গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার টোকনগর দারুল হাদিস আলিম মাদ্রাসার চার শিক্ষকের সনদ জালের অভিযোগে এমপিও স্থগিত করেছিল মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর। মাত্র চার মাসের ব্যবধানে ওই শিক্ষকদের ভুয়া সনদ সঠিক বলে এমপিও ফেরত দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, জাল সনদধারীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে মামলা করার সুপারিশ করা হলেও সেটি করেনি অধিদপ্তর; বরং এখন উল্টো এমপিও ফেরত দিতে তৎপর হয়ে উঠেছে সংস্থাটি। অভিযোগ উঠেছে, মোটা অঙ্কের আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে অভিযুক্তদের এমপিও ফেরতের সুপারিশ করা হয়েছে।
যদিও প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ এ. কে. এম ইফাজ উদ্দিনের দাবি, ‘ভুয়া সনদ দিয়ে চাকরি করা দুই শিক্ষকের চক্রান্তের শিকার ওই চার শিক্ষক। তার প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা কারো সনদে সমস্যা নেই। অভিযুক্ত চার শিক্ষকের চাকরির সময় জমা দেওয়া সনদ তার কাছে সংরক্ষিত রয়েছে। সব কাগজপত্রই সঠিক।’ তবে এমপিও স্থগিতের পর কেন তাৎক্ষণিকভাবে আবেদন করা হয়নি, তার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি এই অধ্যক্ষের কাছ থেকে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চলতি বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি এনটিআরসিএর ওয়েবসাইটে গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার টোকনগর দারুল হাদিস আলিম মাদ্রাসার চার শিক্ষকের সনদ যাচাইয়ের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সংস্থাটির সহকারী পরিচালক (পরীক্ষা মূল্যায়ন ও প্রত্যয়ন) ফিরোজ আহমেদের স্বাক্ষরে প্রকাশিত প্রতিবেদনে প্রভাষক নাজমুল আহসান, সহকারী মৌলভী নাজমুন নাহার, সহকারী শিক্ষক সানাউল্লাহ এবং এবতেদায়ী শিক্ষক কে এম সবুর শেখের সনদ জাল, ভুয়া এবং সঠিক নয় বলে উল্লেখ করা হয়। এই প্রতিবেদনের আলোকে মাদ্রাসা অধিদপ্তর অভিযুক্তদের কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠায়। তবে এর কোনো জবাব দেয়নি অভিযুক্তরা। পরে তাদের ইনডেক্স কর্তন করে বেতন-ভাতার অর্থ ফেরত নেওয়াসহ মামলা করার সুপারিশ করে অধিদপ্তর।
অভিযুক্তদের প্রথম সনদ যাচাই প্রতিবেদন প্রকাশের চার মাস পর অর্থাৎ ২০২৫ সালের ১৫ জুলাই প্রভাষক নাজমুল আহসান এবং সহকারী শিক্ষক সানাউল্লাহর সনদ যাচাই প্রতিবেদন পুনরায় প্রকাশ করা হয়। এনটিআরসিএর সহকারী পরিচালক ফিরোজ আহমেদের স্বাক্ষরে প্রকাশিত এ প্রতিবেদনে অশ্চর্যজনকভাবে তাদের পূর্বের ভুয়া সনদ ‘সঠিক’ বলে উল্লেখ করা হয়। আর সহকারী মৌলভী নাজমুন নাহার এবং এবতেদায়ী শিক্ষক কে এম সবুর শেখ এনটিআরসিএর সনদ প্রদানের পূর্বে নিয়োগ পেয়েছেন উল্লেখ করে তাদের এমপিও ফেরতের সুপারিশ করা হয়। এই কাজটি করা হয়েছে ইনডেক্স কর্তনের এক মাসের মধ্যে। ফলে বিষয়টি নিয়ে বিষ্ময় প্রকাশ করেছেন পূর্বের তদন্তকারী কর্মকর্তারা।
সনদ যাচাইয়ের নতুন প্রতিবেদনে সহকারী শিক্ষক সানাউল্লাহর বাবা-মার নাম বদলে গেছে। এমনকি রোল এবং রেজিস্ট্রেশন নম্বর আগের প্রতিবেদনের সাথে মেলেনি। আগের যাচাই প্রতিবেদনে সানাউল্লাহর বাবার নাম মো. সালামত উল্লাহ, মায়ের নাম আশেয়া বেগম উল্লেখ থাকলেও এখন সেটি আব্দুল লতিফ ও আমেনা বেগম।
সনদ যাচাইয়ের নতুন প্রতিবেদনে নাজমুল আহসানের বাবা-মায়ের নাম, রোল এবং রেজিস্ট্রশন নম্বর একই থাকলেও সহকারী শিক্ষক সানাউল্লাহর বাবা-মার নাম এমনকি রোল এবং রেজিস্ট্রেশন নম্বর আগের প্রতিবেদনের সাথে মেলেনি। আগের যাচাই প্রতিবেদনে সানাউল্লাহর বাবার নাম মো. সালামত উল্লাহ, মায়ের নাম আশেয়া বেগম উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া রোল ও রেজিস্ট্রেশন নম্বর যথাক্রমে ৩১৩০৬৭৯১, ২০১৩৯০৯৯০২ উল্লেখ করা হয়েছে। তবে নতুন প্রতিবেদনে বাবা-মার নাম যথাক্রমে আব্দুল লতিফ ও আমেনা বেগম উল্লেখ করা হয়েছে। আর রোল-রেজিস্ট্রেশন নম্বর যথাক্রমে ৩১৩১৯১২৭ ও ২০১৩৯৩৪২৯৪ উল্লেখ করা হয়েছে। এ অবস্থায় এনটিআরসিএর সনদ যাচাই প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, মোটা অঙ্কের আর্থিক লেনদের মাধ্যমে এমন ঘটনা ঘটানো হয়ে থাকতে পারে।
জানতে চাইলে এনটিআরসিএর সহকারী পরিচালক (পরীক্ষা মূল্যায়ন ও প্রত্যয়ন) ফিরোজ আহমেদ দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘চারজন শিক্ষকের মধ্যে দুইজনের এনটিআরসিএর সনদই ছিল না। নিবন্ধন সনদ দেওয়ার আগেই তারা নিয়োগ পেয়েছেন। তবে নাজমুল আহসান এবং সানাউল্লাহর বিষয়ে তাদের প্রতিষ্ঠান প্রধান আবেদন জমা দিয়েছিলেন। আমরা তাদের শুনানির জন্য ডেকেছিলাম। শুনানিতে তাদের কাগজপত্র যাচাই করে সনদ সঠিক পাওয়া যায়।’
সানাউল্লাহর বাবা-মার নাম, রোল-রেজিস্ট্রেশন নম্বর আগেরটির সাথে মিল নেই। এছাড়া নাজমুল আহসানের সনদ জাল বলা হলেও নতুন যাচাইয়ে সেটি সঠিক বলা হলো কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটির সাবেক এক শিক্ষক সার্টিফিকেট বানিয়ে অভিযোগ জমা দিয়েছিলেন। যার কারণে এমন হয়েছিল।’
তবে এনটিআরসিএর এমন ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয় বলে জানিয়েছেন মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা। নাম অপ্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘মেমিস সফটওয়্যারে কে কবে যোগদান করেছে সেটি উল্লেখ আছে। এনটিআরসিএ নিজেদের গা বাঁচানোর জন্য এমন কথা বলছে। অভিযুক্তদের মূল কাগজপত্র যাচাই করলে সব সত্য বেরিয়ে আসবে। এছাড়া চারজন শিক্ষকের এমপিও কর্তন করা হলো-অথচ তারা কোনো আবেদন করল না। তাদের সনদ সঠিক হলে এমপিও কর্তনের পরপরই তারা আবেদন করতেন। এছাড়া কে কখন নিয়োগ পেয়েছে এটি মেমিসের মাধ্যমে যাচাই করা দরকার ছিল। ফিরোজ আহমেদ সেটি না করে কেবল মৌখিক কথা শুনেই অবৈধ সনদকে বৈধতা দিয়েছেন। যাদের এমপিও কর্তন করা হয়েছে তারা ২০১২ সালের পর নিয়োগ পেয়েছেন। তাদের পদগুলোতে আগে অন্য শিক্ষক কর্মরত ছিলেন। প্রতিষ্ঠানের এমপিও শিট ও অন্যান্য কাগজপত্র যাচাই করলে বিষয়গুলো বেরিয়ে আসবে।
‘চারজন শিক্ষকের এমপিও কর্তন করা হলো; অথচ তারা কোনো আবেদন করল না। তাদের সনদ সঠিক হলে এমপিও কর্তনের পরপরই তারা আবেদন করতেন। এছাড়া কে কখন নিয়োগ পেয়েছে এটি মেমিসের মাধ্যমে যাচাই করা দরকার ছিল। এনটিআরসিএ থেকে সেটি না করে কেবল মৌখিক কথা শুনেই অবৈধ সনদকে বৈধতা দিয়েছে।’— মাদ্রাসা অধিদপ্তর কর্মকর্তা
এদিকে টোকনগর দারুল হাদিস আলিম মাদ্রাসার রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক নাজমুল আহসান, সহকারী মৌলভী নাজমুন নাহার, সহকারী শিক্ষক (আইসিটি) সানাউল্লাহ এবং এবতেদায়ী শিক্ষক কে এম সবুর শেখের সনদ জালের অভিযোগে তাদের এমপিও স্থগিত করেছিল মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর। গত ১১ আগস্ট তাদের এমপিও ফেরত দেওয়ার সুপারিশ করে প্রতিবেদন জমা দেন মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগের পরিদর্শক মো: আসাদুজ্জামান। মামলা না করে উল্টো এক মাসের ব্যবধানে এমপিও ফেরতের সুপারিশের ঘটনা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
জানতে চাইলে মো: আসাদুজ্জামান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের জুলাই মাসের প্রতিবেদন এবং অধ্যক্ষের আবেদনসহ সংশ্লিষ্টরা এমপিও ফেরতের আবেদন করেন। এনটিআরসিএ যেহেতু তাদের সনদ সঠিক বলে প্রতিবেদন দিয়েছে, সেহেতু তাদের এমপিওভুক্তির সুপারিশ করা হয়েছে। ফাইলটি আমাদের উপ-পরিচালক (প্রশাসন) মোহাম্মদ আরিফুর রহমান মজুমদার আমাকে দিয়েছিলেন। আমার দায়িত্ব তদন্ত করা, আমি কাগজপত্র দেখে যেটি সঠিক মনে হয়েছে, তাই লিখেছি।’
সহকারী শিক্ষক (আইসিটি) সানাউল্লাহর আগের যে প্রতিবেদন সেটির সাথে বর্তমান প্রতিবেদনে উল্লেখিত তার বাবা-মার নাম, রোল, রেজিস্ট্রেশন কোনো কিছুরই মিল নেই। তাহলে এই ব্যক্তি এতদিন ভুয়া সনদ দিয়ে বেতন-ভাতা নিয়েছেন। বিষয়টি তদন্তে আসেনি কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘আগে কী প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে তা দেখিনি। তবে এনটিআরসিএ প্রথমে তাদের সনদ ভুয়া বলে পরবর্তীতে আবার সঠিক বলেছে, সেজন্য এমপিও ফেরতের সুপারিশের বিষয়টি স্থগিত রাখা হয়েছে। খুব শিগগিরই আমরা সরেজমিনে তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেব।’
আসাদুজ্জামানের এমন দাবি প্রসঙ্গে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘২০২৫ সালের জুন মাসে অভিযুক্তদের ইনডেক্স কর্তন করা হয়েছিল। ইনডেক্স কর্তনের পূর্বে তাদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হলেও অভিযুক্তরা কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি। ইনডেক্স কর্তনের চিঠি অভিযুক্ত চার শিক্ষকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে মামলা করার কথা উল্লেখ ছিল। অথচ জাদুর কাঠির বদৌলতে মামলা না করে এক মাস পর এমপিও ফেরতের সুপারিশ করা হয়েছে।’
অভিযুক্তদের এমপিও কর্তনের এক মাস পর এমপিওর সুপারিশ করার ঘটনার সাথে অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (প্রশাসন) মোহাম্মদ আরিফুর রহমান মজুমদার, পরিদর্শক আসাদুজ্জামান মিয়া জড়িত। শিক্ষকদের কাছে মোটা অঙ্কের আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে এমন সুপারিশ করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ আরিফুর রহমান মজুমদার দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, অভিযোগগুলো ভিত্তিহীন। এনটিআরসিএ দুইবার দুরকম যাচাই প্রতিবেদন দিয়েছিল। ওই প্রতিবেদনের আলোকে আমরা একটি সুপারিশ করেছি। আর্থিক লেনদেনের কোনো প্রশ্নই ওঠেনা।
‘কাজগুলোর পেছনে একটি চক্র রয়েছে। এই চক্র একবার গ্রেপ্তারও হয়েছিল। এই কাজের সাথে জড়িত, তাদের নাম-পরিচয় দিলে আমরা আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব। প্রয়োজনে মামলা করা হবে।’— আমিনুল ইসলাম, চেয়ারম্যান, এনটিআরসিএ
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) মুহাম্মদ মাহবুবুল হক দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদনে কেবল সুপারিশ করা হয়নি। যদিও এমপিও দেওয়া হয়, তখন আপনি আমাকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করতে পারেন। এছাড়া বিষয়টি আমার জানাও নেই।’
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোঃ হাবিবুর রহমানের মুঠোফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তবে এনটিআরসিএর চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘কাজগুলোর পেছনে একটি চক্র রয়েছে। এই চক্র একবার গ্রেপ্তারও হয়েছিল। এই কাজের সাথে জড়িত, তাদের নাম-পরিচয় দিলে আমরা আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব। প্রয়োজনে মামলা করা হবে।’