জুলাই অভ্যুত্থানের পর প্রশাসনে বড় ধরনের পরিবর্তন হলেও খাদ্য বিভাগে তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের আস্থাভাজন ও আশীর্বাদপুষ্টরাই নিয়ন্ত্রণ করছেন খাদ্য অধিদপ্তর। এখনো গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরগুলোতে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন সাধন সিন্ডিকেটের সদস্যরাই। খাদ্য অধিদপ্তরে রমরমা বদলি ও পদায়ন বাণিজ্য করছে ওই সিন্ডিকেট।
সোমবার (৩ নভেম্বর) জারি করা আদেশে বলা হয়েছে, চলতি মৌসুমের আমন সংগ্রহ অভিযান নিরবচ্ছিন্ন ও সফলভাবে সম্পন্ন এবং লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের স্বার্থে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বদলি ও পদায়ন স্থগিত থাকবে। এই সিদ্ধান্তের আওতায় এলএসডির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, সিএসডির ব্যবস্থাপক এবং সাইলোসমূহের অধীক্ষকগণও অন্তর্ভুক্ত থাকবেন।
খাদ্য অধিদপ্তরের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, জুলাই অভ্যুত্থানের পরও খাদ্য বিভাগে বড় ধরনের কোনো রদবদল হয়নি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বদলির আদেশ স্থগিত হওয়ার খবর প্রকাশের পরও কিছু আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক (আরসি ফুড) জোরপূর্বক চার্জ বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করছেন। অভিযোগ আছে, মেয়াদ পূর্তির আগেই কর্মকর্তাদের কাছ থেকে ‘পারিবারিক সমস্যা’ দেখিয়ে আবেদন লিখিয়ে নিয়ে মোটা অঙ্কের ঘুষের বিনিময়ে অন্যদের পদায়ন করা হচ্ছে। বিশেষ করে ময়মনসিংহ অঞ্চলে বদলি বাণিজ্যের এই অভিযোগ তীব্র আকার ধারণ করেছে। স্থানীয় পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়া তথ্যে জানা যায়, ময়মনসিংহ আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক (আরসি ফুড) মো. আশরাফুল আলমের নেতৃত্বে গঠিত একটি সিন্ডিকেট এই বদলি বাণিজ্য পরিচালনা করছে। সম্প্রতি অন্তত ছয়টি গুদামে এই ধরনের অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। পুরো প্রক্রিয়ায় মধ্যস্থতার দায়িত্ব পালন করছেন খাদ্য পরিদর্শক মো. মাজহারুল ইসলাম কামাল।
খাদ্য অধিদপ্তরের কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে জানান, আঞ্চলিক অফিস থেকেই কর্মকর্তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে ‘পারিবারিক সমস্যা’ দেখিয়ে আবেদন লিখিয়ে নেওয়া হচ্ছে। কেউ অস্বীকৃতি জানালে প্রশাসনিক জটিলতায় ফেলার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এসব বদলি ও পদায়নের ক্ষেত্রে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ লেনদেন হচ্ছে বলে দাবি কর্মকর্তাদের।
জানা গেছে, নেত্রকোনার কেন্দুয়া সদর খাদ্যগুদামে সম্প্রতি বিধিবহির্ভূতভাবে এক উপপরিদর্শককে পরিদর্শকের দায়িত্বে পদায়ন করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী সেখানে পরিদর্শক পদমর্যাদার কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকার কথা। এ নিয়ে অভিযোগ ওঠার পর বাধ্য হয়ে সেই পদায়ন আদেশ বাতিল করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া নেত্রকোনা সদর, ঠাকুরাকোনা, ময়মনসিংহের গৌরীপুর, তারাকান্দা, ধলা ও শ্যামগঞ্জ গুদামে দুই বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই অনেক কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে একই কর্মকর্তাকে অল্প সময়ের মধ্যে দুইবার বদলি করা হয়েছে। তারাকান্দা খাদ্যগুদামের কর্মকর্তা মো. আলাল হোসেনকে গত ১৯ আগস্ট মেয়াদ পূর্ণের দুই মাস আগেই বদলি করে ফুলবাড়িয়ায় পাঠানো হয়। মাত্র ১৭ দিনের ব্যবধানে তাঁকে ফের গৌরীপুরে বদলি করা হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আলাল হোসেন মোবাইলে প্রতিবেদককে বলেন, ‘আপনি একসময় আমার অফিসে আসেন, একটু বসে কথা বলব।’ ১৭ দিনের ব্যবধানে দুইবার বদলির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি এড়িয়ে যান। একইভাবে গত ২২ অক্টোবর বদলি করা হয় নেত্রকোনা সদর গুদামের কর্মকর্তাকে। নেত্রকোনার ঠাকুরাকোনা এলএসডিতে দায়িত্বে থাকা শামিম আহম্মেদ পারিবারিক সমস্যা দেখিয়ে সেই এলএসডিতে মিউচুয়াল ট্রান্সফারের মাধ্যমে আব্দুল ওয়াহাবকে সুযোগ করে দিয়েছেন বলে জানান খাদ্য পরিদর্শক মো. মাজহারুল ইসলাম কামাল। তবে নিয়মানুযায়ী মিউচুয়াল ট্রান্সফারের কোনো সুযোগ নেই। এ বিষয়ে জানতে চাইলে শামিম আহম্মেদ জানান, আমার পারিবারিক সমস্যার কারণে দীর্ঘদিন যাবৎ বদলির চেষ্টা করছিলাম। নিয়মানুযায়ী বদলি হয়েছি। কোনো মিউচুয়াল ট্রান্সফার করিনি।
বদলি বাণিজ্যের এই অনিয়মে ক্ষুব্ধ মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ঘুষ ছাড়া এখন কোনো পদায়নের সুযোগ নেই। ফলে দক্ষ ও সৎ কর্মকর্তারা বঞ্চিত হচ্ছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খাদ্য অধিদপ্তরের এক পরিদর্শক জানান, এসব অনিয়ম প্রশাসনের জ্ঞাতসারে ঘটছে। কিন্তু কেউই প্রকাশ্যে কথা বলতে চাইছেন না। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ময়মনসিংহ আঞ্চলিক খাদ্যনিয়ন্ত্রক আশরাফুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি একটি প্রশিক্ষণে আছি’ বলেই ফোন সংযোগ কেটে দেন। এরপর ফোন করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।
তবে খাদ্য পরিদর্শক মো. মাজহারুল ইসলাম কামাল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘যাঁদের বদলির অর্ডার হয়েছে, তাঁরা কি কেউ আপনাকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন? আমাদের বিপক্ষে কিছু গ্রুপ আছে, তারা এসব মিথ্যা ছড়াচ্ছে।’
জানতে চাইলে খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আবুল হাছানাত হুমায়ুন কবীর সোমবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আমিই উপদেষ্টা ও সচিব স্যারকে ম্যানেজ করে বদলি পদায়ন স্থগিত করার বিজ্ঞপ্তি ইস্যু করিয়েছি। এরই মধ্যে ইস্যু করা বদলির আদেশগুলোর ব্যাপারে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’