যাচাই-বাছাইয়ে বাদ পড়েছে এবং নির্ধারিত সময়ে আবেদন করেনি—এমন অন্তত ২৫টি স্থানীয় পর্যবেক্ষক সংস্থাকে নিবন্ধন দেওয়ার প্রক্রিয়ায় নতুন করে অন্তর্ভুক্ত করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এরই অংশ হিসাবে ওইসব সংস্থার সার্বিক কার্যক্রম, প্রতিষ্ঠানসংশ্লিষ্টদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা, তাদের নামে মামলা বা অন্য কোনো নেতিবাচক কার্যক্রম রয়েছে কিনা-তা খতিয়ে দেখছে ইসি।
এর মধ্যে অন্তত চারটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেগুলো নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিবন্ধন পাওয়ার জন্য ইসিতে আবেদন করেনি। বাকি ২১টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা সংস্থার নেতিবাচক অনানুষ্ঠানিক প্রতিবেদন রয়েছে ইসির কাছে। তাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা, পর্যবেক্ষণ করার মতো সক্ষমতার ঘাটতিসহ বিভিন্ন তথ্য রয়েছে।
এ কারণে নির্বাচন কমিশন প্রকাশিত খসড়া তালিকায় ওইসব সংস্থাগুলোর নাম ছিল না। এসব সংস্থাকেও নিবন্ধন দেওয়ার প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া ইসি প্রকাশিত খসড়া তালিকায় থাকা ৭৩টি সংস্থার মধ্যে ১৯টি প্রতিষ্ঠানের বিষয়েও অধিকতর যাচাই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। সব মিলিয়ে ৪৪টি সংস্থার বিষয়ে মাঠপর্যায়ে খোঁজখবর নিচ্ছে কমিশন। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, পর্যবেক্ষক সংস্থা নিবন্ধন নিয়ে ‘বিব্রতকর পরিস্থিতি’ ও ‘প্রশ্নের মুখে’ পড়েছে নির্বাচন কমিশন। গত ২৮ সেপ্টেম্বর ৭৩টি পর্যবেক্ষক সংস্থার নাম প্রকাশ করে গণবিজ্ঞপ্তি দেয় ইসি। ওইসব সংস্থার বিষয়ে কারও দাবি, আপত্তি বা অভিযোগ থাকলে গত ২০ অক্টোবরের মধ্যে ইসিকে জানাতে বলা হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ওইসব প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে কেউ ইসিতে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ জমা দেননি। তবে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
এরপরই পর্যবেক্ষক সংস্থা নিবন্ধন কার্যক্রম নিয়ে এসব পদক্ষেপ নিল ইসি। তবে যে প্রক্রিয়ায় তালিকার বাইরের ২৫টি সংস্থা বাছাই করা হয়েছে, সেটা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে খোদ ইসির কর্মকর্তাদের। অবশ্য নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, নিয়ম অনুযায়ী খসড়া তালিকায় থাকা ৭৩টি পর্যবেক্ষক সংস্থার মধ্যে যেগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা হবে, তা শুনানি করে নিষ্পত্তি করার বিধান রয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় আরও কিছু পর্যবেক্ষক সংস্থা বাদ দেওয়া হলে আসন্ন নির্বাচনে সবচেয়ে কম সংখ্যক পর্যবেক্ষক সংস্থা নিবন্ধিত হবে, যা ইসি ও নির্বাচনের জন্য ভালো নয়। সর্বশেষ ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ৯৬টি, ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে ১১৮টি এবং ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচনে ১২০টি পর্যবেক্ষক সংস্থা নিবন্ধিত ছিল।
কমিশন আরও জানিয়েছে, নির্বাচন পর্যবেক্ষণে পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোকে নির্বাচন কমিশন থেকে টাকা দেওয়া হয় না। সুতরাং বেশি সংখ্যক পর্যবেক্ষক সংস্থা থাকলে তা কমিশনের জন্য সহায়ক। তবে পক্ষপাতদুষ্ট হলে নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন ওঠার সুযোগ তৈরি হয়। বাদ পড়া সংস্থা নিবন্ধন দেওয়ার উদ্যোগের বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, আমরা কিছু সংস্থার বিষয়ে মাঠপর্যায়ের খোঁজখবর নিতে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের চিঠি দিয়েছি। নতুন কিছু আবেদন পুনর্বিবেচনা করেছি। তিনি বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণে পর্যবেক্ষক সংস্থা বাড়লে তা খারাপ নয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েক জেলার নির্বাচন কর্মকর্তা যুগান্তরকে চিঠি পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তারা জানান, বুধবার বিকালে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের এ সংক্রান্ত চিঠি পেয়েছেন। ওই চিঠির সঙ্গে ওই জেলায় যেসব পর্যবেক্ষক সংস্থার ঠিকানা উল্লেখ রয়েছে, সেটির একটি তালিকা যুক্ত রয়েছে। তিন কার্যদিবসের মধ্যে তালিকায় থাকা সংস্থার বিষয়ে সরেজমিন তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করতে যাচ্ছে ইসি। আগামী ডিসেম্বর মাসের প্রথমার্ধে তফশিল ঘোষণা হতে পারে। প্রতিটি নির্বাচনে পর্যবেক্ষক সংস্থা পর্যবেক্ষণ করে ইসিতে প্রতিবেদন জমা দেয়। সাধারণত নির্বাচন ভালো নাকি খারাপ হয়েছে তা পর্যবেক্ষক সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে আসে।
নির্দিষ্ট সময়ের পরে জমা আবেদন বিবেচনায়
জানা গেছে, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গত ২৭ জুলাই পর্যবেক্ষক সংস্থা নিবন্ধনের আবেদন চেয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে ইসি। এতে ১০ আগস্টের মধ্যে আবেদন করতে বলা হয়। তখন ৩১৮টি আবেদন জমা পড়ে। নির্ধারিত সময় পার হওয়ার পর থেকে মধ্য অক্টোবর পর্যন্ত ২০টির বেশি আবেদন জমা পড়ে। ওইসব আবেদন যাচাই-বাছাই করে চারটি সংস্থাকে নিবন্ধনের জন্য অপেক্ষমাণ রেখেছে ইসি। ওই চারটি সংস্থা হচ্ছে- বাংলাদেশ সোসাইটি ফর দ্য চেঞ্জ অ্যাডভোকেসি নেক্সাস (বি-স্ক্যান), যুব একাডেমি, এসডিএস (শরীয়তপুর ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি) ও জনসেবা স্বেচ্ছাসেবী পল্লী উন্নয়ন সংস্থা। এ চারটি সংস্থার মধ্যে দুটি ঢাকার, একটি শরীয়তপুর ও আরেকটি কুষ্টিয়ার ঠিকানা উল্লেখ করেছে। এই চারটি সংস্থার বিষয়ে মাঠপর্যায়ে তদন্ত করতে সংশ্লিষ্ট জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের চিঠি দিয়েছে ইসি।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ সোসাইটি ফর দ্য চেঞ্জ অ্যাডভোকেসি নেক্সাসের (বি-স্ক্যান) নির্বাহী পরিচালক সালমা মাহবুব শুক্রবার যুগান্তরকে বলেন, আমরা প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করি। এজন্য নির্বাচন কমিশনকে বিশেষ বিবেচনায় নিবন্ধন দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছি। কমিশন তা বিবেচনা করছে। আমার সংস্থার বিষয়ে তদন্ত করে গেছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্ধারিত সময়ের পরে সম্ভবত মাসখানেক আগে আবেদন করেছি।
জনসেবা স্বেচ্ছাসেবী পল্লী উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক মো. আতিয়ার রহমান জানান, তার সংস্থার বিষয়ে বৃহস্পতিবার তদন্ত করেছেন নির্বাচন কর্মকর্তারা। তাদের প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সহায়তা করেছেন।
বাছাইয়ে বাদ পড়া ২১ সংস্থা নিবন্ধন প্রক্রিয়ায়
ইসি সূত্র জানিয়েছে, নিবন্ধনের জন্য ৩১৮টি আবেদনের মধ্যে ১২২টিকে নিবন্ধন দেওয়ার সুপারিশ করে এ সংক্রান্ত কমিটি। বাকি ১৯৬টি আবেদন বাতিল করে ওই কমিটি। এই ১২২টি সংস্থার বিষয়ে অনানুষ্ঠানিকভাবে গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে ইসি। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে, ৪৯টি সংস্থার বিষয়ে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা, নির্বাচন পর্যবেক্ষণের সক্ষমতা না থাকা, সংস্থার প্রধানদের বিরুদ্ধে মামলা ও বিভিন্ন ধরনের অনিয়মের নেতিবাচক তথ্য আসে। ওই তথ্যের ভিত্তিতে ৪৯টি সংস্থাকে বাদ দিয়ে ৭৩টি সংস্থার নামের খসড়া তালিকা প্রকাশ করে ইসি। বিভিন্ন গণমাধ্যমে ওই ৭৩টির মধ্যে বেশ কিছু সংস্থার কার্যক্রম ও কার্যালয় নিয়ে নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশিত হয়। ওই সংবাদ প্রকাশের পর পর্যবেক্ষক সংস্থা নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনে ইসি। খসড়া তালিকায় নাম না থাকা ৪৯টি সংস্থার মধ্যে ২১টির আবেদন পুনর্বিবেচনা করছে। ওই ২১টি সংস্থার বিষয়ে ইসির কর্মকর্তাদের দিয়ে তদন্ত করাচ্ছে কমিশন।
এই তালিকায় রয়েছে জাগো ফাউন্ডেশন ট্রাস্ট, আল-কুরআন প্রচার সংস্থা (আকপও) বাংলাদেশ, ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন অব দি রুরাল পূওর-ডরপ, শিল্ড (সোসাইটি ফর হিউম্যান ইম্প্রুভমেন্ট, এমপাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড লাস্টিং ডেভেলপমেন্ট), বাংলাদেশ মানবাধিকার সমন্বয় পরিষদ (বামাসপ), হেল্প সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন, কেরানীগঞ্জ হিউম্যান রিসোর্সেস ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি, ইন্টারন্যাশনাল আসফ লিগ্যাল এইড ফাউন্ডেশন, রুরাল ইকোনমিক সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (রেসডো), নেত্রকোনা সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এনএসডিও), রুরাল অ্যান্ড আরবান ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (রাউডো), গ্রামবাংলা জনকল্যাণ সংস্থা (জিবিজেকেএস), রাসটিক, বাঁচতে শেখো, এসো জাতি গড়ি, মানব উন্নয়ন কেন্দ্র (মউক) ও অ্যাসোসিয়েশন ফর সোসিও ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট (এসেড) ইত্যাদি।
জানতে চাইলে ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন অব দি রুরাল পুওর-ডরপ’র নির্বাহী পরিচালক এএইচএম নোমান যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচন কমিশনের বিজ্ঞপ্তি দেখে আমরা আবেদন করেছিলাম। কিন্তু ইসি গণমাধ্যমে যে ৭৩টির নাম প্রকাশ করেছে, সেখানে আমাদের সংস্থা ছিল না। ওই তালিকায় কেন ছিলাম না, সে বিষয়ে ইসি চিঠি দিয়ে কোনো কারণ জানায়নি। তখনো একটি গোয়েন্দা সংস্থা তদন্ত করেছিল। তিনি বলেন, এখন জানতে পারলাম নির্বাচন কমিশন তাদের তালিকা রিভিউ করছে। আমার সংস্থার বিষয়েও খোঁজ নিচ্ছে।
অধিকতর যাচাইয়ে তালিকায় থাকা ১৯ সংস্থা
ইসি সূত্র জানায়, নির্বাচন কমিশন যে ৭৩টি সংস্থার আপত্তি বা দাবি জানাতে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে, তার একটির বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আসেনি। তবে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ পর্যালোচনা করে ১৯টি সংস্থার বিষয়ে তদন্ত করতে সংশ্লিষ্ট জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের চিঠি দেওয়া হয়েছে।
ওই ১৯ সংস্থার মধ্যে রয়েছে—বাসাবো জনকল্যাণ সংস্থা (বি.জে.এস), ইয়ুথ ইনিশিয়েটিভ ফর সোসিও ইকোনমিক অ্যাকটিভিটি (ইসিয়া), ভলান্টারি রুরাল ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি (ভিআরডিএস), কমিউনিটি অ্যাসিসট্যান্স ফর রুরাল ডেভেলপমেন্ট (কার্ড) সংগতি সমাজ কল্যাণ সংস্থা, বিয়ান মনি সোসাইটি (বিএমএস), ডাক্তারবাড়ি সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন, মুক্তির বন্ধন ফাউন্ডেশন, অ্যাসোসিয়েশন ফর সোসিও ইকোনমিক অ্যাডভান্সমেন্ট (এসিয়া), আলোকিত সমাজকল্যাণ সংস্থা ও হেভেন সামাজিক উন্নয়ন সংস্থা। আরও আছে, দীপ্ত মহিলা উন্নয়ন সংস্থা (ডিএমইউএস), অগ্রযাত্রা সমাজ উন্নয়ন সংস্থা (এএসইউএস), সেন্টার ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট কুড়িগ্রাম; বিবি আছিয়া ফাউন্ডেশন; সার্ভিসেস ফর ইকুয়িটি অ্যান্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট (সিড) ইত্যাদি।