Image description

দেশের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা দিয়ে আসছে অস্ত্র। পরে তা ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। ৫ই আগস্টের অভ্যুত্থানের দিনে দেশের বিভিন্ন থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্রের একটি অংশ এখনো উদ্ধার হয়নি। এই অস্ত্র নিয়ে শঙ্কার মধ্যেই নতুন করে অস্ত্র আসাকে উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন আইনশৃঙ্খলা সংশ্লিষ্টরা। গোয়েন্দা তথ্য বলছে, পার্শ্ববর্তী দেশের বিভিন্ন সীমান্ত পার হয়ে দেশে ঢুকছে নানা ধরনের অস্ত্র। সম্প্রতি র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব)’র সদস্যরা নরসিংদীর রায়পুরায় অভিযান চালিয়ে ১১টি আগ্নেয়াস্ত্র ও কার্তুজসহ ৮ জনকে গ্রেপ্তার করে। র‍্যাব জানায়, নরসিংদীর রায়পুরার সায়দাবাদ ও সদর উপজেলার আলোকবালি চরাঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্যে প্রায়ই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এসব সংঘর্ষে একাধিক হত্যা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটেছে। সন্ত্রাসীরা এসব কর্মকাণ্ড চালিয়ে রায়পুরার দুর্গম সায়দাবাদ এলাকায় আত্মগোপন করতো। অতীতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এসব দুর্গম এলাকায় অভিযান চালাতে গেলে সন্ত্রাসীরা একজোট হয়ে অতর্কিত হামলা চালাতো। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা স্বীকার করেছে, চরাঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গ্রেপ্তার এড়াতে তারা বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিজেদের হেফাজতে রেখেছিল। বিভিন্ন চক্রের মাধ্যমে এসব অস্ত্র পার্শ্ববর্তী দেশের সীমান্ত পার করে দেশে আনার পর নদী পথে তাদের হাতে পৌঁছায়। 

এর আগে গত ৩০শে অক্টোবর সকাল ১১টায় চট্টগ্রামের রাউজানে অভিযান চালিয়ে এক রাজনৈতিক নেতার বাড়ি থেকে ১০টি বন্দুক, একটি এয়ারগান, ১৫টি কিরিচ, ৪টি রাম দা, ১১টি কার্তুজ, ৪টি কার্তুজের খোসা, ৩টি চাইনিজ কুড়াল, ৮টি লাঠি ও ১৮টি আতশবাজি, মাদকসহ দুইজনকে আটক করে র‌্যাব। র‌্যাব-৭-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. হাফিজুর রহমান বলেন, রাউজানের নোয়াপাড়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যানের বাড়ির আঙিনা, পুকুরপাড় এবং আলমারিতে এসব অস্ত্র ও মাদক লুকিয়ে রাখা হয়েছিল।  সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে  অভিযান চালিয়ে এসব অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। একইদিন ৩০শে অক্টোবর রাতে ঢাকার আশুলিয়ার গাজীরচটের মাটির মসজিদ এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১টি বিদেশি পিস্তল, ২টি ম্যাগাজিন, ৩৩ রাউন্ড শটগান ও পিস্তলের কার্তুজ, ৪টি দেশীয় অস্ত্র ও মাদক উদ্ধার করে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়, সমপ্রতি গাজীরচট এলাকায় কিছু অস্ত্রধারী ও মাদক ব্যবসায়ী চক্র স্থানীয় সহযোগীদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। গত ৩০শে অক্টোবর রাতে হঠাৎ এলাকায় টানা পাঁচ রাউন্ড গুলির শব্দে জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পরে জামগড়া আর্মি ক্যাম্পের টহলদল এলাকাবাসীর সহায়তায় অভিযান চালিয়ে চারজনকে আটক করে। পরে আটকদের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে যৌথ তল্লাশিতে লুকানো অস্ত্র ও মাদক উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত অস্ত্র, গোলাবারুদ ও অন্য সামগ্রীসহ চারজন আসামিকে আশুলিয়া থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। 

এর দুইদিন আগে ২৮শে অক্টোবর চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে সেনাবাহিনী ও র‌্যাবের যৌথ অভিযানে ৩টি একনলা বন্দুক, ১টি ওয়ান শুটার গান, ৫টি দেশীয় ধারালো অস্ত্র এবং ১০টি কার্তুজ উদ্ধার করা হয়। র‌্যাব-৭ এর সহকারী পরিচালক (গণমাধ্যম) এআরএম মোজাফ্‌ফর হোসেন জানান, বাঁশখালী থানাধীন সরল এলাকায় কতিপয় অস্ত্রধারী সন্ত্রসী বিপুল পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্রসহ অবস্থান করছে- এমন গোপন সংবাদের ভিত্তিতে মঙ্গলবার ভোর সোয়া ছয়টার দিকে র‌্যাব-৭ এবং সেনাবাহিনী যৌথভাবে উপজেলার সরল উত্তর এলাকায় অভিযান চালিয়ে এসব অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। 

২৬শে অক্টোবর সকাল সোয়া ১১টায় রাজধানীর বিমানবন্দর রেলস্টেশনে অভিযান চালায় সেনাবাহিনী। ওইদিন সকালে রাজশাহী থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা বনলতা এক্সপ্রেস ট্রেনের একটি বগি তল্লাশি করে ৮টি বিদেশি পিস্তল, ১৪টি ম্যাগাজিন, ২৬ রাউন্ড অ্যামুনিশন, ২ দশমিক ৩৯ কেজি গান পাউডার ও ২ দশমিক ২৩ কেজি প্লাস্টিক বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়, সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে গোয়েন্দা সংস্থা ও রেলওয়ে পুলিশের সহায়তায় রাজধানীর বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে অভিযান চালানো হয়। ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার সন্দেহে ৪ জনকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।  এর আগে গত ৩০শে সেপ্টেম্বর হাজারীবাগের বারৈইখালী বাজার এলাকার একটি বাড়ি  থেকে একটি শটগান, দু’টি এয়ারগান, দু’টি বিদেশি পিস্তল, চারটি ম্যাগাজিন, ২০টি খালি খোসা, ১৮০টি ইয়ারবল, ২৫০টি ইয়ার প্লেট, একটি ক্লিনিং কিটসহ ব্যাগ, দু’টি ওয়াকিটকি সেট, একটি চাপাতি, একটি সামুরাই ও দু’টি মোবাইলসহ মো. রবিউল ইসলাম ও শরিফুল ইসলাম শান্ত নামে দু’জনকে আটক করা হয়। র‌্যাব মহাপরিচালক অতিরিক্ত আইজিপি এ কে এম শহিদুর রহমান বলেন, উদ্ধার হওয়া এসব অস্ত্র পুলিশের। গ্রেপ্তাররা অস্ত্র থেকে পুলিশের নম্বর মুছে ফেলেছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তাররা স্বীকার করেছে তারা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সন্ত্রাসী কার্যক্রমের পরিকল্পনা করছিল।

গত ৩০শে আগস্ট চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সলিমপুর পাহাড়ে সেনাবাহিনী ও পুলিশ অস্ত্র তৈরির কারখানায় অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও সরঞ্জাম উদ্ধার করে। এ সময় চারজনকে আটক করা হয়। সীতাকুণ্ড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মজিবুর রহমান বলেন, অভিযানকালে অস্ত্র কারখানা থেকে ৬টি দেশীয় আগ্নেয়াস্ত্র, খালি কার্তুজ ৩৫ রাউন্ড, তাজা কার্তুজ ৫ রাউন্ড, চাইনিজ কুড়াল ১টি, ২০টি রামদা, ওয়াকিটকি চার্জারসহ ২টি, মেগাফোন ১টি, প্যারাস্টু ফ্লেয়ার ৪টি এবং অন্যান্য অস্ত্র তৈরির সরঞ্জামাদি ও যন্ত্রপাতি উদ্ধার করা হয়। এর কিছুদিন আগে গত ১৮ই আগস্ট গভীর রাতে পাবনার আতাইকুলা থানার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের দুর্গম চতরা বিলে গোপন আস্তানায় অস্ত্র তৈরির কারখানা থেকে বিপুল অস্ত্র তৈরির সরঞ্জামসহ দু’জনকে আটক করে পুলিশ। আতাইকুলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হবিবুর রহমান বলেন, আতাইকুলা থানার অন্তর্গত আটঘরিয়া উপজেলার প্রত্যন্ত চতরা বিলে সন্ত্রাসী ময়েজ বাহিনী দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছিল। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বিলের মধ্যে লুকানো ঘাঁটি থেকে একটি ওয়ান শুটারগান, একটি রিভলবার, তিনটি গুলি, অস্ত্র তৈরির ছাঁচ, কাটিং মেশিন, ড্রিল মেশিন, লোহার পাত, গোলাবারুদ, গান পাউডারসহ অস্ত্র তৈরির বিপুল পরিমাণ সরঞ্জাম উদ্ধার করা করা হয়। আটক ব্যক্তিরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে, তারা বিলের মধ্যে একটি শ্যালো ইঞ্জিনচালিত মেশিনঘরে অস্ত্র তৈরির কারখানা গড়ে তুলেছিল। এই কারখানা থেকে বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি করে বিক্রি করা হতো। স্থানীয়ভাবে ডাকাতি ও চাঁদাবাজির উদ্দেশ্যে এসব অস্ত্র ব্যবহৃত হতো। 

গত ১২ই ফেব্রুয়ারি রাতেও মুন্সীগঞ্জের চরকেওয়ার গজারিয়া কান্দি এলাকায় অস্ত্র তৈরির কারখানার সন্ধান পায় পুলিশ। পরে সেখানে অভিযান চালিয়ে ১টি দেশীয় তৈরি স্নাইপার রাইফেল, ২টি দেশীয় তৈরি ওয়ান শুটার গান, ১ রাউন্ড রাইফেলের গুলি, ৯ রাউন্ড পিস্তলের গুলি, ৪ রাউন্ড শটগানের গুলি, পিস্তলের ২টি গুলির খোসা, স্নাইপার রাইফেলের ২টি পাইপ, ১টি ছোরা ও চাপাতি, ১টি দেশীয় আগ্নেয়াস্ত্র তৈরির ড্রিল মেশিন, ২টি পিস্তলসদৃশ স্টিলের পাত, ৬টি আগ্নেয়াস্ত্র তৈরির স্প্রিং এবং লাগেজে ভর্তি আগ্নেয়াস্ত্র তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। ওই ঘটনা নিয়ে মুন্সীগঞ্জ সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি, সদর সার্কেল) আসাদুজ্জামান বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অস্ত্র তৈরির কারখানায় অভিযান পরিচালনা করা হয়। চরাঞ্চলে বিভিন্ন নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে এসব অস্ত্র সরবরাহ ও বিক্রি করা হতো।

এ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আগ্নেয়াস্ত্র ও এর কারখানা উদ্ধার করা হয়েছে। ১৪ই অক্টোবর ভোর রাত ৩টার দিকে  যশোরের অভয়নগর উপজেলার প্রেমবাগ ইউনিয়নের মাগুরা গ্রামের শেখপাড়া এলাকা থেকে ২টি পাইপগানসহ ২ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়। অভয়নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এম রবিউল ইসলাম বলেন, যৌথ বাহিনীর অভিযানে পরিত্যক্ত অবস্থায় ২টি পাইপগান ও ২ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। ১৭ই জুলাই ভোর ৬টার দিকে চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার বরুমচড়া ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের মুসলিম রেঞ্জারের বাড়ির একটি পুকুর থেকে একটি দেশীয় এলজি, একটি তুর্কির তৈরি একনলা বন্দুক, ৮ রাউন্ড কার্তুজ ও অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম জব্দ করা হয়। সেখান থেকে আব্দুল মজিদ নামে একজনকে আটক করা হয়। এমনকি গত শনিবারও রাজশাহী নগরীর  অলোকার মোড় এলাকার গোপাল পচা পুকুর পাড় থেকে একটি ম্যাগাজিনসহ বিদেশি পিস্তল উদ্ধার করেছে পুলিশ। যার গায়ে খোদাই করে লেখা রয়েছে মেইড ইন ইউএসএ। রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) মুখপাত্র ও উপ-পুলিশ কমিশনার গাজিউর রহমান জানান, দুপুর আড়াইটার দিকে পুকুর পাড়ে অভিযান চালিয়ে পরিত্যক্ত অবস্থায় একটি ম্যাগাজিনসহ পিস্তল উদ্ধার করা হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একজন কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতীয় ও মিয়ানমার সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে দেশে ঢুকছে অস্ত্র। আর এসব অস্ত্রের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে নানা সাংকেতিক ভাষা ও বিশেষ বার্তা বিনিময়ের কৌশল। প্রতিটি অস্ত্রের জন্য আলাদা সংকেত থাকে।  

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) এ এইচ এম শাহাদাত হোসেন বলেন, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতেই আমরা দেশব্যাপী অবৈধ অস্ত্রের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছি। পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনী, র‌্যাব পৃথকভাবে ও যৌথভাবেও অভিযান পরিচালনা করছে। আমরা বিভিন্ন অভিযানে ব্যাপক অস্ত্র ও অস্ত্র তৈরির কারখানার সন্ধান পেয়েছি। অস্ত্র উদ্ধার করেছি। আবার পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে আমাদের দেশের একাধিক সীমান্ত থাকায় সেদিক দিয়েও চোরাই পথে অনেক অস্ত্র দেশে প্রবেশ করে। সেদিকেও আমাদের নজর রয়েছে। আমাদের অন্য বাহিনীরাও সীমান্তের পাশাপাশি পাহাড়েও নজর রাখছে।