Image description

কারাগারে সিট বাণিজ্যসহ বন্দিদের নানা অনৈতিক সুবিধা দিয়ে তাদের কাছ থেকে প্রায় ৫০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন খাগড়াছড়ি জেলা কারাগারের জেলার মো. আক্তার হোসেন শেখ। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হওয়ায় তার বেতন ১ হাজার ৭১০ টাকা অবনমন করা হয়। এ শাস্তির মেয়াদ এক বছর। এর পরে তিনি আগের বেতন কাঠামোয় ফিরে যাবেন।

গত ৩০ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গণি স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে তাকে এ শাস্তি দেয়া হয়।

কারা অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, মো. আক্তার হোসেন শেখ ২০২৩ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি জেলা কারাগারে জেলার হিসেবে যোগ দেন। দায়িত্ব পালন করেন চলতি বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এর মধ্যে গত বছরের ৩ জুন থেকে ২১ অক্টোবর পর্যন্ত মাত্র সাড়ে চার মাসে বন্দিদের কাছ থেকে নানা উপায়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেন। তিনি খাগড়াছড়ি জেলা কারাগারের জবা-৩, রজনী-২ ও ডালিয়া-৪ নং ওয়ার্ডের বিভিন্ন হাজতি ও কয়েদি বন্দির কাছ থেকে তাদের জামিন করানো ও নিয়মবহির্ভূতভাবে দেখা-সাক্ষাতের সুযোগ দেয়াসহ অন্যান্য বিষয়ে অনৈতিকভাবে প্রায় দেড় লাখ টাকা নেন। পাশাপাশি এসব ওয়ার্ডের বন্দি দিদারুল আলম, মো. আফতাব উদ্দিন চৌধুরী, মো. মফিজুল ইসলামসহ আরো অন্য বন্দিদের সিট বাণিজ্য, জামিন ও দেখা-সাক্ষাতের সুযোগ দিয়ে অনৈতিকভাবে তার মোবাইল আর্থিক সেবা নগদের মাধ্যমে অর্থ গ্রহণ করেন।

 

কারা গোয়েন্দা বিভাগ জানায়, খাগড়াছড়ি জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি হিসেবে ডিভিশনপ্রাপ্ত হাজতি আশুতোষ চাকমাকে মেডিকেল ওয়ার্ডে রেখে খাট, আসবাবসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার কথা বলে ৩০ হাজার টাকা নেন জেলার আক্তার হোসেন। এছাড়া ফ্রিজ মেরামতের জন্য ৩ হাজার ও চেয়ার কেনার জন্য ৬ হাজার টাকা নেন। এ অর্থ আশুতোষ চাকমার শ্যালক ভবতোষ চাকমার কাছ থেকে তিনি গ্রহণ করেন। এছাড়া তিনি ২৪ জন হাজতির কাছ থেকে সিট ভাড়া, বারান্দার লাইট ও বিদ্যুৎ সংযোগের নামে ২৩ হাজার টাকা করে নেন। হাজতি শিব শংকর দেবকে মানসিক চাপ ও শারীরিক অসুস্থতার জন্য শিউলি ওয়ার্ডে (মেডিকেল ওয়ার্ড নামে পরিচিত) রাখার সুপারিশ করেছেন। শিউলি ওয়ার্ডে থাকার জন্য তিনি রুম ভাড়া বাবদ ৫০ হাজার টাকা নেন। এছাড়া ক্যান্টিনের ফ্ল্যাস্ক কেনার জন্য বন্দি শংকর দেবের পারসোনাল ক্যাশ (পিসি) কার্ড থেকে ৩ হাজার টাকা কেটে নেন।

কারাসংশ্লিষ্টরা জানান, বন্দিদের জন্য খাগড়াছড়ি কারাগারের ভেতরে একটি ক্যান্টিন পরিচালিত হয়। এ ক্যান্টিন থেকে কেনাকাটার জন্য বন্দিদের পিসি কার্ড করতে হয়। এ কার্ডের বিপরীতে ন্যায্যমূল্যে পণ্য সরবরাহের কথা থাকলে জেলার মো. আক্তার হোসেন শেখ প্রতিটি পণ্যে ভ্যাটের কথা বলে বাড়তি ৪০ শতাংশ অর্থ বন্দিদের থেকে আদায় করেন। এছাড়া কারারক্ষী মহিউদ্দিনকে ৪৫ হাজার টাকার বিনিময়ে ক্যান্টিনের ভেতরের এবং ৭০ হাজার টাকার বিনিময়ে নাছির উদ্দিনকে বাইরের অংশের দায়িত্ব দেন। জেলারের নির্দেশনা অনুযায়ী তারা দুজন ক্যান্টিন পরিচালনা করে বান্দিদের কাছ থেকে ওই অতিরিক্ত ৪০ শতাংশ অর্থ আদায় করেন। এছাড়া যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই কারারক্ষীদের ছুটি দেয়া এবং ছুটি বাতিলের বিনিময়েও আর্থিকভাবে সুবিধা নেন। সব মিলিয়ে সাড়ে চার মাসে খাগড়াছড়ি জেলা কারাগারের বন্দি ও করারক্ষীদের থেকে তৎকালীন জেলার মো. আক্তার হোসেন শেখ প্রায় ৫০ লাখ টাকা নেন।

আর্থিক অপরাধে জড়িয়ে পড়া মো. আক্তার হোসেন শেখকে পরে যশোর জেলা কারাগারের উপতত্ত্বাবধায়ক (লজিস্টিক) হিসেবে বদলি করা হয়। বর্তমানে তিনি সেখানেই দায়িত্ব পালন করছেন। তার বিরুদ্ধে আসা আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ তদন্ত করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শৃঙ্খলা-৩ শাখা। পরবর্তী সময়ে সন্দেহাতীতভাবে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। দেয়া হয় লঘুদণ্ড। আর্থিক অপরাধের সরাসরি সম্পৃক্ততা পাওয়ার পরে তাকে অসদাচরণের দায়ে এক বছরের জন্য ১ হাজার ৭১০ টাকা বেতন অবনমন করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।

অভিযোগ ও সাজার বিষয়ে জানতে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হয় মো. আক্তার হোসেন শেখের সঙ্গে। এ প্রতিবেদকের পরিচয় ও প্রশ্ন শোনার পর তিনি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। এরপর কয়েক দফা ফোন করা হলেও তিনি আর সাড়া দেননি।

কারাসংশ্লিষ্টরা জানান, বন্দি বাণিজ্যের এমন চিত্র শুধু খাগড়াছড়ি জেলা করাগরারেই নয়, রয়েছে অন্যান্য কারাগারেও। মূলত কারাগারে বন্দি বেড়ে গেলে সামর্থ্যবানরা টাকা দিয়ে আরাম-আয়েশে থাকার চেষ্টা করেন। তখন টাকা নিয়ে পুরনো কয়েদিদের সহযোগিতায় সেই সুযোগ-সুবিধা দেন কিছু কারারক্ষী। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘটে মাদকদ্রব্য (গাঁজা-ইয়াবা) সরবরাহ এবং মোবাইল ফোন বিক্রি। অতিরিক্ত দামে কেনা ছোট আকৃতির ফোন নিজেদের কাছে কৌশলে লুকিয়ে রাখেন কয়েদিরা। এসব সুবিধা দেয়ার বিনিময়ে পাওয়া টাকা কারারক্ষীরা পুরনো কয়েদিদের সঙ্গে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেন।

চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সহকারী প্রধান কারারক্ষী ছিলেন তারিকুল ইসলাম শাহীন। বন্দিদের কাছে মাদক সরবরাহের অভিযোগে গত বছরের ২১ নভেম্বর তিনি চাকরি হারান। রুমান ভূঁইয়া ছিলেন কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারের রক্ষী। বন্দিদের কাছে মোবাইল ফোন সরবরাহের অভিযোগে গত ১২ আগস্ট চাকরিচ্যুত হয়েছেন তিনি। চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন কারাগারে টাকার বিনিময়ে এভাবে বন্দিদের কাছে মাদকদ্রব্য, মোবাইল ফোন সরবরাহসহ বিভিন্ন অভিযোগে গত এক বছরে ৪৪ কারারক্ষী শাস্তি পেয়েছেন। তাদের মধ্যে চাকরি হারিয়েছেন পাঁচজন। বিভাগটির ১১ কারাগারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অপরাধে জড়াচ্ছেন চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার, কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগার, কক্সবাজার জেলা কারাগার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কারাগার ও নোয়াখালী জেলা কারাগারের কারারক্ষীরা। এর মধ্যে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও কক্সবাজারে সবসময়ই ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি বন্দি থাকে। রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি হলে সেই সংখ্যা চার-পাঁচ গুণ পর্যন্ত বেড়ে যায়। এ সুযোগে বিভিন্ন স্তরের কারারক্ষী ও কারা কর্মকর্তারা বন্দি বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কারাগারে অনৈতিক সুবিধা দিয়ে আর্থিক সুবিধা নেয়ার ঘটনায় কারা কর্মকর্তাদের লঘুদণ্ড যথেষ্ট নয়। অপরাধের তুলনায় কম শাস্তির কারণে অন্যান্য কারা কর্মকর্তাও এ ধরনের অপরাধে যুক্ত হতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সবার আগে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তারপর এ বার্তা সব কারা কর্মকর্তা ও কর্মচারীর মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। সবার মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। তাহলেই কারাগারকে অপরাধমুক্ত করা যাবে।

আর্থিক অনিয়ম সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হওয়ার পরও আক্তার হোসেনকে লঘুদণ্ড দেয়া লোক দেখানো শাস্তি বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এটা লোক দেখানো শাস্তি বা ব্যবস্থা নেয়া। তাকে মূলত এখান থেকে মুক্তি দিতেই এমন নমনীয় শাস্তি। জেলখানা সব ধরনের অপরাধমুক্ত থাকবে। জেলার বা জেল কর্তৃপক্ষ অবশ্যই একটি সুনির্দিষ্ট নিয়মের মধ্য দিয়ে চলবে। কিন্তু সেটা না হয়ে তারা নিজেরাই যখন আর্থিক অপরাধে যুক্ত হয়ে যান, বন্দিরা তাদের দেখে সংশোধনের আর সুযোগ পান না। আমরা দীর্ঘদিন ধরে কারা কর্মকর্তাদের সচ্ছলতার কথা বলেছি। কিন্তু শর্সের মধ্যেই ভূত রয়েছে। কারাগারের অব্যবস্থাপনা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কথা হচ্ছে। কারাগার পরিচালনার দায়িত্বে যারা আছেন, তারা নানা ধরনের আর্থিক সুবিধা নেন, বিশেষ করে রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীদের থেকে। কারাগারের ভেতরে তাদের ভালো রাখার বিনিময়ে এটা হয়। জেল কোডের বাইরে গিয়ে এ ধরনের সেবা দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমরা চাই যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে জোরালো শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে এখান থেকে অন্যরা এ ধরনের অপরাধ থেকে দূরে থাকার বার্তা পাবে।’

কারা কর্মকর্তাদের অনিয়মের বিষয়ে অধিদপ্তর জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করে বলে জানান সহকারী কারা মহাপরিদর্শক মো. জান্নাত-উল ফরহাদ ইসলাম। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কারা বিভা‌গে কর্মরত কেউই জবাবদিহির বাইরে নয়। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ‌এলে সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে মন্ত্রণালয় অথবা কারা অ‌ধিদপ্তর বি‌ভিন্ন পর্যা‌য়ে ব্যবস্থা গ্রহণ ক‌রে। অনিয়মের বিরুদ্ধে কারা অধিদপ্তর সব সম‌য় সোচ্চার।’