেন।

গত ২৯ অক্টোবর ডিএসসিসির প্রশাসক মো. শাহজাহান মিয়াকে সরিয়ে দেয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। তবে কেন তাকে হঠাৎ করে সরানো হয়েছে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য জানা যায়নি। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দুই দিন আগে সংস্থাটির সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস দেশ ছেড়ে যান। এরপর তিনজন কর্মকর্তা বিভিন্ন সময়ে প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করেছেন।

ডিএসসিসির সচিব দপ্তর সূত্র জানায়, বর্তমানে সংস্থাটির ১০টি গুরুত্বপূর্ণ পদে কোনো কর্মকর্তা নেই। এর মধ্যে রয়েছে প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা, প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ, প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা ও নিরীক্ষা কর্মকর্তা।

প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা পদায়ন করা হলেও এখনো তিনি যোগদান করেননি। প্রতিটি পদই সংস্থার মূল কার্যক্রম চালানোর ক্ষেত্রে অপরিহার্য। দক্ষিণ সিটির রাজস্ব খাতে অনুমোদিত ৩ হাজার ১৬৬ পদের মধ্যে ১ হাজার ৩০৭টি শূন্য। দীর্ঘদিন ধরে নিয়োগ না হওয়ায় একজন কর্মকর্তাকে একসঙ্গে দু-তিনটি দপ্তরের দায়িত্ব সামলাতে হচ্ছে। সংস্থার ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য থেকেই জনবলের সংকট স্পষ্ট বোঝা যায়।

নগরবাসীর দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম সরাসরি জড়িত। রাস্তা, ড্রেনেজ, ময়লা অপসারণ, স্বাস্থ্যসেবা—সবকিছুই সিটি করপোরেশনের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু শীর্ষ পদগুলো শূন্য থাকায় নাগরিকরা প্রতিদিন ভোগান্তি পোহাচ্ছেন। সংস্থাটির পাঁচ অঞ্চলের নির্বাহী কর্মকর্তা নেই। অঞ্চল-১, অঞ্চল-৩, অঞ্চল-৭, অঞ্চল-৯ ও অঞ্চল-১০—প্রতিটি অঞ্চলে একাধিক ওয়ার্ড রয়েছে। এসব অঞ্চলের সড়ক মেরামত, ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা, পরিচ্ছন্নতা ও নাগরিক সেবা তদারকির দায়িত্বে থাকেন আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তারা। কিন্তু এতগুলো অঞ্চল নির্বাহী কর্মকর্তাশূন্য থাকায় সেবা কার্যক্রম কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। এতে ছোটখাটো সমস্যার সমাধানের জন্যও স্থানীয় বাসিন্দাদের বারবার সিটি করপোরেশনের মূল কার্যালয়ে যেতে হচ্ছে।

ডিএসসিসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা না থাকায় সিটি করপোরেশনের আয় বাড়ানোর কাজ স্থবির হয়ে আছে। সম্পত্তি কর্মকর্তা না থাকায় কিছু এলাকায় দখলমুক্ত করা জমি আবারও দখল হয়ে যাচ্ছে। প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তার অনুপস্থিতিতে ডেঙ্গু ও অন্যান্য জনস্বাস্থ্য সংকটে সঠিক উদ্যোগ নেওয়া যাচ্ছে না। প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ না থাকায় উন্নয়নকাজ হচ্ছে পরিকল্পনাহীনভাবে, যা নগরের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি ডেকে আনছে। হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা ও নিরীক্ষক না থাকায় আর্থিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করাও সম্ভব হচ্ছে না।

ডিএসসিসির স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. নিশাত পারভীন সামলাচ্ছেন স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব। উপ-প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তার পদও শূন্য। দক্ষিণ সিটির তত্ত্বাবধানে থাকা তিনটি হাসপাতালের অবস্থাও নাজুক; জনবল সংকটে চিকিৎসা কেন্দ্রগুলো ধুঁকছে।

স্বাস্থ্য বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি অংশ ভেটেরিনারি বিভাগে ১০টি জোনে আছেন মাত্র ৪ কর্মকর্তা। ফলে সব বাজার পর্যবেক্ষণ সম্ভব হচ্ছে না। আধুনিক খাদ্য পরীক্ষাগারে জনস্বাস্থ্য অ্যানালিস্ট পদ শূন্য; একজন রসায়নবিদ অতিরিক্ত দায়িত্বে কাজ চালাচ্ছেন।

এ ছাড়া ভান্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তার পদ খালি। সম্পত্তি বিভাগের প্রধানসহ ৪টি পদ ফাঁকা। প্রটোকল দপ্তরেও নেই কোনো কর্মকর্তা। সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন বিভাগের ৪টি পদের মধ্যে ২টি শূন্য। নগর পরিকল্পনা বিভাগের প্রধান হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্বে আছেন স্থপতি মো. সিরাজুল ইসলাম। ভূগোলবিদ এবং আইসিটি সেলের প্রোগ্রামার পদের পাশাপাশি বিদ্যুৎ বিভাগের দুই উপসহকারী প্রকৌশলীর পদ শূন্য। যান্ত্রিক বিভাগের সহকারী প্রকৌশলীর পদেও কাউকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (পুর), পরিবেশ, জলবায়ু ও দুর্যোগ শাখার পদ দীর্ঘদিন খালি।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে স্থায়ী প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে সরকার। ফলে উত্তর সিটির কাজ দক্ষিণ সিটির তুলনায় দ্রুত এগোচ্ছে। ডিএসসিসির কর্মকর্তারা জানান, স্থায়ী প্রশাসক না থাকা এবং গুরুত্বপূর্ণ পদ শূন্য থাকায় নাগরিক সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। রাস্তা মেরামত, মশার উৎপাত প্রতিরোধ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, সম্পদ রক্ষা, জন্মনিবন্ধনসহ বিভিন্ন সেবায় স্থবিরতা নেমে এসেছে।

কর্মকর্তারা আরও জানান, গুলিস্তান এলাকায় করপোরেশনের আওতাধীন বিপণিবিতানে অভিযান চালিয়ে ভেঙে ফেলা দোকানগুলো আবার গড়ে তোলা হয়েছে। একটি চক্র এসব দোকান পুনর্গঠন করে বাণিজ্য করছে। বিভিন্ন সম্পত্তি বেহাত হয়ে যাচ্ছে। প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা না থাকায় সচিব অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু সচিব নিজ দায়িত্ব সামলাতেই হিমশিম খাচ্ছেন; অতএব রাজস্ব বিভাগের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ সামলানো তার পক্ষে সম্ভব নয়।

সরেজমিন দেখা গেছে, মুগদা মেডিকেল কলেজের সামনের অতীশ দীপঙ্কর সড়কটি তিন বছরের বেশি সময় ধরে ভোগান্তির কারণ হয়ে আছে। বিশেষ করে মেডিকেলের সামনের অংশটি খানাখন্দে ভরা। গুরুতর অসুস্থ ব্যক্তিদের বহনকারী রিকশা বা অ্যাম্বুলেন্স এসব খানাখন্দে আটকে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। একই অবস্থা চকবাজার ও আশপাশের এলাকায়। জেলখানা রোড থেকে চকবাজার পর্যন্ত রাস্তা ও ফুটপাতে বড় বড় গর্ত রয়েছে। পোস্তগোলা, শাহীন মসজিদ, ইসলামগঞ্জ, কেল্লার মোড়ের রাস্তাও একই অবস্থা।

ধলপুর কমিউনিটি সেন্টার থেকে মানিকনগর বাজার সড়ক প্রায় ব্যবহার অনুপযোগী। পুরো সড়কে অসংখ্য খানাখন্দ। ধলপুর কমিউনিটি থেকে সিটি করপোরেশন আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় পর্যন্ত সড়কজুড়ে গর্তে ভরা। রিকশা উল্টে যাওয়ার ঘটনা অহরহ। আর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মানিকনগর বাজার পর্যন্ত সড়কের এক পাশ কেটে রাখা এবং অন্য পাশেও গর্ত থাকায় যানবাহন চলাচল সম্ভব হচ্ছে না। বৃষ্টি হলে হেঁটে চলাও কঠিন। এক বছরের বেশি সময় ধরে এ দুরবস্থা চললেও সিটি করপোরেশন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

গেন্ডারিয়া এলাকার বাসিন্দা হাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমরা সিটি করপোরেশনকে কর দিই, কিন্তু সেবার কোনো নিশ্চয়তা পাই না। ওয়ার্ড অফিসে গিয়ে দেখি কর্মকর্তা নেই, কাগজপত্র পড়ে থাকে মাসের পর মাস। এটা কি সিটি করপোরেশন চালানোর ধরন? আমরা এ অবস্থা থেকে মুক্তি চাই।’

সূত্রাপুরের বাসিন্দা ইশরাত জাহান বলেন, ‘১৫ মাসেও সরকার একজন স্থায়ী প্রশাসক ঠিক করতে পারেনি। এটা সরকারের বড় গাফিলতি। দ্রুত শূন্য পদে নিয়োগ দিয়ে নাগরিক সেবা নির্বিঘ্ন করতে সরকারের উদ্যোগ নেওয়া উচিত।’

নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘সিটি করপোরেশনে প্রশাসক পদ নিয়ে এই অবস্থাকে কোনোভাবেই কাম্য বলা যায় না। বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এবং অযোগ্যতাপূর্ণ নগরীতে সেবা দিতে হলে স্থায়ী প্রশাসক ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর থাকা আবশ্যক। ঢাকা দক্ষিণে সেটিই অনুপস্থিত। সরকারকে অবিলম্বে আমলাতন্ত্রের বাইরে গিয়ে জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক আছে এমন কাউকে প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া উচিত। একইভাবে, ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদের জন্য এলাকাভিত্তিক ভালো মানুষদের এগিয়ে আনা প্রয়োজন।’