ন্যায়বোধের সন্ধিক্ষণে এক জাতি
২০২৫ সালের ৯ অক্টোবর—এই দিনটি ইতিহাসের পাতায় চিরস্থায়ীভাবে লেখা থাকবে। সেদিন বাংলাদেশ রাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে ২৮ জন ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে, যাদের মধ্যে ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এবং বেশ কয়েকজন বর্তমান ও অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ—গুম, গোপন আটক এবং নির্যাতনের অপরাধ।
এটি কোনো প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ নয়, বরং নৈতিক পুনর্জাগরণের এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত—যখন একটি আহত প্রজাতন্ত্র অস্বীকারের পরিবর্তে সত্যকে বেছে নিয়েছে, ভয়ের পরিবর্তে ন্যায়কে। স্বাধীনতার তিপ্পান্ন বছর পর প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ তার নিজের আইনব্যবস্থাকে সেইসব শাসকের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছে, যারা একসময় আইনের ঊর্ধ্বে ছিলেন। যে রাষ্ট্রীয় যন্ত্র একসময় জনগণকে স্তব্ধ করেছিল, আজ সেটিই তাদের কণ্ঠস্বরকে উচ্চকিত করছে।
যাদের প্রিয়জন গুম হয়েছিল, যেসব মা কারাগারের ফটকে অপেক্ষা করেছেন, যেসব স্ত্রী বিবর্ণ ছবিকে বুকে চেপে রেখেছেন, যেসব সন্তান জিজ্ঞেস করেছে, ‘বাবা কোথায়?’—তাদের জন্য এই দিনটি শুধু বিচার নয়, প্রজন্মের বেদনা ও জয়ের প্রতীক। এই গুম হওয়া মানুষগুলো কোনো সংখ্যা নয়; তারা ছিল ছেলে-মেয়ে, বাবা, সাংবাদিক, আইনজীবী, শিক্ষক ও ছাত্র, যাদের মুছে দিয়েছিল এক এমন রাষ্ট্র, যেখানে ক্ষমতার সঙ্গে বৈধতা গুলিয়ে গিয়েছিল। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্যানুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে কমপক্ষে ১ হাজার ৮৫০ মানুষ নিখোঁজ হন, যাদের মধ্যে ৩০০ জনের বেশি মানুষকে পরে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। অসংখ্য মানুষ আজও নিখোঁজ, যেন অসমাপ্ত প্রার্থনার মতো জাতির বিবেককে তাড়া করে ফিরছে।
এই বিচার প্রক্রিয়া দক্ষিণ এশিয়ায় ২০০৯ সালে শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের অবসানের পর থেকে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ রূপান্তরমূলক বিচারের উদ্যোগ। এটি স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে—‘জাতীয় নিরাপত্তা’র নামে সংঘটিত অপরাধ আর দেশপ্রেমের মুখোশে আড়াল হতে পারবে না। আদালত ও বিবেক উভয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ঘোষণা করেছে—একটি জাতির শক্তি তার সত্যকে দমন করার ক্ষমতায় নয়, বরং সেই সত্যের মুখোমুখি হওয়ার সাহসে নিহিত।
স্বৈরতন্ত্রের স্থাপত্য
শেখ হাসিনার পনেরো বছরের শাসনামলে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ধীরে ধীরে রূপ নেয় নির্বাচিত স্বৈরশাসনের মডেলে। তার সরকার নির্ভর করেছিল র্যাব ও ডিজিএফআইয়ের মতো গোয়েন্দা সংস্থার ওপর, যারা কার্যত বিকল্প বিচারব্যবস্থা হিসেবে কাজ করত।
২০১৭ সালে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ৯০টি গুমের ঘটনার নথিপত্র প্রকাশ করলে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান একে ‘বিদেশি প্রচারণা’ বলে উড়িয়ে দেন। সাংবাদিকরা যখন এসব ঘটনা অনুসন্ধান করেন, তখন তাদের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় গ্রেপ্তারের হুমকি দেওয়া হয়—একটি আইন যা মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে অপরাধে পরিণত করে।
বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মী, এমনকি ব্যবসায়ীরাও গুমের শিকার হন, যদি তারা শাসকদলের তহবিলে অনুদান দিতে অস্বীকার করতেন।
এ ধরনের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস কেবল বাংলাদেশের একচ্ছত্র বৈশিষ্ট্য নয়, এটি প্রতিধ্বনিত করেছে লাতিন আমেরিকার গত শতকের সত্তরের দশকের সামরিক স্বৈরতন্ত্রের যুগকে। যেমন আর্জেন্টিনার সামরিক জান্তা তাদের ‘ডার্টি ওয়ারে’ প্রায় ৩০ হাজার মানুষকে গুম করেছিল। আর্জেন্টিনা ও বাংলাদেশের ভাষা ছিল এক—গুম হওয়া ব্যক্তিরা ছিল ‘রাষ্ট্রের শত্রু’। কিন্তু সত্যের স্মৃতি দীর্ঘস্থায়ী, আর সেটি একদিন ফিরে আসে ন্যায়ের দাবি নিয়ে।
ভয়ের ওপর দাঁড়ানো এক শাসনের পতন
২০২৪ সালের মধ্যভাগে শেখ হাসিনার ক্ষমতার ভিত্তি ভেঙে পড়তে শুরু করে। দীর্ঘদিনের দুর্নীতি, বেকারত্ব ও যুবসমাজের ক্রোধ বিস্ফোরিত হয় ছাত্রনেতৃত্বাধীন বিক্ষোভে, যা ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। যখন নিরাপত্তা বাহিনী নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালায়, তখন শত শত প্রাণ ঝরে যায় এবং জনরোষ বিস্ফোরিত হয়।
পরবর্তী জুলাই বিপ্লব তিন সপ্তাহ স্থায়ী হয় এবং অন্তত ১ হাজার ৪০০ জন নিহত হন। দক্ষিণ এশিয়ার দীর্ঘতম স্বৈরতন্ত্রের একটির অবসান ঘটিয়ে দেয় এই আন্দোলন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগ করেন। খবরে জানা যায়, তিনি ভারতের সামরিক সুরক্ষায় পালিয়ে যান। তার মন্ত্রীরা ছড়িয়ে পড়েন দুবাই, লন্ডন ও নয়াদিল্লিতে।
এই পতন ছিল মুবারকের মিসর কিংবা বেন আলির তিউনিসিয়ার পতনের প্রতিচ্ছবি, যেখানে দশকের পর দশক লালিত দমননীতিও নাগরিকদের নৈতিক জাগরণের কাছে টেকেনি।
নতুন সূচনা
নোবেলজয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস যখন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেন, তার বার্তা ছিল সরল অথচ বিপ্লবাত্মক—‘সমঝোতার আগে সত্য।’ কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তিনি গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন গঠন করেন, যার নেতৃত্বে ছিলেন বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক।
কমিশনের অনুসন্ধান ছিল চমকে দেওয়ার মতো। ১ হাজার ৮৫০টি নথিভুক্ত ঘটনার মধ্যে ৩০০ জনেরও বেশি নিহত এবং শত শত মানুষ এখনো নিখোঁজ। তদন্তে উঠে আসে গোপন আটককেন্দ্র ও নির্যাতন কক্ষ—‘ব্ল্যাক সাইট’, যা সেনানিবাসের ভেতরে লুকিয়ে ছিল।
কমিশনের প্রামাণ্যচিত্র ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ’ সারা দেশে প্রচারিত হলে জাতি স্তব্ধ হয়ে যায়। বেঁচে ফেরা মানুষরা বর্ণনা করেন ওয়াটারবোর্ডিং, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করা, নিদ্রাহীন নির্যাতন, মানসিক চাপ এবং মায়েরা বলেন, কীভাবে অচিহ্নিত খামে তাদের সন্তানের ঘড়ি ফেরত পেয়েছিলেন।
প্রফেসর ইউনূস ঘোষণা করেন—‘গুম হওয়া মানুষের হাড়ের ওপর শান্তি নির্মাণ করা যায় না।’ তার সরকার ভুক্তভোগীদের পরিবারকে সহায়তা তহবিল দেয় এবং বিচার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে হেগ ও জেনেভার আইন বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ত করে।
দক্ষিণ এশিয়ার ঐতিহ্য ভাঙার নজির
আসামিদের মধ্যে আছেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল আনোয়ার হোসেন, মেজর জেনারেল সাইফুল ইসলাম এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তারিক সিদ্দিকী—শেখ হাসিনার নিরাপত্তা উপদেষ্টা। দক্ষিণ এশিয়ায় যেখানে সামরিক কর্মকর্তারা বরাবরই অমোচনীয় প্রভাব ভোগ করেছেন, সেখানে এই ঘটনা এক ভূমিকম্পের সমান।
পাকিস্তানে আজও শত শত বালুচ কর্মী নিখোঁজ, শ্রীলঙ্কায় গৃহযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ৪০ হাজার বেসামরিক নাগরিক হত্যার জন্য কেউ দায়ী হয়নি, আর ভারতে আজও আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার্স অ্যাক্ট (এএফএসপিএ) সেনাদের বিচারের হাত থেকে রক্ষা করে।
বাংলাদেশের এই উদ্যোগ দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন দিগন্ত খুলেছে। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে সেনা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বিচার করা হচ্ছে, যে ট্রাইব্যুনাল একসময় ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছিল। এতে স্বাধীনতা যুদ্ধের নৈতিক উত্তরাধিকার আজকের মানবাধিকারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।
আইনবিদরা একে তুলনা করেছেন আর্জেন্টিনার ১৯৮৫ সালের ‘ট্রায়াল অব দ্য জুন্টাস’-এর সঙ্গে এবং চিলির ১৯৯৮ সালের পিনোশে অভিযুক্তকরণের সঙ্গে, যা ন্যায়বিচারের সর্বজনীন নীতি নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছিল।
মানবতার মুখ
আদালতে যখন অভিযোগপত্র পাঠ করা হয়, পুরো কক্ষ আবেগে ভরে ওঠে। মায়েরা বিবর্ণ ছবি আঁকড়ে ধরেন, বিধবারা নীরবে প্রার্থনা করেন, আর যারা অন্ধকারে বেঁচে ফিরেছেন তারা একসঙ্গে দাঁড়ান। তাদের মধ্যে ছিলেন মীর আহমদ বিন কাসেম (আরমান), যিনি ২০১৬ সালে নিখোঁজ হন একজন বিরোধী নেতার পক্ষে আইনজীবী হিসেবে কাজ করার অপরাধে। আট বছর গোপন কারাবাস শেষে তিনি ক্ষীণকায় হলেও দৃঢ়স্বরে বলেন, ‘বছরের পর বছর আমি সূর্যালোকের স্বপ্ন দেখেছি—আজ আবার তা দেখলাম।’
এই গল্পগুলো মনে করিয়ে দেয় আর্জেন্টিনার প্লাজা দে মায়োর মায়েদের, চিলির নিখোঁজদের আত্মীয়দের এবং দক্ষিণ আফ্রিকার সত্য ও পুনর্মিলন কমিশনের সাক্ষ্য, যেখানে বেদনা লুকোনো নয়, বরং রূপান্তরিত হয়েছিল নৈতিক পুনর্জাগরণে।
সীমান্তের ওপারে ছায়া
বাংলাদেশের অতীতের সঙ্গে হিসাব মেলাতে গেলে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং (RAW)’-এর গোপন ভূমিকাও উন্মোচিত করতে হবে। তদন্ত কমিশনের সাক্ষ্যে উঠে এসেছে, RAW ডিজিএফআই ও র্যাবের ভেতরে লিয়াজোঁ ইউনিট স্থাপন করেছিল, যা ‘সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতা’র আড়ালে বিরোধী নেতা ও সাংবাদিকদের ওপর নজরদারি চালাত।
ভারতের সঙ্গে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠতা বাংলাদেশের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়িয়েছিল। রাজনৈতিক আশ্রয়ের বিনিময়ে তার সরকার ভারতকে পরিবহন করিডর, সামরিক প্রবেশাধিকার এবং মীরসরাইয়ে আদানি গ্রুপের জন্য ৯০০ একর জমি দেয়, যা কার্যত একটি কৌশলগত উপকূলীয় অঞ্চল হস্তান্তর। সাবেক ডিজিএফআই কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ঢাকা ও আগরতলায় যৌথ বৈঠকে র’-এর কর্মকর্তারা ‘টার্গেটের তালিকা’ সরবরাহ করতেন, যাদের পরে গুম করা হতো। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র ভারতের এই গোপন সহযোগিতা দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে দমনমূলক শাসনকে টিকিয়ে রেখেছিল। ৯ অক্টোবরের অভিযুক্তকরণ তাই শুধু অভ্যন্তরীণ নয়, এটি ভারতীয় আধিপত্যের প্রতি নৈতিক চপেটাঘাত। ঢাকা জানিয়ে দিয়েছে, ছোট দেশগুলো আর বড় দেশের নিরাপত্তা হিসাবের উপনিবেশ নয়।
গোপন অভিযান : সহযোগিতা থেকে নজরদারিতে
‘যা শুরু হয়েছিল অংশীদারত্ব হিসেবে, শেষ হয়েছে অনুপ্রবেশে; যা ছিল নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি, তা পরিণত হয়েছে নজরদারিতে।’ ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার পুনর্নির্বাচনের পরপরই র’ ঢাকায় তাদের লিয়াজোঁ সেল আবার চালু করে, যা ‘সন্ত্রাস দমন’ শিরোনামে কার্যত এক বিশাল অভ্যন্তরীণ নজরদারি নেটওয়ার্কে রূপ নেয়।
২০১৬ সালে মীর আহমদ বিন কাসেম (আরমান) ও অন্যান্য বিরোধী নেতাদের গুমের ঘটনা এই জোটের অন্ধকারতম অধ্যায় হয়ে ওঠে। তদন্তে প্রমাণিত হয়, স্থানীয় সংস্থাগুলো বিদেশি প্রযুক্তিগত সহায়তা নিয়ে এসব অপারেশন চালিয়েছিল।
২০১৯ সালে সহযোগিতা স্থানান্তরিত হয় অর্থনৈতিক প্রভাব প্রতিষ্ঠার দিকে। আদানি স্পেশাল ইকোনমিক জোনের চুক্তিতে ভারত ৯০০ একর উপকূলীয় ভূমি পায়, যেখানে বাংলাদেশি কোম্পানিগুলো অংশ নিতে পারেনি—সার্বভৌমত্ব হয়ে পড়েছিল এক লেনদেন।
সবশেষে ২০২৩ সালে, ‘অতি-উগ্রবাদের বিরুদ্ধে অভিযান’-এর নামে সারা দেশে ডিজিটাল নজরদারি প্রোগ্রাম চালু হয়। বিশ্ববিদ্যালয়, সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক প্ল্যাটফর্মে বিদেশি প্রযুক্তির ছায়া নেমে আসে; স্বাধীন কণ্ঠস্বর স্তব্ধ হয়।
১৪ বছরের এই অধ্যায় প্রমাণ করে, সহযোগিতার নামে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ক্ষয় হয়েছে। আর আজকের এই বিচার প্রক্রিয়া সেই গোপন অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে এক নৈতিক প্রতিশোধ—একটি জাতির মর্যাদা পুনরুদ্ধারের ঘোষণা।
আঞ্চলিক জাগরণ
ঢাকার আদালতের গণ্ডি ছাড়িয়ে এই বিচার এক নৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক জাগরণের বার্তা। দীর্ঘদিন দক্ষিণ এশিয়া ‘নির্বাচিত ন্যায়বিচার’-এর সংস্কৃতিতে নিমজ্জিত ছিল, যেখানে ক্ষমতা নিষ্ঠুরতাকে আড়াল করত এবং নীরবতা ছিল সহযোগী। পাকিস্তানের বালুচিস্তান, শ্রীলঙ্কার জাফনা, ভারতের কাশ্মীর এবং মিয়ানমারের রাখাইন—সবখানেই ‘জাতীয় নিরাপত্তা’র অজুহাতেই মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে।
বাংলাদেশ আজ সেই নীরবতার দেয়াল ভেঙে দিয়েছে। যে দেশ একসময় দখল, গণহত্যা ও দমননীতির শিকার ছিল, আজ সেই দেশই দক্ষিণ এশিয়ার বিবেকের বাতিঘর।
‘ঢাকার আদালতে কেবল অভিযুক্তদের বিচার হচ্ছে না—বিচার হচ্ছে পুরো দক্ষিণ এশিয়ার নীরবতার।’
বাংলাদেশের এই সাহসী পদক্ষেপ কেবল একটি জাতির আত্মশুদ্ধি নয়, এটি সমগ্র অঞ্চলের জন্য এক স্বাধীনতার ঘোষণা—একটি বার্তা যে ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে মর্যাদার ভিত্তিতে, আধিপত্যের নয়।
স্মৃতি এক প্রতিরোধের রূপ
বিচার দীর্ঘ হবে, জটিলও বটে; কিন্তু ন্যায়ের প্রকৃত মাপকাঠি কেবল রায়ে নয়, স্মৃতির সততায়। গুমের স্মৃতির মুখোমুখি হয়ে বাংলাদেশ প্রমাণ করছে—জাতি ক্ষত ভুলে নয়, তা স্বীকার করেই আরোগ্য লাভ করে। যেমন জার্মানি মুখোমুখি হয়েছিল হলোকস্টের, আর্জেন্টিনা তার ‘ডার্টি ওয়ারের’, আর দক্ষিণ আফ্রিকা তার বর্ণবৈষম্যের।
যা শুরু হয়েছিল অস্বীকারের অভিযানে, আজ তা রূপ নিয়েছে ইতিহাসের পুনর্জাগরণে।
৯ অক্টোবরের অভিযুক্তকরণ কেবল অপরাধের বিচার নয়, এটি একটি জাতির নৈতিক আত্মাকে পুনরুদ্ধারের ঘোষণা।
বাংলাদেশ তার সাবেক শাসক ও সেনা কর্মকর্তাদের গুম ও নির্যাতনের অপরাধে বিচারের আওতায় এনে দক্ষিণ এশিয়ার জন্য নতুন মানদণ্ড স্থাপন করেছে—প্রমাণ করেছে, ন্যায়বিচার বিলম্বিত হলেও সেটিই একদিন গণতন্ত্রের সবচেয়ে শক্তিশালী ভিত্তি হয়ে ওঠে।
লেখক : যুক্তরাষ্ট্রের সাভানা স্টেট ইউনিভার্সিটির ব্যবসা, সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগের অধ্যাপক।