Image description

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দলীয় প্রচারণার জন্য কর্মী ও সমর্থকদের সরব উপস্থিতি বহুদিনের। গত দেড় দশকে বিভিন্ন সময়ে তার ধরন বদলেছে। সর্বশেষ, ২০২৪-এর আগস্টের পরে এটা রূপ নিয়েছে “সাইবার যুদ্ধ”র। একাধিক পক্ষ কেবল পরস্পরকে ঘায়েল করার জন্য ব্যবহার করছে এই প্ল্যাটফর্‌ম। তথ্য যদি সত্যও হয়, তার সঙ্গে মিথ্যা মিশিয়ে আরও বেশি ঘায়েল করার চেষ্টা চলছে নিরবচ্ছিন্ন। অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও সাইবার বিশ্লেষকরা বলছেন, এখন ব্যবহার বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু এর চল শুরু হয় ২০১০ এর পর থেকেই। মাঝে আইনি-বেআইনি নানাভাবে দমন করে বন্ধ করা হয় পারস্পরিক লড়াই। তবে এখন সেটি লাগামছাড়া। সত্য মিথ্যা মেলানো তথ্যের দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচক প্রভাবের কথাও স্মরণ করেন তারা।

জুলাই-আগস্ট আন্দোলন

২০২৪ সালে জুলাইয়ে সারাদেশ যখন উত্তাল, তখন জেনজিদের অনলাইন যোগাযোগ ও অ্যাক্টিভিজম সবার নজর কাড়ে। নানা প্ল্যাটফর্মে ছোট বড় দলে তখন আন্দোলনের কৌশল থেকে শুরু করে রাস্তার লড়াই নির্ধারণ। অন্যদিকে, আন্দোলন ঠেকাতে তৎকালীন সরকারের পক্ষে দাঁড়াতে ছিল ছোট বড় নানা অনলাইন গ্রুপ। পরে সেসব দলগত অ্যাক্টিভিজম সমালোচনার মুখেও পড়ে।

এই আন্দোলনটা অনলাইনের জায়গা থেকে ছিল একেবারেই আলাদা; নাকি এই প্রবণতা বরাবরই ছিল, এমন প্রশ্নে সাংবাদিক কদরুদ্দীন শিশির বলেন, “এই ধরনের এক দল/পন্থার বিরুদ্ধে অন্য দল বা পন্থার লোকজনের ভুয়া খবর ছড়ানোর বিষয়টি আসলে অনেক আগে থেকেই ছিল; আমি বলছি সোশ্যাল মিডিয়ার কথা। ২০১০ এর পর থেকে এগুলো ছিল বাংলাদেশে। সিপি গ্যাং, বাঁশের কেল্লা এরকম আরও অনেক কিছু ছিল। তবে ২০১৪ এর পর থেকে তখনকার সরকার বিরোধীমতের অনেক পেজ টেকওভার করে, অনেকগুলো রিমুভ করে দেয়। আস্তে আস্তে হতাশ এবং আর্থিকভাবে অপুষ্ট বিরোধীরা দুর্বল হয়ে যায় অনলাইন ক্যাম্পেইনে। তবে ৫ আগস্টের পর নতুন বাস্তবতায় আওয়ামীবিরোধী সবাই আস্তে আস্তে সবল হয়ে ওঠে। আর আওয়ামী লীগ সবলই আছে অনলাইন ক্যাম্পেইনে। ফলে, এখন চতুর্মুখী ভুয়া খবর ছড়ানোর বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। কেউ কারো চেয়ে কম যাচ্ছে না। এর মাধ্যমে মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে। সচেতন মানুষদের আলাপ আলোচনায়ও অনেক সময় দেখা যায় ভুয়া খবরের রেফারেন্স। অর্থাৎ, ভুয়া খবর সমাজে প্রভাব তৈরি করছে। ফোকলোরে ঢুকে যাবে অনেক ভুয়া খবর/ন্যারেটিভ। এর মধ্যে কিছু ভুয়া খবর সংবাদমাধ্যমেও স্থান করে নিচ্ছে এবং নেবে। এগুলো ঐতিহাসিক রেফারেন্স হয়ে উঠবে। দীর্ঘমেয়াদে এগুলোর প্রভাব আছে।”

অনলাইন কেন্দ্রিক প্রোপাগান্ডা, বিশেষ করে ফেইক নিজ ছড়িয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করাটা এখন সারা দুনিয়াতেই সুস্থ রাজনীতির জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করেন অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট আরিফ জেবতিক।

প্রোপাগান্ডার বর্তমান ট্রেন্ড কেন এরকম প্রশ্নে তিনি বলেন, “বাংলা ব্লগের সোনালি দিনগুলোতে, কিংবা ফেসবুকের প্রথমদিকেও এই 'সাইবার যুদ্ধ'টা ছিল তর্ক-বিতর্ক, আলাপ আলোচনার স্পেস। একেকজন অ্যাক্টিভিস্ট প্রচুর পড়াশোনা করে তারপর তর্কে লিপ্ত হতেন, পাতার পর পাতা রেফারেন্স দেওয়া হতো, বইপত্রের স্ক্রিনশট দেওয়া হতো। আমার স্মরণ আছে, আমাদের টিমের পক্ষ থেকে তখন বিভিন্ন বিদেশি জার্নাল, পত্রিকার আর্কাইভ পয়সা দিয়ে এক্সেস নিয়েও আমরা প্রচুর রেফারেন্স দিয়েছি। এখন সেই চর্চাটা প্রায় নেই বললেই চলে। এখন মূল কাজ হচ্ছে মানুষজনকে উসকে দেওয়া। সোশ্যাল মিডিয়ার কনটেন্ট মনিটাইজেশন এর পেছনে একটা বড় কারণ। বড় বড় অ্যাক্টিভিস্টরা বছরে কোটি কোটি টাকা রোজগার করছেন, তারা আমজনতাকে উসকে দিয়ে উত্তেজিত করাটাকেই বড় করে দেখছেন।”

সত্য-মিথ্যা মিশিয়ে এই ‘যুদ্ধ’র প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে প্রশ্নে তিনি বলেন, “যেভাবে এআই এসেছে, ফেক ভিডিও তৈরি সহজ হচ্ছে, বিষয়টাকে নিয়মতান্ত্রিকতার মধ্যে নিয়ে আসতে না পারলে এর ক্ষতির দিকটি কয়েক বছরের মধ্যেই আমরা দেখতে পাবো।”

এই ধরনের ক্যাম্পেইনের পরিণতি প্রশ্নে মানবাধিকারকর্মী রেজাউর রহমান লেনিন বলেন, “সত্য-মিথ্যা ক্যাম্পেইন দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় মব তৈরি করা নতুন ঘটনা না, বাংলাদেশে আমরা দেখেছি ফেসবুকের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ব্যক্তি আইপি অ্যাড্রেস ট্র‍্যাক করে তাকে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকারে পরিণত করা হয়েছে। তবে এখন যে নতুন মাত্রাটা পেয়েছে, মিথ্যাআশ্রিত বিভিন্ন তথ্য বিভিন্ন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী সম্পর্কে ছড়িয়ে মব তৈরি ও সহিংসতা ঘটনানোর চেষ্টা হচ্ছে। এই সহিংসতা ঘটানোর ক্ষেত্রে আক্রমণের যে ইচ্ছা সেটা বিবেচনা করে আইন আদালত দ্বারা সেটা নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। অনেক রকমের ‘আকাঙ্ক্ষা আশ্রিত গুজব’, কোনও একটি ঘটনা রঙ লাগিয়ে বাড়িয়ে বলার মধ্য দিয়ে মব তৈরির চেষ্টা অপরাধ। সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। তবে সেটা করতে গিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যারা ব্যবহার করেন তাদের গণহারে অপরাধীকরণ যেন করা না হয় সেটা মাথায় রাখা দরকার। কিছু নীতির দিকে খেয়াল রাখা দরকার। নিয়ন্ত্রণে যে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে সেটা আইনি কিনা, সেটার বৈধ উদ্দেশ্য আছে কিনা দেখা দরকার। এসব নজরে না নিলে অপরাধীকরণের শঙ্কা থেকে যায়।  এবং এই নীতির আলোকের বাইরে গিয়ে নিয়ন্ত্রণের কাজ করা যাবে না।”