প্রশাসন ও পুলিশে পদোন্নতি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া চলছে। সচিব হিসেবে গত রবিবার তিনজন অতিরিক্ত সচিব পদোন্নতি পেয়েছেন। এর আগে পদোন্নতিপ্রাপ্ত আরও একজনকে পদায়ন করা হয়েছে। শিগগির আরও সচিব হিসেবে পদোন্নতির খবর আসবে। পাশাপাশি অতিরিক্ত সচিব পদোন্নতির প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে। তবে ডিআইজি পদে পদোন্নতি না হওয়ায় পুলিশের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ আছে। অন্যদিকে প্রশাসনে সচিব পদে ‘যোগ্যদের’ পরিবর্তে ফ্যাসিস্ট আমলের সুবিধাভোগীদের পদোন্নতির অভিযোগ করেছেন বঞ্চিতরা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এবার প্রথম ১৭তম ব্যাচ থেকে সচিব করা শুরু করল সরকার। এর আগে এ নিয়ে সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি) বৈঠক হয়েছে। যোগ্যতা ও দক্ষতার পরিবর্তে লবিংয়ের জোরে সচিব পদে পদোন্নতির অভিযোগ বাদ পড়াদের। তারা মনে করছেন, দক্ষতার সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতে না পারলে সরকারের কার্যক্রমে গতি কমবে। তাই সচিব হিসেবে দায়িত্ব প্রদানের আগে এসব বাছবিচার জরুরি।
রবিবার জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. নূরুন্নাহার চৌধুরীকে পদোন্নতি দিয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব করা হয়েছে। তার স্বামী একই ব্যাচের ড. জিয়াউল হক আছেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে। অর্থ বিভাগে সংযুক্ত অতিরিক্ত সচিব বিলকিস জাহান রিমিকে পদোন্নতি দিয়ে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ে পদায়ন করা হয়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব
মো. শওকত রশীদ চৌধুরীকে সচিব পদে পদোন্নতি দিয়ে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিব করা হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত সচিব এসএম শাকিল আখতারকে পরিকল্পনা বিভাগের সচিব হিসেবে বদলি করা হয়েছে। এ নিয়ে একাধিক কর্মকর্তা জানান, সচিব পদে আরও পদোন্নতি আসছে। সব অতিরিক্ত সচিবকে পদোন্নতি দিয়ে সচিব করা সম্ভব নয়। যিনি বঞ্চিত হবেন তাঁর মনে হবে ‘যোগ্য’ ব্যক্তি বাদ পড়েছেন।
প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা জানান, দীর্ঘদিন ফাঁকা ছিল পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিবের পদ। অন্তত ৭ মাস পার হয়েছে সচিব ছাড়া। গতকাল সেখানে নতুন সচিব যোগ দেন। এখনও সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গা সচিবশূন্য। যোগ্যতা ও নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে কর্মকর্তাদের পদায়নের কথা বলা হচ্ছে। প্রশাসনের সর্বোচ্চ ধাপ সচিব পদে পদোন্নতি দিতে ‘যাচাই-বাছাই’ করে যাচ্ছে সরকার।
আপাতত চুক্তিভিত্তিক সচিব নিয়োগ দেওয়ার চিন্তা নেই সরকারের। অবশ্য সচিব পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া নিয়ে বেশ বিতর্ক আছে। অতিরিক্ত সচিবদের একটা বড় অংশ বিভিন্ন ফোরামে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের কারণে বঞ্চিত হওয়ার কথা তুলে ধরেছেন। তা ছাড়া ৮-৯ বছর আগে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তা বর্তমান প্রশাসনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছেন না বলেও তাঁরা বলছেন। চিনতেও পারছেন না অনেক দক্ষ কর্মকর্তাকে। নিজেরাও দক্ষতার স্বাক্ষর রাখতে পারছেন না। কিছুক্ষেত্রে হাসিনা সরকারের সুবিধাভোগীদের পদোন্নতি ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পদায়ন দেওয়ার অভিযোগ আছে তাদের বিরুদ্ধে। বর্তমানে প্রশাসনের শীর্ষ পদে অন্তত ১০ জন সিনিয়র সচিব হিসেবে চুক্তিভিত্তিক দায়িত্বরত।
কোনো পদ খালি হলে নতুন কেউ সেই দায়িত্ব নেবেন, এটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের কারণে সেই কর্মকর্তা বঞ্চিত হন।
এদিকে ৬ মাস ধরে ঝুলে আছে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি। ২০২১ সালের ২৯ অক্টোবর বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের ২০তম ব্যাচের বেশিরভাগ কর্মকর্তা যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি পান। সে হিসেবে যুগ্মসচিব পদে তাঁরা আছেন ৪ বছর। ২০০১ সালের ২৮ মে চাকরিতে যোগদান করা এ ব্যাচের আইডি ৬৬২৯ থেকে ৬৯২৮ পর্যন্ত। যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রথমবার ৬৬২৯ থেকে ৬৮৯৯ আইডি পর্যন্ত বিবেচনায় নেওয়া হয়। এর প্রায় ১ বছর পর ব্যাচের বাকি অংশ এবং ইকোনমিক ক্যাডার থেকে প্রশাসনে একীভূতদের পদোন্নতি হয়। নিকট অতীতে কর্মকর্তারা যুগ্মসচিব পদে আড়াই থেকে পৌনে তিন বছর কাজ করার পর অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত হয়েছেন। তবে সবচেয়ে সৌভাগ্যবান ১৯৭৯ ব্যাচের যুগ্মসচিব পদে ১৪ মাস চাকরি করে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতিপ্রাপ্তরা। এ ব্যাচ ২৪ বছরে সচিব পদে পদোন্নতি লাভ করে। আর ২০তম ব্যাচ সাড়ে ২৪ বছরে অতিরিক্ত সচিবও হতে পারছে না। অথচ অতিরিক্ত সচিবের স্বল্পতার জন্য অনেক মন্ত্রণালয় ও বিভাগের বিভিন্ন অনুবিভাগে পদায়ন করা যাচ্ছে না। একজন অতিরিক্ত সচিব দুই বা ততোধিক অনুবিভাগের দায়িত্ব পালন করছেন। একই কারণে অনেক সংস্থা ও করপোরেশনে চেয়ারম্যান, প্রধান নির্বাহী ও মহাপরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়া যাচ্ছে না।
গত সেপ্টেম্বর মাসে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতির জন্য এসএসবির দুটি সভা হলেও নানা কারণে প্রক্রিয়াটি থেমে যায়। জনপ্রশাসনের সিনিয়র সচিব পদে পরিবর্তনের পর এক সভায় আলোচনা উঠলেও তা আর নিষ্পত্তি হয়নি। তবে শিগগির সিদ্ধান্ত আসার কথা রয়েছে।
পদোন্নতি প্রসঙ্গে অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব আব্দুস সালাম বলেন, যোগ্যতা ও দক্ষতা নিশ্চিত করাই আদর্শ প্রশাসনের কাজ। স্বজনবিচারি না হয়ে গুণবিচারি হবেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারাÑ এটাই স্বাভাবিক। যথাসময়ে পদোন্নতি অধিকার, এটি কারও দয়া নয়। একান্ত জরুরি না হলে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ না দেওয়াই শ্রেয় বলে মনে করেন তিনি।
এদিকে পুলিশের মধ্যে পদোন্নতি নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে। একই ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের সহকর্মীরা বহু আগে যুগ্ম সচিব হয়েছেন। তিন ব্যাচ জুনিয়ররাও পদোন্নতি পেয়ে গেছেন। অথচ ডিআইজি পদে পদোন্নতির অপেক্ষায় ঘুরছেন ২১ ব্যাচের পুলিশ কর্মকর্তারা। বৈষম্যের কারণে মনোবল হারিয়ে ফেলছেন অন্যান্য ব্যাচের কর্মকর্তারাও।
তথ্যমতে, সাধারণত প্রশাসন ক্যাডারে পদশূন্য থাকার কোনো বিষয় নেই। অথচ পুলিশে ৩৭টি ডিআইজির পদ ৬ মাস ধরে শূন্য। গণ-অভ্যুত্থানের পর পুলিশ কর্মকর্তাদের অনেকে হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। কেউ কেউ বিপুল অর্থ ব্যয় করে বিদেশে পালিয়ে গেছেন। নানা অপরাধের কারণে সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন আড়াই শ’র বেশি পুলিশ কর্মকর্তা।
জানা গেছে, পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) গ্রেড-৩-এর শূন্যপদে পদোন্নতির প্রক্রিয়া দীর্ঘদিনের। ২০তম বিসিএসের পুলিশ কর্মকর্তাকে ডিআইজি পদে পদোন্নতি দেওয়া হয় ২০২২ সালে। বাকিরা তিন বছরের বেশি সময় ধরে পদোন্নতিবঞ্চিত ছিলেন। পটপরিবর্তনের পর ১৫, ১৭, ১৮ ও ২০তম ব্যাচের কিছু কর্মকর্তা পদোন্নতি পান। তবে এখনও বঞ্চিত রয়েছেন কেউ কেউ। আর ২১ ব্যাচের পদোন্নতির জন্য এসএসবি দূরের কথা, এখনও গোয়েন্দা সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদন জোগাড় করা সম্পন্ন হয়নি। যদিও এ সময়ের মধ্যে একাধিক এসএসবির সভা হয়েছে। যুগ্ম সচিব ও উপসচিব পদে পদোন্নতি হয়েছে। চলতি বছর ২৪তম প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা যুগ্ম সচিব হয়েছেন। অথচ পুলিশ ক্যাডারের পদোন্নতির খবর নেই। পুলিশে ২১ ও ২২ ব্যাচ এখনও ডিআইজি হতে পারেনি। এ অবস্থার দ্রুত অবসান জরুরি বলে মত দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত এডিশনাল আইজি আব্দুর রহিম বলেন, বহু বছর ধরে এ বৈষম্য দেখা যায়। সরকারের উচিত সমতা নিশ্চিত করা। প্রশাসন বা পুলিশ নয়, সব ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সমতার চোখে না দেখলে কল্যাণ রাষ্ট্র হতে পারে না।