বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের দৃশ্যমান অবনতি ঘটেছে। এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে অতীতের তুলনায় আরও বেশি কাছে টেনেছে চীন। দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা, বাণিজ্য, পারস্পরিক আদান-প্রদানসহ নানা উপায়ে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক অতীতের যেকোনও সময়ের চেয়ে বেড়েছে। ভিসা সুবিধা বাড়িয়ে যাতায়াত সহজ করার ফলে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের যোগাযোগ বেড়েছে। অতীতে চীন শুধু ব্যবসানির্ভর দেশের তালিকায় থাকলেও এখন সাংস্কৃতিক বিনিময়সহ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতেও মনোযোগ কেড়েছে দেশটি।
যোগাযোগ বাড়ানোর সূচনা একাধিক সফর ঘিরে
গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পর বাংলাদেশের সঙ্গে কৌশলগতভাবে সম্পর্ক উন্নয়নের প্রচেষ্টা চালানো শুরু করে চীন। সম্পর্ক উন্নয়নের প্রথম ধাপ হিসেবে দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক বিনিময় বাড়ানো হয়। এরই অংশ হিসেবে বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানায় চীনের কমিউনিস্ট পার্টি। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের তিন মাসের মাথায় গত বছরের ৭ নভেম্বর বিএনপি’র চার সদস্যের একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল চীন সফর করে। এই সফরের মাধ্যমে চীনা নেতৃত্বের সঙ্গে প্রাথমিকভাবে যোগাযোগ শুরু হয় নতুন করে।
এরপর ২৭ নভেম্বর প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের একটি প্রতিনিধিদল চীনের কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে বেইজিং সফর করে। ১৪ সদস্যের এই দলটির নেতৃত্ব দেন জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির ও সাবেক সংসদ সদস্য ড. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। এই দলে খেলাফত মজলিস, হেফাজতে ইসলাম, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন এবং বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির নেতারাও ছিলেন। চীনের সিনচিয়াং উইঘুর স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ পরিদর্শন ছিল এই সফরের অন্যতম প্রধান অংশ।
সফর শুরুর আগে ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন ইসলামি দলের নেতাদের সম্মানে এক বিদায় সংবর্ধনার আয়োজন করেন। সেখানে তিনি বলেন, বাংলাদেশ বর্তমানে এক “ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে” দাঁড়িয়ে। তিনি ঘোষণা দেন, চীন বাংলাদেশ সরকারের অন্তর্বর্তী কর্তৃপক্ষ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং সমাজের সব স্তরের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতা আরও গভীর করতে চাইছে। রাষ্ট্রদূতের ভাষায়, “এই সৌহার্দ্যপূর্ণ চীন সফরকে দুদেশের দলের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ানোর নতুন সূচনা বলে দেখা উচিত, যাতে চীন-বাংলাদেশ সার্বিক কৌশলগত অংশীদারত্ব আগামী দিনে আরও সুসংহত হয় এবং দুই দেশের জনগণ উপকৃত হন।” অর্থাৎ, আসন্ন দিনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যে পরিবর্তনই আসুক না কেন, চীন নিজেকে সব পক্ষের বিশ্বস্ত বন্ধু ও উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে উপস্থাপন করতে চাইছে।
এরপর এ বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক শ্রেণির প্রতিনিধিদের নিয়ে ২২ সদস্যের একটি ‘বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী’ প্রতিনিধিদল চীন সফর করে। এই দলের নেতৃত্ব দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান। এতে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠন ছাড়াও নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলন, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদ, খেলাফত মজলিস, জাতীয় দলসহ মোট আটটি দলের নেতা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক, ছাত্রনেতা ও সাংবাদিকরা ছিলেন।
১৩ দিনব্যাপী এই সফরে প্রতিনিধি দলটি বেইজিং, শানশি ও ইউনান প্রদেশে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন আধুনিক প্রযুক্তি কোম্পানি এবং অবকাঠামো প্রকল্প পরিদর্শন করে।
এর বাইরে পুনরায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে ৯ সদস্যের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল পাঁচ দিনের সফরে বেইজিং যান ২২ জুন। বিএনপির পর আগস্টে চারদিনের চীন সফরে যান জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) ৮ নেতা।
এছাড়া সাংবাদিকদের দুটি প্রতিনিধিদল আলাদাভাবে চীন সরকারের আমন্ত্রণে সেদেশ সফরে যান। এর মধ্যে একটি সফর আয়োজন করে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। এ সময় ২৩ জন সাংবাদিক সে দেশে যান। প্রধান উপদেষ্টার ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি আবুল কালাম আজাদ মজুমদার এ সফরের নেতৃত্ব দেন।
সফরের শেষ দিনে প্রতিনিধি দল কুনমিং থংরেন হাসপাতাল ও কুনমিং আই হাসপাতালসহ বিভিন্ন স্থাপনা পরিদর্শন করেন। এ সময় তারা অত্যাধুনিক চিকিৎসা সুবিধা এবং রোগী সেবার উচ্চমান প্রত্যক্ষ করেন। সাংবাদিকরা কুনমিং আই হাসপাতালও পরিদর্শন করেন, সেখানে লেজার সার্জারি, উন্নত ডায়াগনস্টিক ইমেজিংসহ বিশেষায়িত চক্ষু চিকিৎসা প্রযুক্তি ও পূর্ণাঙ্গ রোগী সেবা প্রত্যক্ষ করেন। এ সফরে চীনের স্বাস্থ্য অবকাঠামো সম্পর্কে প্রত্যক্ষ ধারণা পাওয়া গেছে এবং দুই দেশের চিকিৎসা সহযোগিতার নতুন সম্ভাবনা উন্মুক্ত হয়েছে বলে জানানো হয়। বাংলাদেশি সাংবাদিকরা ওয়ালভ্যাক্স বায়োটেকনোলজি কোং লিমিটেডও পরিদর্শন করেন, যেটি চীনের অন্যতম শীর্ষ ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান।
চীন ও বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উদ্যাপনের অংশ হিসেবে চীন সরকার বাংলাদেশি সাংবাদিকদের এই সফরে আমন্ত্রণ জানায়। সফরের শেষ দিনে প্রতিনিধি দল অ্যান্টি-জাপানিজ ওয়ার মেমোরিয়াল হল পরিদর্শন করেন এবং সন্ধ্যায় ইয়ুননান এথনিক ভিলেজে যান।
অন্যদিকে, চীনা দূতাবাস ঢাকায় বিভিন্ন জাতীয় অনুষ্ঠানে একাধিকবার ড্রোন শো আয়োজন করে। এই ড্রোন পরিচালনা শেখাতে চীনের খরচে ১১ জনকে সেদেশে প্রশিক্ষণ দিতে নিয়ে যাওয়া হয়।
এছাড়া, ২০২৪ সালের অক্টোবরে পিপলস লিবারেশন আর্মির যুদ্ধজাহাজ চি জিগুয়াং এবং জিং গ্যাংশানকে চট্টগ্রাম বন্দরে শুভেচ্ছা সফরের জন্য পাঠিয়েছিল চীন।
চীন সফরে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা
এই বছরের জানুয়ারিতে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন সরকারের পক্ষ থেকে প্রথম বিদেশ সফরে বেইজিং যান। সফরে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই’র সঙ্গে তার বৈঠক হয়। বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আগের সব সহযোগিতা অব্যাহত রাখার বার্তা দেওয়া হয়। এই বৈঠকে তৌহিদ হোসেন চীনের দেওয়া ঋণের সুদের হার কমানো ও পরিশোধ সময়সীমা বাড়ানোর অনুরোধ জানান। চীন ইতিবাচক সাড়া দিয়ে মেয়াদ বাড়াতে সম্মত হয়।
প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরে তাইওয়ানের স্বাধীনতার বিরোধিতা বাংলাদেশের
এই বছরের মার্চে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস দ্বিপাক্ষিক সফরে চীন যান। চীন সরকার চায়না সাউদার্ন এয়ারলাইন্সের একটি চার্টার্ড ফ্লাইট পাঠায় প্রধান উপদেষ্টার জন্য। ওই সফরে চীন-বাংলাদেশের মধ্যে ১টি অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহযোগিতা চুক্তি এবং ৮টি পৃথক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। পাঁচটি মৌলিক ক্ষেত্রে নতুন সহযোগিতার ঘোষণা দেওয়া হয়, যার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ আলোচনা শুরু করা, চীনের সহায়তায় একটি বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল চালু করা, মোংলা বন্দরের আধুনিকীকরণ ও সম্প্রসারণ, বাংলাদেশে একটি রোবোটিক ফিজিওথেরাপি ও পুনর্বাসন কেন্দ্র স্থাপন এবং একটি মোবাইল কার্ডিয়াক সার্জারি ইউনিট প্রদানের প্রতিশ্রুতি।
চীনা প্রেসিডেন্ট এই বৈঠকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেন এবং দুই দেশের অংশীদারিত্বকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেন। ফলশ্রুতিতে, দুই দেশ বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের অধীনে চলমান প্রকল্পগুলো গতিশীল করে আরও উচ্চমানের যৌথ উন্নয়ন প্রকল্প এগিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এছাড়া দুই দেশের যৌথ বিবৃতিতে বাংলাদেশ ‘এক চীন নীতি’র প্রতি দৃঢ় প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে। পাশাপাশি ‘তাইওয়ানের স্বাধীনতার বিরোধিতা করার কথাও জানিয়েছে ঢাকা। বাংলাদেশের অবস্থান হলো ‘গণপ্রজাতন্ত্রী চীন সরকার’ পুরো চীনের প্রতিনিধিত্বকারী একমাত্র বৈধ সরকার এবং তাইওয়ান চীনের ভূখণ্ডের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। চীনের মূল স্বার্থ এবং জাতীয় সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় চীনের প্রচেষ্টা সম্পর্কিত বিষয়গুলোতে বাংলাদেশ চীনকে সমর্থনের কথা জানায়।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক শুরু থেকে এ পর্যন্ত কখনও খারাপ হয়নি। তবে গত ১৫ বছর বাংলাদেশে ভারতের প্রভাব খাটানোর ফলে অনেক কাজের সুযোগ হারিয়েছে চীন। ৫ আগস্টের পর তারা সেই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরে দেশটির সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা চীন সফর করেছেন। চীন সরকারের আমন্ত্রণে অনুষ্ঠিত এসব সফরে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে নতুন গতির সঞ্চার হয়েছে এবং উন্নয়ন সহযোগিতার বিভিন্ন চুক্তি ও সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
চীনের কৌশল প্রসঙ্গে সাবেক একজন কূটনীতিক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “চীনের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে বেশ কিছু সফর হয়েছে। এরকম আগে হয়নি। বিশেষ করে গত আগস্টে সরকার পতনের পর দুই দেশ আরও কাছে এসেছে। যার ফলশ্রুতিতে ওই সফরগুলো হয়েছে। তবে চীনের পরিকল্পনার সব ক্ষেত্রই অর্থনৈতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট। বাংলাদেশ যদি সেদিকে ভারসাম্য মেনে চলতে পারে তাহলে তাতে ক্ষতি নেই।”
বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা সহজ করেছে চীন
চীনের ভিসা ব্যবসায়ীদের জন্য পেতে সুবিধাজনক হলেও তা এখন পর্যটক এবং চিকিৎসা নিতে আগ্রহীদের জন্য সহজ করা হয়েছে। বাংলাদেশিদের জন্য চীনা দূতাবাস চিকিৎসা ভিসার জন্য গ্রিন চ্যানেল চালু করেছে। এছাড়া ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করতে অনলাইনে আবেদন প্রক্রিয়া করে ভিসা ইস্যু করার ব্যবস্থা নিয়েছে চীন। এর ফলে আবেদনের জন্য ভিসা সেন্টারের লাইনে গিয়ে দাঁড়ানোর প্রয়োজন হয় না। সম্প্রতি চীনের ক্যান্টন ফেয়ারে অংশ নিতে এই বছর অনেক বাংলাদেশি চীনে গেছেন।
এদিকে বুধবার (২৯ অক্টোবর) ঢাকায় এক সেমিনারে চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেছেন, “আমার মতে চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক জনগণের কল্যাণে। বাংলাদেশের সরকার, রাজনৈতিক দল, রাজপথের জনগণের বিষয়ে আমরা মুগ্ধ। বাংলাদেশের জনগণের ওপর আমাদের বিশ্বাস রয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে দেখুন। গত মার্চে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস চীনে গিয়েছিলেন। ভুলে যাবেন না গুরুত্বপূর্ণ সফরটি ছাড়াও বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং এনসিপি নেতাদের তিনটি প্রতিনিধি দলের গুরুত্বপূর্ণ সফর হয়েছে চীনে। ওই তিন দলের নেতারাসহ আরও কিছু রাজনৈতিক দলের নেতারা চীন সফর করেছেন। তারা দুই দেশের মাঝে সহযোগিতা চান। এটাই চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের শক্তি। এই সম্পর্ক দুই দেশের জনগণের স্বার্থের ভিত্তিতে।”