Image description

খাগড়াছড়ির লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার বার্মাছড়ি ইউনিয়নের আর্য কল্যাণ বনবিহার এলাকায় অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করতে চায় সেনাবাহিনী। কিন্তু সে জায়গাটিকে বিহারের সম্পত্তি দাবি করে সেনা ক্যাম্প স্থাপনে বাধা দিচ্ছেন স্থানীয়রা। আর স্থানীয়দের এ কাজে উসকে দিচ্ছে ভারতের মদতপুষ্ট সশস্ত্র সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। অথচ সরকারি নথি বলছে, এটি ১৯৩৪ সালের কলকাতা গেজেটে ঘোষিত রাষ্ট্রীয় খাসজমি। প্রশাসন ও স্থানীয়রা বলছে, ইউপিডিএফের ই অবস্থান রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

স্থানীয় সূত্র জানায়, সেনাবাহিনী সম্প্রতি বার্মাছড়ি এলাকায় একটি অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। ওই ক্যাম্প স্থাপন নিয়ে ইউপিডিএফের সমর্থিত একাংশ দাবি করে, জায়গাটি আর্য কল্যাণ বনবিহারের নামে নিবন্ধিত এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটি ‘অস্পর্শনীয়’। এ দাবির জেরে এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।

১৯৩৪ সালের ১১ এপ্রিলের কলকাতা গেজেটের কপি সংগ্রহ করেছে আমার দেশ। গেজেটে স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে, চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি থানার আওতাধীন ‘জঙ্গল খিরাম জেএল নম্বর ৭৩’ এলাকার নির্দিষ্ট রিভিশনাল সার্ভে প্লট নম্বর ২০০/৩৭৪ সরকারিভাবে সংরক্ষিত বনভূমি হিসেবে ঘোষিত। অর্থাৎ এ জমি রাষ্ট্রের মালিকানাধীন খাসজমি, যা বন বিভাগের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হওয়ার কথা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই ওই এলাকায় কোনো ব্যক্তি, সম্প্রদায় বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নামে মালিকানা বা দখলের অনুমোদন দেওয়া হয়নি। সরকারি দলিল অনুযায়ী, জমিটি একান্তভাবে রাষ্ট্রের সম্পত্তি এবং ১৯৩৪ সাল থেকেই এটি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের আওতায় আছে। পরবর্তীকালে কোনো সময়ই এ জমি ভোগদখল বা দানপত্র আকারে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। তবুও ইউপিডিএফের উসকানিতে স্থানীয়রা সেনাবাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপনের উদ্যোগকে ‘ধর্মীয় স্থানে অনধিকার প্রবেশ’ আখ্যা দিয়ে বাধা দিচ্ছে। তারা নারী ও শিশুদের সামনে রেখে ‘মানব ঢাল’ তৈরি করছে, যাতে সেনারা অগ্রসর হতে না পারে।

খাগড়াছড়ির লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার নির্বাহী অফিসার তাহমিনা আফরোজ ভূঁইয়া আমার দেশকে বলেন, জায়গাটি নিয়ে যেহেতু ঝামেলা হচ্ছে, তা সমাধানে আমরা কাজ করছি। এটি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। জায়গাটি ব্যক্তিমালিকানা কি না, সেটি ডকুমেন্ট কথা বলবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা আমার দেশকে বলেন, আমাদের হাতে কলকাতা গেজেটের কপি রয়েছে। ১৯৩৪ সালে এই জমি সরকারি খাস হিসেবে নিবন্ধিত হয়। এটি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন নয়। রাষ্ট্রের স্বার্থে নিরাপত্তা সংস্থাগুলো যেখানে প্রয়োজন মনে করবে, সেখানে ক্যাম্প করতে পারে। এতে বাধা দেওয়ার অধিকার কারো নেই।

ইউপিডিএফ সমর্থিত ভিক্ষু সংঘের নেতারা দাবি করেন, বনবিহার কর্তৃপক্ষের নামে জমিটি স্থানীয়ভাবে ‘দখলভুক্ত’, তাই সেনা ক্যাম্পের অনুমতি তারা দেবেন না। তবে প্রশাসন বলছে, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নামে খাস জমির দখল নেওয়া বেআইনি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় প্রবীণ এক ব্যক্তি আমার দেশকে বলেন, এলাকায় যখনই সেনাবাহিনী টহল বাড়ায় বা ক্যাম্প স্থাপন করতে চায়, ইউপিডিএফ তখনই ধর্ম বা জাতিগত পরিচয়ের আড়ালে বাধা দেয়। এতে প্রশাসনও অনেক সময় বিব্রত হয়। ইউপিডিএফের এই অবস্থান শুধু স্থানীয় বিরোধ নয় বরং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা কার্যক্রমে সরাসরি হস্তক্ষেপ।

একজন সিনিয়র নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেন, সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের অংশ। তারা জনগণের নিরাপত্তার জন্য ক্যাম্প করছে। কিন্তু ইউপিডিএফের আপত্তি প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি চ্যালেঞ্জ। পার্বত্য চট্টগ্রামে ইউপিডিএফের ক্রমবর্ধমান ‘অঘোষিত প্রশাসনিক’ প্রভাব সরকারের নীরবতায় আরো বিস্তৃত হচ্ছে। এ নীরবতা ভবিষ্যতে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ দুর্বল করে দিতে পারে।

খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক (ডিসি) ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার বলেন, আমরা কাজ করছি। কয়েকদিনের মধ্যে ফল জানতে পারবেন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে যাতে কোনো বিশৃঙ্খলা না ঘটে, সে বিষয়ে আমরা স্থানীয় প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি।

২৯ অক্টোবর ওই বিহারে অনুষ্ঠান, উত্তেজনা বৃদ্ধির শঙ্কা

বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের একটি অংশ ২৯ অক্টোবর বর্মাছড়ি আর্য কল্যাণ বনবিহারে ‘মহাসংঘদান’ নামে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে সেই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি থাকবেন চাকমা রাজা দেবাশীষ রায় এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো অনুমোদন বা আমন্ত্রণ পাওয়ার কথা অস্বীকার করা হয়েছে। ইউপিডিএফ-ঘনিষ্ঠ কয়েকটি ফেসবুক পেজ ও আইডি থেকে এ বিষয়ে পোস্টও দেওয়া হচ্ছে। এতে দাবি করা হচ্ছে, ‘উপদেষ্টার আগমনে বর্মাছড়িতে উৎসবের আমেজ’। এমনকি পোস্টগুলোতে উপদেষ্টার ছবি ব্যবহার করে বলা হচ্ছে, ‘সরকারও এখন আমাদের সঙ্গে।’

বর্মাছড়ি আর্য কল্যাণ বন বিহারের ফেসবুক পেজে একটি পোস্টে বলা হয়, ‘মহাপুণ্যময়ে সবার আমন্ত্রণে ধর্মীয় সুসংবাদ : প্রথমবার মহান পুজ্য ভিক্ষুসংঘের সমাগম, মহাসংঘদান হতে যাচ্ছে আগামী ২৯ অক্টোবর। পুণ্যানুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন বিশুদ্ধানন্দ মহাস্থবির (অধ্যক্ষ, ত্রিরত্নাঙ্কুর বনবিহার, নানিয়াচর), ড. জিনবোধি মহাস্থবির (অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পালি বিভাগ), জিনপ্রিয় মহাস্থবিরসহ ৩০ জনেরও বেশি মহাস্থবির ও ভিক্ষু সংঘ। প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন পার্বত্যবিষয়ক উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা।’

কিন্তু এই অনুষ্ঠানের বিষয়ে প্রশাসনের কেউই কিছু জানেন না। খাগড়াছড়ির ডিসি ইফতেখারুল ইসলাম বলেন, আমাদের কাছে উপদেষ্টার এরকম কোনো সরকারি সফরসূচি আসেনি। এ বিষয়ে অফিসিয়ালি কোনো চিঠি বা নির্দেশও পাইনি।

উপদেষ্টার একান্ত সচিব (উপসচিব) খন্দকার মুশফিকুর রহিম এবং ব্যক্তিগত সহকারী মোহাম্মদ মোস্তাক আহমেদ শাকিল জানিয়েছেন, বর্মাছড়ি সফর সম্পর্কে তাদের দপ্তরে কোনো তথ্য নেই। অর্থাৎ প্রশাসনের অনুমোদন ছাড়াই উপদেষ্টার এমন এক বিতর্কিত এলাকায় প্রবেশের প্রচারণা এখন বড় প্রশ্ন তুলেছে। এ সফর কি আদৌ অনুমোদিত, না কি এটি ইউপিডিএফের প্রভাব বিস্তারের কৌশল?

সরকারের নির্দেশের অপেক্ষায় সেনাবাহিনী

একজন সিনিয়র সেনা কর্মকর্তা আমার দেশকে বলেন, আমাদের হাতে অস্ত্র, কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কোনো স্পষ্ট নির্দেশনা নেই। ইউপিডিএফের মতো সংগঠনগুলো যেভাবে মাঠে আধিপত্য বাড়াচ্ছে, সেটা সরকারের নীরব অনুমোদন ছাড়া সম্ভব নয়। আমরা টহল দিচ্ছি, কিন্তু রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের অভাবে অনেক ক্ষেত্রেই বাধা পাচ্ছি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে ইউপিডিএফ বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট নীতি বা নির্দেশনা দেওয়া হয়নি।

এদিকে স্থানীয়রা বলছেন, বর্মাছড়ি ও আশপাশের গ্রামগুলোতে এখন এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। সেনা ক্যাম্প স্থাপন রোধে ইউপিডিএফ সদস্যরা প্রকাশ্যে মিছিল করছে, তাদের সঙ্গে নারী ও শিশুদের সামনের সারিতে দাঁড় করানো হচ্ছে।

এ কৌশলকে ‘মানব ঢাল’ আখ্যা দিয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক অধ্যাপক এম শাহীদুজ্জামান বলেন, যখন সশস্ত্র গোষ্ঠী নারী ও শিশুদের সামনে রেখে সেনার অগ্রযাত্রা ঠেকানোর চেষ্টা করে, সেটি কোনো প্রতিবন্ধকতা নয় বরং কাপুরুষতার প্রকাশ। এটি স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়, তারা জনসমর্থন হারিয়েছে। তিনি সতর্ক করে বলেন, যদি এ অবস্থায় রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত ও গোয়েন্দা সমন্বয় না হয়, তাহলে পরিস্থিতি দ্রুত সংকটময় হতে পারে।

ইউপিডিএফের সুযোগসন্ধানী রাজনীতি

বিশ্লেষকদের মতে, পার্বত্যাঞ্চলে সেনা নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হওয়ার প্রতিটি সময় ইউপিডিএফের মতো সংগঠনগুলো তাদের অবস্থান শক্ত করেছে। তারা স্থানীয় জনপদের জমি, কর আদায় ও তথাকথিত ‘শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন’ ইস্যুতে প্রভাব খাটিয়ে নিজেদের প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তুলছে।

সেনা নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হলে কী হয় বিশ্বে এর নজির ভুরি ভুরি । নিরাপত্তা বিশ্লেষক শাহীদুজ্জামান উদাহরণ টেনে বলেন, পূর্ব তিমুরে ইন্দোনেশীয় সেনা নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হওয়ার পর স্থানীয় মিলিশিয়া সংগঠন স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিল, পরে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে দেশটি আলাদা হয়ে যায়। দক্ষিণ সুদানেও সেনা শাসনের বিভক্তি ও রাজনৈতিক উদাসীনতার সুযোগে বিদ্রোহীরা স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করে। কসোভো ও চেচনিয়ায়ও কেন্দ্রীয় সামরিক নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হওয়ার সুযোগে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ‘আন্তর্জাতিক সহানুভূতি’ আদায় করে নিজেদের স্বাধীনতার পথে এগিয়েছে।