Image description

খাগড়াছড়ির বর্মাছড়িতে ইউপিডিএফ (প্রসিত খীসা/মূল) এর নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা ও রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত তথ্য জানিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)। সাম্প্রতিক সময়ের বিভিন্ন ঘটনার কথাও তুলে ধরা হয়।

সোমবার (২৭ অক্টোবর) আইএসপিআর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, গত ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে খাগড়াছড়ির রামসু বাজার এলাকায় ইউপিডিএফ সশস্ত্র সদস্যদের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলিতে তিনজন পাহাড়ি যুবক নিহত হয়। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পার্বত্য অঞ্চলের দুর্গম যেসব এলাকায় সেনাবাহিনীর ক্যাম্প নেই, সেসব এলাকায় দীর্ঘমেয়াদী অভিযানের পরিকল্পনা করা হয়। 

অভিযানের প্রস্তুতি হিসেবে গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষণে জানা যায় যে, বিগত ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে ইউপিডিএফ এর সশস্ত্র ক্যাডারের সদস্যরা খাগড়াছড়ির দুর্গম বর্মাছড়ি এলাকার বিভিন্ন পাড়া থেকে এসে রামসু বাজার এলাকায় সেনাবাহিনী এবং সাধারণ জনগণের ওপর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দ্বারা গুলি চালায়। 

প্রাপ্ত গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে পার্বত্য অঞ্চলের অন্যান্য এলাকার মতো খাগড়াছড়ির বর্মাছড়ি এলাকায় গত ১৮ অক্টোবর ২০২৫ থেকে সেনাবাহিনী অভিযান পরিচালনা শুরু করে। অভিযানের অংশ হিসেবে সেনাবাহিনীর টহল দল মূল ক্যাম্প থেকে দূরবর্তী স্থানে অস্থায়ী পেট্রোল বেস স্থাপন করে বর্মাছড়ি এলাকা থেকে ইউপিডিএফ এর সশস্ত্র দলসমূহকে নির্মূল করার জন্য প্রয়োজনীয় আভিযানিক কার্যক্রম শুরু করে।  

বর্মাছড়িতে সেনা অভিযান চলাকালে সেনা টহল দল একটি খালি জঙ্গলকীর্ণ এলাকায় অস্থায়ী পেট্রোল বেস স্থাপন করে, যা কিনা বন বিভাগের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের খিরাম অংশের জমির অন্তর্ভুক্ত এবং বর্মাছড়ি আর্য কল্যাণ বিহার হতে ৫০০ মিটার পশ্চিম দিকে অবস্থিত।

বর্মাছড়িতে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি এবং অভিযানের কারণে ইউপিডিএফ এর সশস্ত্র ক্যাডারসমূহ পাড়া থেকে দ্রুত সরে গিয়ে দুর্গম কালাপাহাড় এলাকায় এবং পার্বত্য অঞ্চলের বাইরে ফটিকছড়ির দুর্গম অঞ্চলে অবস্থান নেয়।

দীর্ঘমেয়াদী সেনা অভিযানের কারণে খাগড়াছড়িতে আগামী মাস গুলিতে ইউপিডিএফ এর চাঁদা আদায় কার্যক্রম এবং নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কায় তারা জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে অস্থায়ী সেনা পেট্রোল বেস স্থাপনের বিরুদ্ধে চিরাচরিত কৌশল হিসেবে এলাকার জনগণ, নারী ও শিশুদের জোরপূর্বক জমায়েত করে আন্দোলন শুরু করে। 

বনবিভাগের সংরক্ষিত জমিতে স্থাপিত অস্থায়ী পেট্রোল বেসের স্থানটিকে বর্মাছড়ি আর্য কল্যাণ বিহারের অংশ হিসেবে দাবি করে একই সঙ্গে তারা দেশ-বিদেশ থেকে ব্যাপক অনলাইন প্রোপাগান্ডা এবং পার্বত্য অঞ্চলে যেখানে ইউপিডিএফ এর আধিপত্য আছে এমন সব এলাকায় পোস্টার লাগিয়ে পাহাড়ি জনগণকে উত্তেজিত করে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করে।

এরই ধারাবাহিকতায় ইউপিডিএফ এর নেতৃত্বে ২৪ অক্টোবর তারিখে বর্মাছড়ি অস্থায়ী পেট্রোল বেসের কাছে আনুমানিক ১০০০ জন নারী, শিশু ও পুরুষদের জমায়েত করে এবং সেনা সদস্যদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে। তারা বর্মাছড়িতে স্থাপিত অস্থায়ী পেট্রোল বেস আর্য কল্যাণ বিহারের অন্তর্ভুক্ত বলে দাবি করে এবং সেনাবাহিনী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করে, কিন্তু তাদের দাবির স্বপক্ষে কোনো প্রকার প্রমাণাদি উপস্থাপনে ব্যর্থ হয়। 

খাগড়াছড়ির বর্মাছড়ি এলাকাটি একটি পাহাড়ি অধ্যুষিত এলাকা এবং নিকটবর্তী স্থানে কোনো সেনা ক্যাম্প না থাকার কারণে ইউপিডিএফ দীর্ঘ সময় ধরে সশস্ত্র দলের ক্যাম্পসহ বিভিন্ন পর্যায়ে নিজেদের শক্ত অবস্থান গড়ে তুলেছে। একইসঙ্গে বর্মাছড়ি এলাকাটি পার্বত্য চট্টগ্রামের সঙ্গে সমতলের যোগসূত্র হওয়ার কারণে দীর্ঘদিন ধরে দেশের অভ্যন্তরে ইউপিডিএফ এর অস্ত্র চোরাচালানের রুট হিসেবেও ব্যবহার হয়ে আসছে। 

বিভিন্ন গোয়েন্দা তথ্য এবং ইউপিডিএফ এর বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের কার্যক্রম পর্যালোচনা করে জানা যায় যে, ইউপিডিএফ (প্রসিত বিকাশ খীসা/মূল) এর সশস্ত্র দলের অর্থ সম্পাদক অর্কিড চাকমা বর্মাছড়ি এলাকার নেতৃত্ব পর্যায়ের একজন নেতাকে সেনা পেট্রোল বেসটি আর্য কল্যাণ বিহারের জমি না হওয়া সত্ত্বেও এলাকার হেডম্যান উক্ত জায়গাটি ‘ব্যাকডেট’ (আগের তারিখ) দিয়ে কিয়াং ঘরের (আর্য কল্যাণ বিহার) জন্য দলিল তৈরি করে লিখে দেবে বলে জানায়। অর্কিড চাকমা একইসঙ্গে এই বিষয়ে ভিক্ষু সংঘ কর্তৃক বিবৃতি দেওয়া হবে বলে উক্ত স্থানীয় নেতাকে বিহারে বড় পরিসরে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য নির্দেশনা প্রদান করে।

গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষণে আরো জানা যায়, ইউপিডিএফ নেতা প্রসীত বিকাশ খীসা সেনাবাহিনীর অভিযানকে বিতর্কিত করে তুলতে আগামী ২৭-৩০ অক্টোবর ২০২৫ তারিখের মধ্যে আর্য কল্যাণ বিহারে নাশকতার উদ্দেশে বড় আকারে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করার নির্দেশ দেয়। 

এই ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জন্য ১০ থেকে ১৫ হাজার পাহাড়ি জনগণকে বিভিন্ন এলাকা থেকে জোরপূর্বক যোগদান করতে বাধ্য করা হবে বলে অর্কিড চাকমা বর্মাছড়ির নেতৃত্ব স্থানীয় একজন পাহাড়িকে অবগত করে এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন।

গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষণে আরও জানা যায় যে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি বিভাগের অধ্যাপক এবং খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলার জ্যোতিমারা বুড্ডিস্ট ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের একজন ধর্মীয় নেতা উক্ত ধর্মীয় অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে সেনাবাহিনীর অভিযানকে বিতর্কিত করতে প্রয়োজনীয় বক্তব্য ও সমর্থন প্রদান করবেন। 

উক্ত অনুষ্ঠানকে সফল করে তুলতে তারা পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় আর্য কল্যাণ বিহারের পক্ষ থেকে আগামী ২৯ অক্টোবর ২০২৫ তারিখে বিভিন্ন গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে ধর্মীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের লিফলেট (অনলাইন এবং অফলাইন) বিতরণ শুরু করে। একই সময়ে ইউপিডিএফ এর দেশি-বিদেশি অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট এবং সমমনা ধর্মীয় নেতারা সেনাবাহিনী এবং বাঙালিদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন বিদ্বেষমূলক এবং উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রদান করা শুরু করেন। 

পরিস্থিতির সামগ্রিক বিশ্লেষণে এটা সুনিশ্চিতভাবে বলা যায়, ইউপিডিএফ বিগত ২৩-৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখ পর্যন্ত খাগড়াছড়ি এবং রামসু বাজার এলাকায় নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের আদলে পুনরায় পার্বত্য অঞ্চলকে অশান্ত করা এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংগঠনের একটি রাষ্ট্রদ্রোহী এবং নাশকতামূলক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে। ইউপিডিএফ এর শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা (যারা সকলে ঢাকায় এবং দেশের অন্যান্য অঞ্চলে আত্মগোপনে আছেন) অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে দেশের অভ্যন্তরে রাষ্ট্রবিরোধী শক্তি, বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক শক্তির পরিকল্পনায় ও আর্থিক সহায়তায় ‘মৃতদেহের রাজনীতি’ (Politics of body bags) এবং ঘৃণার রাজনীতিকে (Hate politics) পুঁজি করে পার্বত্য অঞ্চলকে অশান্ত করে তোলার প্রয়াসে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।

প্রতিটি ক্ষেত্রেই তারা সুচিন্তিতভাবে নারী, শিশু এবং যুবক শ্রেণিকে ঢাল (Human shield) হিসেবে ব্যবহার করছে। নারী ও শিশুদের বিক্ষোভ এবং আন্দোলনের অংশ হিসেবে ব্যবহারের কারণে সেনাবাহিনীর মাঠ পর্যায়ের নেতৃত্বকে ইউপিডিএফ এর সশস্ত্র ক্যাডারদের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রে অপরিসীম ধৈর্য্য ও বিচক্ষণতা পরিদর্শন করতে হচ্ছে।

সেনাবাহিনীর এই সীমাবদ্ধতাকে কাজে লাগিয়ে ইউপিডিএফ এর শীর্ষ নেতৃত্ব (প্রসিত বিকাশ খীসা, মাইকেল চাকমাসহ আরো অনেকে) পার্বত্য অঞ্চলকে এক অনিবার্য সংঘাতময় অঞ্চলে রূপ দেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। 

এই পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য ইউপিডিএফ এর সশস্ত্র ক্যাডার নিজ জাতিগোষ্ঠীর জনগণের ওপর গুলি চালিয়ে হত্যা করার মতো জঘন্য কার্যক্রমের দায়ভার সেনাবাহিনীর ওপর চাপিয়ে সম্পূর্ণ বিষয়টিকে আন্তর্জাতিকীকরণ করার জন্য প্রতিনিয়ত অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের মাধ্যমে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে রামসু বাজারে গত ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে ইউপিডিএফ সশস্ত্র ক্যাডারদের গুলিতে তিনজন পাহাড়ি নিহত হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা যেতে পারে। 

সার্বিক বিষয়টিকে পরিষ্কার করার জন্য আজ ২৭ অক্টোবর ২০২৫ তারিখে বেসামরিক প্রশাসনের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তা, সেনাবাহিনীর মাঠ পর্যায়ের কমান্ডার এবং মিডিয়ার উপস্থিতিতে এলাকাবাসীর কাছে তাদের দাবির স্বপক্ষের প্রমাণাদি দাখিলের আহ্বান করা হলে তারা তা উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়। ইউপিডিএফ এর মিথ্যা এবং উদ্দেশ্যমূলকভাবে দাবিকৃত অস্থায়ী সেনা পেট্রোল বেস বনবিভাগের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের জমির ওপর স্থাপন করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত দলিলাদি সংযুক্ত করা হলো।  

এবারের সার্বিক ঘটনাটি খাগড়াছড়ির সংবেদনশীল ধর্ষণ ইস্যুর মতো ধর্মীয় বিষয় ও আবেগকে পুঁজি করে পাহাড় অশান্ত করার প্রচেষ্টার একটি পুনরাবৃত্তি মাত্র। সেনাবাহিনী সর্বদা সব ধর্ম ও গোষ্ঠীর ধর্মীয় এবং সামাজিক মূল্যবোধকে সম্মান করে এবং অভিযান পরিচালনাকালে এই বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে সব স্তরের কমান্ডারদের কঠোর নির্দেশনা প্রদান করা হয়। 

পার্বত্য অঞ্চলে সেনাবাহিনীর মাঠ পর্যায়ে নিয়োজিত কমান্ডার এবং সৈনিকদের বারংবার পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মুখোমুখি দাঁড়া করানোর জন্য ইউপিডিএফ এবং অঙ্গ সংগঠনসমূহ পরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন মিথ্যা ও বানোয়াট ইস্যু এবং ঘটনার অবতারণা করছে। সেনাবাহিনী সামগ্রিক বিষয়টি অনুধাবনকরতঃ অত্যন্ত ধৈর্য্য এবং পেশাদারিত্বের সঙ্গে প্রতিটি ঘটনা মোকাবিলা করে যাচ্ছে। তবে ইউপিডিএফ এবং অঙ্গসংগঠন কর্তৃক পার্বত্য অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা কোনো বিচ্ছিন্ন সাময়িক প্রচেষ্টা নয়, বরং অত্র অঞ্চলের উদীয়মান ভূ-রাজনীতির অপকৌশল মাত্র। এই রাজনৈতিক অপকৌশল ও সমস্যার সমাধানে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিটি সংস্থার সমন্বিত এবং দ্রুত পদক্ষেপই একমাত্র বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষা করতে পারে।

সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় একটি অবশ্যম্ভাবী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এড়াতে সেনাবাহিনী বর্মাছড়িতে স্থাপিত অস্থায়ী পেট্রোল বেস অন্যত্র স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। 

আইএসপিআরের বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, পার্বত্য অঞ্চলে স্থানীয় জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিন্তে সেনা অভিযান অব্যাহত থাকবে। পার্বত্য অঞ্চলে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর অফিসার ও সৈনিক ইউপিডিএফসহ সব রাষ্ট্রবিরোধী সংগঠনের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে মাতৃভূমির অখণ্ডতা রক্ষার পবিত্র দায়িত্ব দৃঢ়তার সঙ্গে পালন করতে দেশবাসীর কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।