অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণামতে, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। ইতোমধ্যে প্রাথমিক প্রস্তুতি শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন। তবে ভোট যত ঘনিয়ে আসছে, রাজনৈতিক জটিলতাও তত বাড়ছে- বিশেষ করে জুলাই জাতীয় সনদ ও তার ওপর গণভোট আয়োজনের প্রস্তাবকে ঘিরে।
জাতীয় ঐক্য কমিশন (এনসিসি) জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আগে জনগণের মতামত নিতে একটি গণভোট আয়োজনের সুপারিশ করেছে। এই প্রস্তাব রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তীব্র বিভাজন সৃষ্টি করেছে। জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) দাবি জানিয়েছে, নভেম্বরের মধ্যেই গণভোট আয়োজন করতে হবে এবং গণভোট ছাড়া কোনও জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে না।
অন্যদিকে বিএনপি প্রস্তাব করেছে, গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন একই দিনে অনুষ্ঠিত হতে পারে। তবে তার বিরোধিতা করেছে জামায়াত ও এনসিপি। দলটির নেতারা বলছেন, গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন একসঙ্গে করা উচিত নয়। দুই ভোট একসঙ্গে আয়োজন করলে নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও গণভোটের বৈধতা উভয়ই প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
জামায়াত ও এনসিপির শীর্ষ নেতারা হুঁশিয়ারি দিয়েছে বলেছেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে বিলম্ব হলে তারা ফেব্রুয়ারির নির্বাচন হতে দেবেন না। প্রয়োজনে নির্বাচন বয়কট বা স্থগিতের আন্দোলনে নামবেন বলেও সতর্ক করেছেন।
রংপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও গণহত্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন সম্ভব নয়। কেউ যদি মনে করে এককভাবে সরকার গঠন করবে, সেই সরকার এবং সংসদ টিকবে না। প্রথমে সনদ এবং ন্যায়বিচারের রূপরেখা প্রতিষ্ঠা করতে হবে, তারপর নির্বাচন।’
অন্যদিকে জামায়াতের নায়েবে আমির সায়েদ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের ঢাকায় এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের জন্য সংস্কারের ওপর আমরা যে গণভোট চাচ্ছি, তার জন্য সময় অত্যন্ত কম। প্রতিটা ঘণ্টা গুরুত্বপূর্ণ। (ঐকমত্য কমিশন) যে প্রস্তাব দিয়েছে, ইতোমধ্যে চার দিন পার হয়ে গেছে। আমরা আশা করেছিলাম, এ প্রস্তাবের পরের দিন একটা আদেশ জারি করবেন এবং গণভোটের প্রস্তুতি নেবেন, কিন্তু সরকার তা নেয়নি। সরকারের কোনও দুরভিসন্ধি আছে কিনা বুঝতেছি না।’
সময়ক্ষেপণ না করে অনতিবিলম্বে আদেশ জারির অনুরোধ করে জামায়াতের নায়েবে আমির বলেন, ‘অন্যথায় জনগণের আস্থা হারাবেন প্রধান উপদেষ্টা।’
এর আগে এই সপ্তাহে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন (এনসিসি) তাদের সুপারিশপত্র প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেয়। এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ ২০২৫’-এর দুটি খসড়া।
খসড়ায় বলা হয়েছে, সংবিধান-সংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো খসড়া বিল (সংবিধান সংশোধনী আইনের খসড়া) আকারে তৈরি করবে সরকার। বিলটি গণভোটে দেওয়া হবে। গণভোটে তা পাস হলে সংবিধান সংস্কার পরিষদ মূল ভাব ঠিক রেখে প্রস্তাবগুলো অনুমোদন করবে। আগামী সংসদ সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে ২৭০ দিনের মধ্যে তা অনুমোদন না করলে এগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে যুক্ত হয়ে যাবে।
খসড়ায় আরও ৪৮টি সাংবিধানিক সংস্কার প্রস্তাব করা হয়েছে, যার মধ্যে একটি হলো আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে (পিআর) উচ্চকক্ষ গঠন। এতে বলা হয়েছে, সরকার সিদ্ধান্ত নেবে আদেশ জারির সময় ও গণভোটের সময়- নির্বাচনের আগে নাকি পাশাপাশি।
এনসিসি একটি একক গণভোট প্রশ্ন প্রস্তাব করেছে, যেখানে ভোটাররা ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দিতে পারবেন। প্রস্তাবিত গণভোট অধ্যাদেশটি অনুমোদিত হলে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি হিসেবে কার্যকর হবে।
বিএনপি এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের আদেশ জারির এখতিয়ার সংবিধান অনুযায়ী অন্তর্বর্তী সরকারের নেই। গুলশানে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমরা অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করছি যে এসব সুপারিশ কেবল জাতিকে বিভক্ত করবে, ঐক্যের বদলে অনৈক্য সৃষ্টি করবে। মনগড়া যেকোনও সংস্কার প্রস্তাব গ্রহণ করলে জাতীয় জীবনে দীর্ঘমেয়াদে অকল্যাণ ডেকে নিয়ে আসতে পারে।’
আরপিওর ২০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে বলা হয়েছে, জোট করলেও ভোট করতে হবে দলীয় প্রতীকে
ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে অনিশ্চয়তা আছে কিনা- এমন প্রশ্নে ফখরুল বলেন, ‘আমরা এখনও বিশ্বাস করি, প্রধান উপদেষ্টা ঘোষিত সময়ের মধ্যেই নির্বাচন হবে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘জাতীয় ঐক্য কমিশন ঐক্য নয়, বিভাজন সৃষ্টি করছে। এর পেছনে গোপন উদ্দেশ্য আছে কিনা জানি না।’
যদিও বিএনপি প্রকাশ্যে নির্বাচনের সময়সূচি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেনি, দলের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা ব্যক্তিগতভাবে স্বীকার করেছেন যে দলটির ভেতরে অনিশ্চয়তার আশঙ্কা রয়েছে। তাদের ধারণা, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপিসহ কিছু দল ইচ্ছাকৃতভাবে গণভোট ইস্যুতে রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়াচ্ছে, যাতে নির্বাচন বিলম্বিত হয় বা এর বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ করা যায়।
দলের এক কেন্দ্রীয় সম্পাদক বলেন, ‘গণভোটের সময় নিয়ে এই অচলাবস্থা কৌশলগত। কিছু দল তাদের মাঠের কার্যক্রমের জন্য সময় নিতে নির্বাচন পিছিয়ে দিতে চায়।’
অন্য এক নীতিনির্ধারক সদস্য বলেন, ‘বিএনপি ফেব্রুয়ারির সময়সূচি মাথায় রেখে প্রস্তুতি নিচ্ছে, তবে বিকল্প পরিকল্পনাও তৈরি করছে। যদি নির্বাচন পিছিয়ে যায় বা গণভোট নিয়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়, দল রাস্তায় নামার জন্য প্রস্তুত থাকবে।’
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিজেও নির্বাচন সময়মতও অনুষ্ঠিত হবে কিনা, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বুধবার তার সরকারি বাসভবন যমুনায় এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে ইউনুস সতর্ক করে বলেন, ‘নির্বাচন বানচালের জন্য দেশের ভেতর থেকে, বাইরে থেকে অনেক শক্তি কাজ করবে। ছোটখাটো না, বড় শক্তি নিয়ে নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করবে। হঠাৎ করে আক্রমণ চলে আসতে পারে। এই নির্বাচন চ্যালেঞ্জিং হবে। যত ঝড় আসুক না কেন, আমাদের সেটা অতিক্রম করতে হবে।’
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার যদি এনসিসির প্রস্তাব চাপিয়ে দিতে চায়, জটিলতা বাড়বে। এখনই সরকারকে সব দলের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যদি সরকার দূরদৃষ্টি ও পরামর্শ নিয়ে কাজ করে এবং সব পক্ষের মধ্যে আস্থা গড়ে তোলে, তাহলে কিছু ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব। কিন্তু সরকারের নিরপেক্ষতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে সংকট আরও গভীর হবে এবং নির্বাচনের বৈধতাও হারাবে। তবে ফেব্রুয়ারির নির্বাচন সফলভাবে সম্পন্ন হলে, সমালোচনা সত্ত্বেও সরকার শেষ পর্যন্ত প্রশংসিত হবে।’
এবি পার্টির সভাপতি মজিবুর রহমান মঞ্জু সতর্ক করে বলেন, ‘বড় রাজনৈতিক দলগুলো যদি পুরোনো মনোভাব ও সংঘাতমূলক আচরণ না বদলায়, তাহলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। সেই ক্ষেত্রে নির্বাচন স্থগিত, বাতিল, এমনকি অন্তর্বর্তী সরকারের পদত্যাগ পর্যন্তও গড়াতে পারে।’
