রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সুইমিং পুলে সাঁতার কাটতে গিয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সায়মা হোসাইনের মৃত্যুর ঘটনায় প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। পানিতে ডুবে যাওয়ার ২০ মিনিট পর উদ্ধার, প্রশিক্ষকদের দায়িত্বে উদাসীনতা, চিকিৎসায় অসঙ্গতি, নিহত শিক্ষার্থীর শ্বাসকষ্টসহ কিছু অসঙ্গতি উঠে এসেছে প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদনের রিপোর্টে।
বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেন তদন্ত কমিটির সদস্যরা।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন- তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ও উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান, উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মাঈন উদ্দিন, ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ইফতিখারুল আলম মাসউদ, জনসংযোগ কর্মকর্তা অধ্যাপক আখতার হোসেন মজুমদারসহ তদন্ত কমিটির অন্যান্য সদস্য এবং রাকসু প্রতিনিধিরা ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।
প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদনের বর্ণনা করে কমিটির আহ্বায়ক ফরিদ উদ্দিন খান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতার প্রতিযোগিতা আয়োজনকারী শারীরিক শিক্ষা বিভাগের নিয়মানুযায়ী হলগুলোর সাঁতারু দলের জন্য একজন প্রশিক্ষক বাধ্যতামূলক। সব হলে একজন করে ক্রীড়া প্রশিক্ষকের পদ থাকলেও সায়মার হলে (মন্নুজান হল) ফাঁকা ছিল সেই পদ। এছাড়াও সায়মা ছিল না সাঁতার প্রতিযোগিতা দলের আনুষ্ঠানিক সদস্য। তবুও তিনি সুইমিংপুলে সাঁতার প্রশিক্ষণে অংশ নেন।
তিনি বলেন, সেদিন প্রশিক্ষণ ছিল আরও দুটি হলের শিক্ষার্থীদের। সেই হলের দুই প্রশিক্ষক উপস্থিত ছিলেন সুইমিংপুলে। তাদের সামনেই সাঁতারের অনুশীলন করছিলেন সায়মাসহ কয়েকজন শিক্ষার্থী। স্বাভাবিকভাবেই সবাই সাঁতার কাটলেও সবার চোখের আড়ালে হঠাৎ ডুবে যান তিনি। বিষয়টি টের পেয়ে তাকে পুল থেকে উপরে তুলতে সময় লেগেছে ২০ মিনিটের বেশি। বাইরে থেকে ছাত্রদের ডেকে এনে সায়মাকে পুল থেকে উদ্ধার করেন প্রশিক্ষকরা। উপরে তুলে তার বুকে চাপ দিয়ে পানি বের করার চেষ্টা করা হলেও তার মুখ দিয়ে পানির সঙ্গে খাবার বের হচ্ছিল।
চিকিৎসায় অসঙ্গতি ছিল উল্লেখ করে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রের চিকিৎসক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে পাঠানোর সুপারিশ করে। তবে সেখান থেকে রওনা করা অ্যাম্বুলেন্সে ছিল না কোনো অক্সিজেন সিলিন্ডার। আনা হয় জরুরি বিভাগে থাকা সিলিন্ডার। তাতেও ছিল না পর্যাপ্ত অক্সিজেন। সেটি বদলে গাড়ি প্রস্তুত করে রওনা হতেও লেগেছে ৮ মিনিট সময়। একটি সিলিন্ডারে কতটুকু অক্সিজেন আছে বা নেই সে সম্পর্কে কর্তব্যরত নার্সদের এবং ওয়ার্ডের কর্মকর্তাদের অভিজ্ঞতা ও চর্চা না থাকায় সেখানেও সময় নষ্ট হয়। তবে সায়মাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার ক্ষেত্রে ডাক্তার, নার্স এবং ওয়ার্ডের কর্মকর্তাদের চেষ্টা ছিল অনেক বেশি।
সায়মার শ্বাসকষ্টের সমস্যা ছিল বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা সায়মার পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি সায়মার শ্বাসকষ্টের সমস্যা ছিল। এর জন্য তিনি চিকিৎসাও নিয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। শ্বাসকষ্টের জন্য ইনহেলার ব্যবহার করতেন তিনি।
প্রাথমিক প্রতিবেদনে সুপারিশের বিষয়ে তিনি বলেন, প্রশিক্ষক এবং অন্যান্য শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিতে একজন শিক্ষার্থী সাঁতার কাটার সময় পানিতে তলিয়ে যাওয়া এবং প্রায় ২০ মিনিট পর তার বিষয়টি নজরে আসা প্রশিক্ষকদের দায়িত্বে উদাসীনতা প্রকাশ হয়েছে। পাড়ে দুইজন প্রশিক্ষক বসে নিজেরা গল্প করছিলেন। উনারা যদি এটা না করতেন হয়তো তাদের দৃষ্টিতে মেয়েটি থাকতেও পারত। তাই আমরা তাদের প্রশিক্ষক পদ থেকে প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছি। সুইমিংপুল তদারকির জন্য একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি নিয়োগ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া আশঙ্কাজনক রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার জন্য চিকিৎসা কেন্দ্রের জরুরি বিভাগে কর্মরতদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থারও সুপারিশ করা হয়েছে।
শিক্ষক হেনস্তার অভিযোগে শিক্ষার্থীদের ক্লাশ বর্জন
এদিকে তদন্ত প্রতিবেদন উপস্থাপনের সময় শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশ্নের উত্তর দেন কর্তৃপক্ষ। তবে একটি প্রশ্ন করাকে কেন্দ্র করে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আমিনুল ইসলামকে হেনস্তার অভিযোগে সিনেট ভবনেই স্লোগান শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। পরে তারা প্রশাসন ভবন তালাবদ্ধ করে বিক্ষোভ কর্মসূচি শুরু করেন। সন্ধ্যা ৭টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তারা সেখানে অবস্থান করছিলেন। তারা শিক্ষককে হেনস্তার ঘটনায় অভিযুক্তদের শাস্তির দাবিতে ক্লাস বর্জন এবং অনশন কর্মসূচিতে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
যাদের বিরুদ্ধে হেনস্তার অভিযোগ উঠেছে তারা হলেন- রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ইফতিখারুল ইসলাম মাসউদ, প্রক্টর অধ্যাপক মাহবুবর রহমান ও জনসংযোগ কর্মকর্তা অধ্যাপক আখতার হোসেন মজুমদার।
শিক্ষার্থীদের দাবি, সিনেট ভবনে তাদের বিভাগের ওই শিক্ষককে প্রশ্ন করতে বাধা দেন এবং হেনস্তা করেন ওই প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। তাদের স্থায়ী বহিষ্কার এবং সায়মার মৃত্যুর সুষ্ঠু তদন্ত করতে হবে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মাহবুবর রহমান বলেন, এ রকম কোনো ঘটনা সেখানে ঘটেনি। সংশ্লিষ্ট শিক্ষকই বিষয়টি ভালোভাবে বলতে পারবেন।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ইফতিখারুল ইসলাম মাসউদ ও জনসংযোগ কর্মকর্তা অধ্যাপক আখতার হোসেন মজুমদারের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তারা সাড়া দেননি।
এর আগে ২৬ অক্টোবর বিকালে সায়মা হোসাইনের মৃত্যুতে উপাচার্যের বাসভবন ঘেরাও করে আন্দোলন করেন শিক্ষার্থীরা। উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীব ৭২ ঘণ্টার মধ্যে প্রাথমিক তদন্ত ও ১০ দিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশের আশ্বাসে সেদিনের আন্দোলন প্রত্যাহার করেন শিক্ষার্থীরা। পরে তারা গত তিন দিন ক্লাশ-পরীক্ষা বর্জন করে প্যারিস রোডে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন।
বুধবার প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশের কথা থাকলেও তা করা হয়নি। এজন্য বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে তারা প্রশাসন ভবনের সামনে টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন।