স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সব সময় যোগ্য শিক্ষক ধরে রাখার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে বলে জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) পে প্রপোজাল কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. এম. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘অনেক শিক্ষক উচ্চ বেতন বা সুবিধার জন্য বেসরকারি ও বিদেশি প্রতিষ্ঠানে চলে যান। এ প্রবণতা এখন ব্যাপক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। গত দুই দশকে ফাইন্যান্স বিভাগের ৪০ জন শিক্ষক উচ্চতর ডিগ্রির জন্য বিদেশে গেছেন, তন্মধ্যে মাত্র তিন জন শিক্ষক দেশ ফিরেছেন।
মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের অধ্যাপক আব্দুল মতিন চৌধুরী ভার্চুয়াল ক্লাসরুমে সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের পে প্রপোজাল কমিটির আহবায়ক ও কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. এম. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। প্রস্তাবিত বেতন কাঠামোতে পর্যায়ক্রমিক পদোন্নতি, প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা ও কর্মদক্ষতার ভিত্তিতে ইনসেনটিভ রাখায় শিক্ষকরা দীর্ঘমেয়াদে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি অনুগত থাকবেন এবং ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে বলে উল্লেখে করেছেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রস্তাবনা জাতীয় বেতন কমিশনের সভাপতির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ তথ্য জানিয়ে লিখিত বক্তব্যে অধ্যাপক ড. এম. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের একাডেমিক প্রকাশনা আশঙ্কাজনকভাবে কম। ২০২৪ সালের সিমাগো তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ মাত্র ১৪ হাজার ৯৬৬টি উদ্ধৃতিযোগ্য অ্যাকাডেমিক আর্টিকেল প্রকাশ করেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় তার আকারের দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন। প্রতি ১ লাখ জনসংখ্যায় মাত্র ৯টি গবেষণাপত্র নিয়ে বাংলাদেশ অঞ্চলের সকল প্রতিবেশী দেশ থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে: ভূটান (৩১), ভারত (২২), শ্রীলংকা (১৯), পাকিস্তান (১৬), এবং নেপাল (১২)।
এমনকি কাজাকিস্তান, উজবেকিস্তান, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম এবং ইন্দোনেশিয়া বাংলাদেশ থেকে বেশি স্কোপাসভূক্ত গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করছে জানিয়ে তিনি বলেন, এ হতাশাজনক পরিস্থিতি শিক্ষকদের অপর্যাপ্ত বেতন এবং গবেষণা প্রণোদনা সংকটের সরাসরি ফলাফল। এটি প্রমাণ করে যে, এ ধারা পরিবর্তনের জন্য বেতন, ভাতা ও গবেষণা প্রণোদনা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করা জরুরি প্রয়োজন।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য প্রস্তাবিত ২০২৫ সালের বেতন কাঠামোটি দেশের পরিবর্তিত সামাজিক-অর্থনৈতিক ও উচ্চশিক্ষার প্রেক্ষাপটে ন্যায্যতা, প্রতিযোগিতা ও টেকসই উন্নয়নের নীতির উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। এটি জাতীয় বেতন কাঠামো ২০১৫-এর মূল ভাব বজায় রেখে বর্তমান মূল্যস্ফীতি, বাজারের প্রতিযোগিতা এবং উচ্চশিক্ষার সম্প্রসারিত ভূমিকার সাথে সামাস্য আনতে প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রস্তাবের উদ্দেশ্য হলো শিক্ষকদের অবদানকে যথাযথ মূল্যায়ন করা, পেশাগত মর্যাদা বজায় রাখা এবং শিক্ষাদান, গবেষণা ও উদ্ভাবনে নেতৃত্ব ধরে রাখতে বৈশ্বিক মানের সঙ্গে সামজস্য স্থাপন করা।
এক দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতি ধারাবাহিকভাবে এগিয়েছে। জিডিপি বৃদ্ধি, দ্রুত নগরায়ন এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায়। বিশেষ করে ঢাকায় বসবাস বায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। বাড়ি ভাড়া, পরিবহন ও শিক্ষা খরচসহ মূল্যস্ফীতির কারণে ২০১৫ সালের বেতন কাঠামোর প্রকৃত মূল্য অনেকটাই কমে গেছে। তাই ২০১৫ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে বাজার ও মূল্যস্ফীতির প্রবণতা বিবেচনায় প্রস্তাবিত বেতন কাঠামোতে প্রায় তিন গুন পর্যন্ত বেতন বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়েছে। এর ফলে শিক্ষকরা সম্মানজনক জীবনযাপন বজায় রাখতে পারবেন এবং আর্থিক চিন্তা ছাড়াই তাঁদের একাডেমিক কাজে মনোনিবেশ করতে পারবেন বলে উল্লেখ করা হয়।
অধ্যাপক ড. এম. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের প্রাচীনতম ও শ্রেষ্ঠ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতির মানসিক ও জ্ঞানভিত্তিক অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এখানকার শিক্ষকরা কেবল পাঠদানই করেন না, তাঁরা গবেষণা, উদ্ভাবন ও নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রেও নেতৃত্ব দেন। তাই যোগ্য ও মেধাবী শিক্ষক আকর্ষণ ও তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পেশায় ধরে রাখতে একটি প্রতিযোগিতামূলক ও ন্যায্য বেতন কাঠামো অপরিহার্য। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান ধরে রাখতে এবং জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখতে সহায়তা করবে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ও আইইউবি এর মতো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উচ্চ বেতন ও সুবিধা প্রদান করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর ফলে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগে প্রতিযোগিতা বেড়ে গেছে। প্রস্তাবিত বেতন কাঠামো এ ব্যবধান কমিয়ে আনতে কাজ করছে, বিশেষ করে মধ্য ও জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের ক্ষেত্রে, যাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন কাঠামো বেসরকারি ও আঞ্চলিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। এর মাধ্যমে শিক্ষকরা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে থেকে দেশের জন্য কাজ করতে আগ্রহী হবেন।
তিনি আরও বলেন, এ কাঠামোতে গবেষণা ও কর্মদক্ষতার ভিত্তিতে পারিশ্রমিক বৃদ্ধির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। যারা গবেষণা, প্রকাশনা ও সামাজিক অংশগ্রহণে সাফল্য দেখাবেন, তাঁরা গবেষণা ভাতা, অ্যাকাডেমিক ভাতা, সম্মেলন অনুদান ও বার্ষিক পুরস্কারের মতো প্রণোদনা পাবেন। এতে শিক্ষকরা গবেষণায় আরও উৎসাহী হবেন এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও স্বীকৃতি বাড়বে।
শিক্ষকদের জন্য মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপন নিশ্চিত করা এ প্রস্তাবের অন্যতম লক্ষ্য দাবি করে অধ্যাপক ড. এম. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, এতে গৃহভাড়া ভাতা (মূল বেতনের ৫৫ শতাংশ), চিকিৎসা, ঢাকা শহরের জন্য সিটি অ্যালাউন্স, ডোমেস্টিক এইড ভাতার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, যা ঢাকায় বাস্তব জীবনযাত্রার ব্যয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এসব সুবিধা শিক্ষকদের আর্থিক চাপ কমাবে এবং তাঁদের একাডেমিক ও গবেষণায় মনোযোগ বাড়াবে।
তার ভাষ্য, এ প্রস্তাব জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির লক্ষ্য পূরণের সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন যদি আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক মানের সঙ্গে তুলনাযোগ্য হয়, তবে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় আরও প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান তৈরি করতে পারবে।