বছরের পর বছর ধরে সঞ্চয়পত্র ছিল মধ্যবিত্তের সঞ্চয়ের নিরাপদ আশ্রয়। চাকরিজীবী থেকে প্রবাসী, ছোট ব্যবসায়ী থেকে অবসরপ্রাপ্ত অসংখ্য মানুষ ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা ভেবে টাকা রেখেছিলেন সরকারের এই স্কিমে। কিন্তু এখন সেই আস্থার জায়গাতেই দেখা দিচ্ছে ভাঙন। ব্যাংকে গিয়ে জমা তুলছেন অনেকে, ডাকঘরে ভিড় আর তেমন নেই। মানুষ সঞ্চয়পত্র কিনছেন কম, বরং পুরোনো বিনিয়োগ ভেঙে নিচ্ছেন বেশি।
সম্প্রতি প্রকাশিত জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের বিনিয়োগ রিপোর্ট অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে দেশের ডাকঘরগুলোতে সঞ্চয়পত্রে মোট জমা হয়েছে ৯৩৫ কোটি টাকা আর পরিশোধ হয়েছে ১ হাজার ২৭১ টাকা। অর্থাৎ যারা নতুন করে কিনেছেন, তার চেয়ে বেশি মানুষ এখনো পুরোনো সঞ্চয়পত্র ভেঙে নিচ্ছেন।
অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের (জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০২৫) তিন মাসে ডাকঘরগুলোর সঞ্চয়পত্রে মোট জমা হয়েছে ২ হাজার ৫৭১ কোটি টাকা আর পরিশোধ হয়েছে ৩ হাজার ৩৫৬ টাকা। এতে বোঝা যায় সাধারণ মানুষ আর সঞ্চয়পত্রের প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের আগস্টে সঞ্চয়পত্রে গ্রাহকদের নিট বিনিয়োগ ছিল ২ হাজার ৩৬ কোটি টাকা। কিন্তু চলতি বছরের আগস্টে তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২৮৯ কোটি টাকায়। অর্থাৎ এক বছরে বিক্রি কমেছে ৮৭ শতাংশেরও বেশি।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মানুষ এখন আর সঞ্চয় করতে পারছে না, বরং আগের সঞ্চয় ভেঙে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। আয় কমে যাওয়া, দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন বৃদ্ধি আর কর্মসংস্থানে ভাটার কারণে মধ্যবিত্তের হাতে বাড়তি টাকা নেই। মানুষ ভবিষ্যতের সুরক্ষার চেয়ে বর্তমান টিকে থাকাকেই এখন বেশি অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
তবে বিশ্লেষকরা সতর্ক করে বলছেন, মানুষ হাতে টাকা রাখছে, কিন্তু রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা আর বাজারের অনিশ্চিত পরিবেশে বিনিয়োগে ভয় পাচ্ছে। ফলে অর্থপ্রবাহ স্থবির হয়ে পড়ছে, যা অর্থনীতির জন্য ভালো লক্ষণ নয়।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক ড. মোস্তাফা কামাল মুজেরী বলেন, সঞ্চয়পত্র দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ ও স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য একটি নিরাপদ বিনিয়োগ মাধ্যম ছিল। সরকারি গ্যারান্টি আর তুলনামূলক বেশি সুদের কারণে এই খাতে আস্থা ছিল প্রবল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সরকার সঞ্চয়পত্রের ওপর নির্ভরতা কমাতে চাইছে। সুদহার কমানোর পরিকল্পনা করছে।
তিনি আরও বলেন, সরকার যদি সত্যিই সঞ্চয়পত্র থেকে সরে আসতে চায়, তবে বিকল্প বিনিয়োগের সুযোগগুলোকে সাধারণ মানুষের জন্য আকর্ষণীয় করতে হবে। শেয়ারবাজার বা বন্ডবাজার এখনো তাদের জন্য নিরাপদ নয়। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা বারবার ক্ষতির মুখ দেখেছে। ফলে তাদের কাছে সঞ্চয়পত্রই ছিল একমাত্র ভরসা। তার মতে, সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমানো রাজস্ব ভারসাম্যের জন্য সরকারের আর্থিক কৌশলের অংশ হতে পারে, তবে সামাজিক সুরক্ষা খাতকে শক্তিশালী না করলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে স্বল্প ও মধ্যবিত্তের ওপর।