Image description

আওয়ামী লীগের শাসনামলে গুমের মাধ্যমে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর বা ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্সের (ডিজিএফআই) সাবেক ডিজি মেজর জেনারেল (অব.) হামিদুল হককে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে রাজসাক্ষী হওয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়। কিন্তু সে প্রস্তাবে তিনি রাজি হননি বলে ট্রাইব্যুনাল, গুম কমিশনসহ একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গুমের অভিযোগ আমলে নেয়ার আগ মুহূর্তে হামিদুল হক অনানুষ্ঠানিকভাবে একটি মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালের দায়িত্বশীলদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেন। ওই সময় হামিদুল হক দাবি করেন, জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির প্রয়াত গোলাম আযমের ছেলে সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আযমীকে আয়নাঘরে রাখার বিরুদ্ধে তিনি অবস্থান নিয়েছিলেন। হামিদুল হক আরো দাবি করেন, আযমীকে আয়নাঘরে না রাখার জন্য তিনি সরকারের ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করেছিলেন। রাজসাক্ষী (অ্যাপ্রুভার) হয়ে এসব ঘটনা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তুলে ধরতে হামিদুল হককে পরামর্শ দেয়া হয় ট্রাইব্যুনাল-সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে। কিন্তু সে প্রস্তাবে হামিদুল হক রাজি হননি বলে সূত্র জানায়।

আবদুল্লাহিল আমান আযমীর সঙ্গেও চলতি বছরের মার্চ-এপ্রিলে যোগাযোগ করেন মেজর জেনারেল (অব.) হামিদুল হক। বিষয়টি বণিক বার্তাকে আযমী নিজেই নিশ্চিত করেছেন। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ডিজিএফআইয়ের সাবেক ডিজি হামিদুল হক ও সাইফুল আলম আমার সঙ্গে খুদে বার্তার মাধ্যমে যোগাযোগ করেন। চলতি বছরের মার্চ-এপ্রিলে হামিদুল হক আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। হজে গিয়ে উনি এবং ওনার স্ত্রী আমার মুক্তির জন্য দোয়া করেছিলেন বলেও জানান।’

হামিদুল হক তার মুক্তির জন্য উঁচু মহলে আবেদন করেছিলেন বলেও জানান আযমী। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘হামিদুল হক, সাইফুল আলম ও আহমেদ তাবরেজ শামস ডিজিএফআইয়ের ডিজি থাকাকালীন আমার মুক্তির জন্য চেষ্টা করেছিলেন। তারা ডিজির দায়িত্বে থাকাকালীন উচ্চপদস্থদের কাছে আমার বিষয়ে বলেছিলেন বলে চারজন ডিরেক্টর আমাকে জানিয়েছেন।’

এদিকে ৮ অক্টোবর গুমের ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ডিজিএফআইয়ের সাবেক পাঁচ মহাপরিচালকসহ ৩০ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নিয়ে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। সে তালিকায় রয়েছেন জেনারেল (অব.) হামিদুল হকও। গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হওয়া আসামিদের গ্রেফতার করে ২২ অক্টোবর হাজির করতে বলা হয়েছিল। আসামিদের মধ্যে সেনা হেফাজতে থাকা ১৫ সেনা কর্মকর্তাকে ২২ অক্টোবর ট্রাইব্যুনালে আনা হলেও হাজির হননি হামিদুল হক।

প্রসঙ্গত, একজন অপরাধী, যিনি অপরাধের দায় স্বীকার করেন, অপরাধ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ সত্য তথ্য আদালতের কাছে প্রকাশ করেন, অন্য অপরাধীদের অপরাধেরও বিবরণ দেন, তখন আদালত এ অপরাধীকে ক্ষমা করতে পারেন। এ ব্যক্তিকেই রাজসাক্ষী বলে। চলতি বছরের ১০ জুলাই মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় রাজসাক্ষী হন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। রাজসাক্ষী হয়ে আদালতের সামনে ঘটনাগুলোর বিস্তারিত বর্ণনা তুলে ধরেন পুলিশের সাবেক এ মহাপরিদর্শক।

এ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামীম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট ঘটনা সম্পর্কে জানেন এমন আসামিরা রাজসাক্ষী হতে পারেন। আদালতে যখন অভিযোগ গঠন করা হয় তখন আসামিকে অভিযোগ পড়ে শোনানো হয়। আসামি দোষ স্বীকার করার পর অ্যাপ্রুভার হওয়ার জন্য ট্রাইব্যুনালে মৌখিকভাবে আবেদন করতে পারেন। পরবর্তী সময়ে লিখিত আবেদন করতে হয়। এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এরই মধ্যে ট্রাইব্যুনালে রাজসাক্ষী হয়েছে। অ্যাপ্রুভার হওয়ার পর ওই ব্যক্তি একই সঙ্গে আসামি এবং সাক্ষী হয়ে যান। অ্যাপ্রুভার হওয়ার ক্ষেত্রে প্রসিকিউশনের কোনো কার্যক্রম নেই। এটি কেবল ট্রাইব্যুনাল ও আসামির বিষয়।’ তিনি আরো বলেন, ‘অ্যাপ্রুভার হওয়ার শর্ত দুটি—তিনি যা জানেন পুরো ঘটনা জানাতে হবে এবং সত্যটা সামনে আনতে হবে। ট্রাইব্যুনাল যদি মনে করে একটি শর্ত পূরণ হয়েছে, অন্যটি হয়নি তাহলে ক্ষমা করবেন না। সুতরাং আমাদের আইনে ক্ষমা পাবেই এমন কোনো বিষয় নেই। বলা আছে, ক্ষমা করে দিতে পারেন। অর্থাৎ ট্রাইব্যুনাল চাইলে ক্ষমা করে দিতে পারেন। তবে দেশের প্রচলিত আইনে ক্ষমা করার বাধ্যবাধকতা আছে। যে-জন্য এরশাদ সিকদারের মামলায় অ্যাপ্রুভারকে সম্পূর্ণ ক্ষমা করে দেয়া হয়।’

তবে ট্রাইব্যুনাল-সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে হামিদুল হকের রাজসাক্ষী হওয়ার প্রস্তাবের বিষয়টি অস্বীকার করেন গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামীম।

উল্লেখ্য, ২০২২ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ১২ আগস্ট পর্যন্ত ডিজিএফআইয়ের মহাপরিচালক ছিলেন মেজর জেনারেল (অব.) হামিদুল হক। ডিজিএফআই থেকে সরিয়ে দেয়ার মাস খানেক পর ২০২৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। ১৯৭০ সালে কক্সবাজারে জন্মগ্রহণ করা হামিদুল হক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন ১৯৮৮ সালে। প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৯০ সালের ২২ জুন সেনাবাহিনীর ইনফ্যান্ট্রি কোরে কমিশন পান তিনি। মেজর জেনারেল (অব.) হামিদুল হক সিলেটে ১৭ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি এবং সিলেটের এরিয়া কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। এছাড়া পদ্মা সেতুর নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ৯৯ কম্পোজিট ব্রিগেড এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে ২০৩ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। এছাড়া তিনি ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজের কলেজ সেক্রেটারি এবং কলেজের গভর্নিং বডির সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।