Image description
 

একসময় খুন-সন্ত্রাস ও আতঙ্কের জনপদ হিসেবে পরিচিত ছিল চট্টগ্রামের রাউজান। গত দুই যুগে ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা’ না থাকার অভিযোগ থাকলেও খুন-সন্ত্রাস থেকে অনেকটাই মুক্তি মিলেছিল। তবে গত এক বছরে ফের পুরনো চেহারায় ফিরে গেছে। আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বে এক বছরে ১২টি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। ‘মব সহিংসতা’য় নিহত হয়েছে আরও দুজন। সব মিলিয়ে গত ৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত রাউজানে ১৭ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। বেশিরভাগ খুনের হোতাই পুলিশের ধরাছোঁয়ার বাইরে।

সর্বশেষ গত শনিবার যুবদলকর্মী মুহাম্মদ আলমগীর আলমকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আত্মীয়ের বাড়িতে দাওয়াত খেয়ে মোটরসাইকেলে ফেরার সময় রাউজান পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের চারাবটতল বাজারসংলগ্ন কায়কোবাদ জামে মসজিদের সামনে তাকে গুলি করা হয়। এ সময় তার স্ত্রী-সন্তান পেছনের একটি অটোরিকশায় ছিলেন।

Kiswan

এর ১৯ দিন আগে রাউজান থেকে শহরে ফেরার পথে হাটহাজারীর মদুনাঘাটে সড়কের ওপর ফিল্মি স্টাইলে গাড়িতে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয় বিএনপিকর্মী আব্দুল হাকিমকে। রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন বিএনপির আট নেতাকর্মী, বাকি চারজন আওয়ামী লীগের। বিএনপির আটজন হলেন কমর উদ্দিন, মো. ইব্রাহিম, মানিক আবদুল্লাহ, মুহাম্মদ সেলিম, দিদারুল আলম, ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম, আলমগীর ও আব্দুল হাকিম। আওয়ামী লীগের চারজন হলেন আবদুল মান্নান, মুহাম্মদ ইউসুফ মিয়া, আবু তাহের ও মুহাম্মদ হাসান। এসব ঘটনার সাতটি ঘটে রাউজান থানা এলাকায়। বাকিগুলো আশপাশের থানা এলাকায় ঘটলেও রাউজানের স্থানীয় রাজনীতির আধিপত্যকে কেন্দ্র করেই ঘটে।

 

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, বিএনপির নিহতদের সবাই কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান (পদ স্থগিত) গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক গোলাম আকবর খন্দকারের অনুসারী। প্রতিটি ঘটনার জন্য তারা একে অপরকে দোষারোপ করে আসছেন। স্থানীয়দের মতে, কদলপুরসহ আশপাশের পাহাড়ি এলাকার মাটি ও বালুমহালের নিয়ন্ত্রণসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘিরে এসব ঘটছে।

এর নেপথ্যে রায়হান নামে একজনের নাম উঠে আসছে বারবার। সর্বশেষ আলমগীর হত্যার ঘটনাতেও রায়হানের সম্পৃক্ততার কথা শোনা যাচ্ছে। স্থানীয় এক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘কদলপুরে অনেকগুলো ইটভাটা, মাটি ও বালুমহাল আছে। একসময় আজিজ নামে আওয়ামী লীগের একজন এগুলো নিয়ন্ত্রণ করত। এখনও সে দল বদলে এলাকায় আছে। এটাকে কেন্দ্র করে রায়হানের সঙ্গে আজিজের দ্বন্দ্ব। আলমগীর সম্প্রতি আজিজের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরি করেছিল। এক মাস আগে আলমগীরকে হত্যার ঘোষণা দিয়েছিল রায়হান।’

এর আগে ৬ জুলাই কদলপুর বাজারের মধ্যে প্রকাশ্যে মুহাম্মদ সেলিম নামে এক যুবককে মুখের ভেতর গুলি করে হত্যা করা হয়। ২২ এপ্রিল সদর ইউনিয়নের গাজীপাড়ায় সিএনজি স্টেশন এলাকায় প্রকাশ্যে গুলি করে খুন করা হয় ইব্রাহিম নামে যুবদলের এক কর্মীকে। দুই ঘটনায় করা মামলার অন্যতম আসামি এই রায়হান।

কে এই রায়হান?

৫ আগস্টের পর চট্টগ্রাম মহানগরে একের পর এক খুনের নেতৃত্ব দিয়ে আলোচনায় আসা ছোট সাজ্জাতের ঘনিষ্ঠ সহযোগী রায়হানও একই সময়ে আলোচনায় আসে। সাজ্জাত গ্রেপ্তার হলেও রায়হান থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রায়হানের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম নগর ও জেলায় জোড়া খুনসহ ১৩টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ছয়টি হত্যা মামলা।

রাউজানের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে স্থানীয় এক বাসিন্দা প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এসব খুনখারাবি হচ্ছে। এসব নিয়ে সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত। একসময় মানুষ রাউজানের নাম শুনলেই ভয় পেত। মাঝখানে সেই অবস্থা বদলে গেলেও এখন আবার আগের পরিস্থিতি ফিরে আসছে।’

হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ আছে স্থানীয়দের। এসব ঘটনায় অস্ত্রধারী কিংবা মূল আসামিরা ধরা পড়ছে না। উদ্ধার হয়নি এসব হত্যায় ব্যবহৃত কোনো অস্ত্রও।

গত জুলাইয়ে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত একজনের বাবা আমির হোসেন। তিনি বলেন, অস্ত্রধারীরা একের পর এক প্রকাশ্যে গুলি করে খুনের ঘটনা ঘটাচ্ছে। কিন্তু পুলিশ তাদের ধরছে না।

রাউজান থানা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, রাউজানে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর ১৫টি হত্যা মামলা রেকর্ড হয়েছে। এর মধ্যে একটি পুরনো মামলা। বাকি ১৪টির মধ্যে সাতটি রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের জেরে ঘটেছে। দুটি ঘটনা ছিল মবের। এর মধ্যে একজনকে গরু চুরির দায়ে, অন্যজনকে মদ খেয়ে মাতলামির দায়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। দুটি মামলায় এর মধ্যে ফাইনাল রিপোর্ট দিয়েছে পুলিশ, বাকিগুলো তদন্তাধীন। এসব মামলায় ৩৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আদালতে আত্মসমর্পণ করেছে ১১ জন। যাদের চারজন আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে।

চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা পুলিশ সুপার (গণমাধ্যম) মো. রাসেল বলেন, পুলিশ ইতোমধ্যে অস্ত্রসহ অনেককে গ্রেপ্তার করেছে। বাকিদের ধরতে অভিযান চলছে।