Image description

ইসরাইলের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নাম বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু নয়, বরং সেটি হওয়ার কথা ছিল বেনিয়ামিন মিলেকোভস্কি। তার বাবা এই ভূখণ্ডে পুনর্বাসিত হওয়ার পরই পরিবর্তন হয় তাদের উপাধি। বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, ইহুদি অনেক শীর্ষ নেতারই জন্মের সময়কার নামের সঙ্গে বর্তমান নামের পার্থক্য আছে। মূলত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ফিলিস্তিনে আসার পর তারা জায়নবাদী নাম ধারণ করেন।

নেতানিয়াহুর দাদার নাম নাথান মিলেকোভস্কি। জন্মসূত্রে এই রুশ ছিলেন ইহুদিবাদী রাজনীতিক, পুরোহিত বা রাব্বি। সে হিসেবে পোল্যান্ডে জন্ম নেওয়া তার ছেলের (নেতানিয়াহুর বাবা) নাম ছিল বেনজিয়ন মিলেকোভস্কি। কিন্তু তিনি ফিলিস্তিনে বাধ্যতামূলক স্থানান্তরিত হওয়ার পর উপাধি পাল্টে নাম ধারণ করেন বেনজিয়ন নেতানিয়াহু। এরপর তার সব সন্তানের নামের সঙ্গে নেতানিয়াহু যুক্ত হয়, যার অর্থ ‘সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত’।

একইভাবে পরিচয় বদল করেন ইসরাইলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বেন গুরিয়ন। তার প্রকৃত নাম ছিল ডেবিড গুরিয়ন। ১৯১০ সালে নিজের পোলিশ নাম পরিবর্তন করে বেন-গুরিয়ন ব্যবহার শুরু করেন, যার অর্থ ‘সিংহশাবক’। ইসরাইলের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী মোশে শারেতের জন্ম ইউক্রেনে। ওই সময় তার নাম ছিল মোশে শেরতক। ১৯৪৯ সালে নাম বদলে ফেলেন তিনি।

ইসরাইলের প্রথম ও একমাত্র নারী প্রধানমন্ত্রী গোলদা মাইরও নিজের নাম পরিবর্তন করেছেন। ইউক্রেনে জন্ম নেওয়া এই রাজনীতিকের নাম ছিল গোল্ডি মাবোভিচ। বিয়ের পর বনে যান গোল্ডি মায়ারসন। ১৯৫৬ সালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার সময় আরেক দফা নিজের নাম পাল্টান তিনি। এরপর থেকে গোলদা মাইর নামেই পরিচিত হতে থাকেন।

আরেক সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইজহাক শামির। পোল্যান্ডে জন্ম নেওয়া এই রাজনীতিকের নাম ছিল ইৎজহাক ইয়াজিরনেস্কি। হিব্রু ভাষায় নাম রাখা অন্য রাজনীতিকদের মধ্যে এহুদ বারাক অন্যতম। জন্মের পর তার নাম ছিল এহুদ ব্রগ। হিব্রুতে বারাক নামের অর্থ ‘বজ্রের আলো’।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী অ্যারিয়েল শ্যারনের জন্মের সময়কার নাম ছিল অ্যারিয়েল শাইনারমান। এছাড়া পোল্যান্ডে জন্মানো শিমন পেরেসের নাম ছিল শিমেন পেরেস্কি। এদিকে ইউক্রেনের কিয়েভে জন্ম নেওয়া আরেক ইসরাইলি রাজনীতিক লেভি এশকলের নাম ছিল লেভি ইৎজহাক স্কুলনিক। সাবেক যুদ্ধমন্ত্রী মোশে দায়ানের পরিবারের নামে কিতাইগোরদস্কি পদবি ছিল।

নাম পরিবর্তনের এই ধরন শুধু ইসরাইলের শীর্ষ রাজনীতিক ও সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য স্তরেও। হলিউড অভিনেত্রী গাল গাদোতের পারিবারিক পদবি ছিল গ্রিনস্টেইন।

এটা কোনোভাবেই কাকতালীয় নয়, বরং একটি পদ্ধতিগত নীতি। ইসরাইল প্রতিষ্ঠার গোড়ার দিকে হিব্রু ভাষায় নাম পরিবর্তনের জোয়ার আসে। শুধু ১৯৪৮ ও ১৯৪৯ সালে ১৭ হাজার ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারী নিজেদের আসল নাম পাল্টে হিব্রু ভাষায় নাম রাখেন।

এই পদ্ধতিগত নীতির নাটের গুরু ছিলেন বেন-গুরিয়ন। সরকারি কর্মকর্তা ও কূটনীতিকদের নাম হিব্রু ভাষায় রাখার নির্দেশনা জারি করেন তিনি। এমনকি এই নীতির অগ্রগতি পর্যালোচনার জন্য ‘কমিটি ফর হিব্রু নেমস’নামের একটি কমিটিও গঠন করা হয়।

১৯৫৫ সালে স্কোয়াড্রন কমান্ডার থেকে চিফ অব স্টাফসহ সব আইওএফ কমান্ডিং অফিসারের অহিব্রু পদবি পরিবর্তন করে হিব্রু ভাষার নাম-পদবি ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেন বেন-গুরিয়ন।

যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন থেকে আসা প্রায় ১৫ শতাংশ বসতি স্থাপনকারী এখনো অধিকৃত ফিলিস্তিনে এসে হিব্রু ভাষায় নিজেদের নাম রাখেন। তবে এই পরিবর্তন কেন এত তাৎপর্যপূর্ণ? এটা ভালো করে বুঝতে হলে আধুনিক হিব্রু ভাষার উৎপত্তি নিয়ে গবেষণা করতে হবে। মূলত কথ্য ভাষা হিসেবে হিব্রুর মৃত্যু হয়েছে আজ থেকে এক হাজার ৭০০ বছর আগে। তখন শুধু ধর্মীয় আচারে ভাষাটি ব্যবহৃত হতো।

তবে হিব্রু ভাষা পুনরুজ্জীবিত হয় ইলিয়েজার বেন ইয়েহুদার হাত ধরে। ১৮৮১ সালে তিনি যে কট্টর দর্শন নিয়ে ফিলিস্তিনে আসেন, সেই দর্শনের লক্ষ্য ছিল হিব্রুকে পবিত্র ভাষা থেকে একটি জাতীয় ভাষায় রূপান্তর করা। প্রাচীন হিব্রু ভাষা পুনরুজ্জীবিত করতে বেশ কিছু কৌশল অবলম্বন করেন বেন-ইয়েহুদা।

বাইবেলে উল্লিখিত সুপ্ত হিব্রু শব্দ পুনরুদ্ধার, তালমুদিক সাহিত্য থেকে শব্দভাণ্ডার সংরক্ষণ এবং জার্মান ও ফরাসি ভাষা থেকে ধারণা ভাষান্তরের মতো কাজ করেন তিনি।

এছাড়া আরো উল্লেখযোগ্য কিছু কাজ করেন বেন-ইয়েহুদা। এর মধ্যে আরবি থেকে শব্দ ধার নেওয়া অন্যতম। কারণ, আরবি ও হিব্রু দুটোই সেমিটিক ভাষা এবং তাদের মৌলিক গঠন অনেকটা একইরকম। তবে কথ্য ভাষা হিসেবে অগণিত আধুনিক ধারণার জন্য শব্দভাণ্ডার ছিল আরবিতে, যা আদি হিব্রুতে নেই। যদিও আধুনিক হিব্রু ভাষার জন্ম কোনো ভাষাগত প্রকল্প ছিল না, বরং জায়নবাদী আদর্শের মৌলিক ভিত্তিপ্রস্তর ছিল।

বাস্তুচ্যুত ধর্মীয় গোষ্ঠী থেকে ইহুদিদের একটি ঐক্যবদ্ধ সেক্যুলার রাষ্ট্রের বাসিন্দায় রূপান্তরের প্রাথমিক প্রক্রিয়া ছিল হিব্রু। জায়নবাদের লক্ষ্য ছিল ইহুদি পরিচয়কে ধর্মীয় থেকে জাতীয়তাবাদে রূপান্তর।

প্রথাগত ইহুদি পরিচয় ধর্মীয় পর্যবেক্ষণ ও তোরাহ (ধর্মগ্রন্থ) চর্চার ওপর নির্ভরশীল। তবে এটিকে সেক্যুলার ও জাতীয়তাবাদের কাঠামোয় বদলানো প্রয়োজন ছিল জায়নবাদীদের। আর এ ক্ষেত্রে ভাষাগত ভিত্তি প্রদান করে হিব্রু। তাই ৬০ শতাংশ ইসরাইলি নিজেদের ধর্মহীন হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকে।

এছাড়া এটি বৈচিত্র্যময় ইহুদি জনগোঠীকে একত্রিত করে। ১৮৮০ সালের দিকে ইহুদিরা ইদিস, লাদিনো, আরবি, জার্মান, রুশ, ফরাসিসহ বিভিন্ন ভাষায় কথা বলত। তাই তাদের একটি নির্দিষ্ট ভাষা প্রয়োজন ছিল।

সে সময় ইদিসের পরিবর্তে হিব্রুকে বেছে নেওয়া ছিল সম্ভবত সবচেয়ে বিতর্কিত সিদ্ধান্ত। কারণ, ইদিস ছিল বেশিরভাগ পূর্ব ইউরোপীয় ইহুদিদের মাতৃভাষা এবং এর ছিল সমৃদ্ধ সাহিত্যিক ঐতিহ্য। তবে জায়নবাদীরা এটি প্রত্যাখ্যান করে। কারণ, জায়নবাদীরা যা থেকে মুক্তি চাইছিল, তার সবকিছুরই প্রতিনিধিত্ব করে ইদিস ভাষা। এমন অনেক সংগঠন ছিল, যারা সক্রিয়ভাবে ফিলিস্তিনে ইদিস ভাষাকে দমন করেছে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আধুনিক হিব্রু ভাষা জায়নবাদী রাজনৈতিক ন্যারেটিভের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ন্যায্যতা তৈরি করেছে। হিব্রুর পুনরুজ্জীবনের ফলে জায়নবাদীরা ফিলিস্তিনের অ-ইহুদিদের হাজার বছরের ইতিহাসকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে। একইসঙ্গে এই ভূখণ্ডে আধুনিক জায়নবাদী ও আদি ইহুদিদের অবস্থানের ধারাবাহিকতা নিয়ে বিতর্ক করতে পারে।

হিব্রু ভাষায় নাম পরিবর্তন মানে শুধু বসতি স্থাপনকারীদের পদবি পরিবর্তন নয়, বরং ভৌগোলিক স্থানের নামও পরিবর্তন; যাতে এ অঞ্চলে ফিলিস্তিনিদের বিচরণের ইতিহাস মুছে ফেলা যায়। বুদ্ধিজীবীরা একে ‘স্মৃতিহত্যা’ আখ্যা দিয়েছেন; অর্থাৎ ইচ্ছাকৃতভাবে মানুষের ইতিহাসের স্মৃতি মুছে ফেলা।

ফিলিস্তিনে হিব্রুতে অনেক নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। সেখানকার দুই হাজার ৭৮০টি ঐতিহাসিক স্থানের নাম বদলে ফেলা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৪০টি গ্রাম ও শহর, এক হাজার প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান, ৫৬০টি নদী ও উপত্যকা, ৩৮০টি ঝরনা এবং ১৯৮টি পাহাড়-পর্বতের নাম পরিবর্তন উল্লেখযোগ্য।

এর মধ্যে বেশ কিছু পরিবর্তন হয়েছে ধ্বনিগত; যেমন সোরা থেকে জোরা, আজুর থেকে আগুর। বাইবেলে থাকা শব্দও ব্যবহৃত হয়েছে নাম পরিবর্তনে। যেমনÑআক্কা থেকে আক্কো, ইয়াফা থেকে ইয়াফো। এসব নাম কখনো হিব্রু ভাষার ছিল না, বরং ক্যানানাইট (কেনানের) ভাষার। অনেক ক্ষেত্রে নতুন হিব্রু নাম তৈরি করা হয়েছে; যেমন উম আল-রাশরাশ থেকে ইলাত এবং ফিলিস্তিনি গ্রাম ম্লাবিস হয়ে গেছে পেতাহ তিকভা।

এই নাম পরিবর্তন স্থাপনা ধ্বংসের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত। ১৯৪৭ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত প্রায় ৪০০টি ফিলিস্তিনি গ্রামে জাতিগত নিধন চালানো হয়। অনেক গ্রামের স্থাপনা ধ্বংস করা হয় এবং হিব্রু নাম রাখা হয়।

ফিলিস্তিনিদের গ্রাম ধ্বংস করে সেখানে গড়ে তোলা হয় ইসরাইলি বনভূমি। এর মধ্য দিয়ে স্থাপনা ও ভাষা দুটোকেই পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়া হয়।

হিব্রুতে নাম পরিবর্তন ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক স্মৃতি মুছে ফেলার একটি ইচ্ছাকৃত প্রচেষ্টা। এর মধ্য দিয়ে আদি ক্যানানাইট, আরামিক ও প্রাক-ইসলামিক স্থানের নাম বদলে ফেলা হয় এবং ‘জায়নবাদী ন্যারেটিভ’ প্রতিষ্ঠা করা হয়।

ব্যক্তি ও স্থানের নাম হিব্রু ভাষায় পরিবর্তন সাংস্কৃতিক চৌর্যবৃত্তি এবং পরিচয় রূপান্তরের এক ব্যাপক কর্মসূচিরই ইঙ্গিত। এর মাধ্যমে শুধু নতুন নাম তৈরি করা হয়নি, বরং সেখানকার ভূমি, ইতিহাস ও সামষ্টিক স্মৃতির সঙ্গে মনগড়া সম্পর্ক তৈরি করা হয়েছে।

ভাষান্তর : শেখ আব্দুল্লাহ আল নোমান