Image description

ময়মনসিংহে মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। ধোবাউড়া, নান্দাইল ও গৌরীপুর উপজেলার মডেল মসজিদে উদ্বেগজনক চিত্র দেখা গেছে। সবচেয়ে শোচনীয় অবস্থা ধোবাউড়া উপজেলা মডেল মসজিদের। দীর্ঘ আট বছর পেরিয়ে গেলেও প্রায় ১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত স্থাপনাটি এখনও নামাজের অনুপযোগী।

স্থানীয়রা বলছেন, এই মসজিদগুলো নির্মাণে শুধু রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় নয়; বরং সাধারণ মানুষের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতি শ্রদ্ধাবোধেও আঘাত করা হয়েছে।

শেষ হয়নি ধোবাউড়া মডেল মসজিদ নির্মাণ

ধোবাউড়া উপজেলা মডেল মসজিদের নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে। যার প্রাক্কলিত ব্যয় প্রায় ১৭ কোটি টাকা। আট বছর পেরিয়ে গেলেও নির্মাণকাজ শেষ হয়নি। এর কারণ কাজের শুরুতেই স্থবিরতা, ঠিকাদারের গাফিলতি ও নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ। মসজিদটি ২০২২ সালে কাগজে-কলমে উদ্বোধন দেখানো হলেও বাস্তবে অর্ধেক কাজই শেষ হয়নি।

 

স্থান নির্বাচনে বাণিজ্যের অভিযোগ

ধোবাউড়া মডেল মসজিদের জন্য জমি নির্বাচনে সাবেক রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতি ও বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। উপজেলা পরিষদ থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে জনবসতিহীন স্থানে মসজিদটি নির্মাণ করা হচ্ছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, নেতাদের ব্যক্তিগত সুবিধা ও স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে এই জমি নির্বাচন করা হয়। ১৭ কোটি টাকা খরচ করেও মসজিদ করা হলেও সেখানে যাতায়াতের রাস্তাটি নাজুক রয়ে গেছে।

নির্মাণকাজে ত্রুটি

সরেজমিন দেখা যায়, মসজিদের অজুখানার জায়গা এখনও চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হয়নি। ঠিকাদার পালিয়ে গেছেন, তাঁর নিযুক্ত ব্যক্তিও ফোন ধরছেন না। নিম্নমানের কাজের কারণে সিঁড়ি এবং মেঝের মার্বেল টাইলস ফেটে গেছে। দরজা-জানালাগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। এসএস (স্টেইনলেস স্টিল) দিয়ে নির্মিত সবকিছুতে মরিচা ধরে গেছে। প্রতিটি দেয়ালে বড় বড় ফাটল। লাইট, ফ্যান ও সাউন্ড সিস্টেমগুলো অযত্নে নষ্ট হচ্ছে। পানির ট্যাপসহ মূল্যবান অনেক জিনিস চুরি হয়ে গেছে।

যেন এক পরিত্যক্ত ভবন

মসজিদটির বর্তমান অবস্থা এতটাই নাজুক যে, দিনের বেলায় ভেতরে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি ঘোরাফেরা করে, রাতে কুকুর-শিয়ালের ঝগড়া লক্ষ্য করা যায়। ২০১৭ সালে কাজ শুরু করেও এখন পর্যন্ত কাজ শেষ করতে না পারায় স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।

মসজিদের জমিদাতা মফিজ উদ্দিন জানান, প্রকৌশলীরা টাকা খেয়ে ঠিকাদারকে ছাড় দিয়েছেন। ঠিকাদার টাকা তুলে নিয়ে লাপাত্তা।

২০১৭ সালে ধোবাউড়া মডেল মসজিদের কাজ পায় মেসার্স জাহান এন্টারপ্রাইজ। এই প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী মনজু মিয়াকে টানা তিন দিন বিভিন্ন সময়ে ফোন দিয়েও তাঁর নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। তাঁর নিয়োজিত সাইট ম্যানেজার জানান, ঠিকাদারের ফোন নম্বর বন্ধ। তিনি কারও সঙ্গে কথা বলেন না।

নান্দাইল মডেল মসজিদের অবস্থাও বেহাল

এই মসজিদের তিনতলার ছাদ চুইয়ে পানি পড়ে নামাজের স্থানে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভুল নকশায় কাজ করায় এমনটি হয়েছে। সরেজমিন দেখা যায়, লোহা ও এসএস দিয়ে নির্মিত ফটকসহ আসবাবে মরিচা ধরেছে। মেঝের মার্বেল টাইলসগুলো ফেটে গেছে। অধিকাংশ দরজা-জানালা নষ্ট হয়ে গেছে। দেয়ালে ফাটল ধরেছে, রং উঠে গেছে। গণপূর্ত অধিদপ্তরের চিঠি পেয়ে মসজিদটি বুঝে নিয়েছেন ইউএনও সারমিনা সাত্তার। তিনি বলেন, গণপূর্ত অধিদপ্তর বারবার চিঠি দিয়েছে। তাদের চিঠির ভিত্তিতে এটি বুঝে নিয়েছেন তিনি। মসজিদের বেহাল অবস্থা সম্পর্কে তিনি জানান, কারিগরি বিষয়গুলো গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রকৌশলীরা ভালো বলতে পারবেন।

মসজিদটির নির্মাণকাজ যৌথভাবে করে স্টার লাইট সার্ভিস লিমিটেড ও মেসার্স নাঈমা এন্টারপ্রাইজ। ঠিকাদার ইব্রাহিম খান বলেন, ‘আমরা আরও তিন বছর আগে মসজিদের কাজ হস্তান্তর করেছি। আমাদের ওয়ারেন্টির মেয়াদ ছিল এক বছর। সেই মেয়াদ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। এখন মসজিদের কী অবস্থা এটি আমাদের জানার কথা নয়। মসজিদ যারা রক্ষণাবেক্ষণ করছেন, তাদের গাফিলতির কারণে দুরবস্থা হতে পারে।’

নিম্নমানের জিনিসপত্র দিয়ে নির্মাণকাজের অভিযোগ প্রসঙ্গে তাঁর ভাষ্য, মডেল মসজিদের সাবেক প্রকল্প পরিচালকের নির্ধারিত কোম্পানি থেকে বাধ্য হয়ে নিম্নমানের জিনিসপত্র কিনতে হয়েছে। যা গণপূর্ত বিভাগ ময়মনসিংহের প্রকৌশলীরা জানেন। নিম্নমানের টাইলস ও মার্বেল পাথরের ব্যবহার সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘প্রকৌশলীরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই আমাদের অনুমোদন দিয়েছেন। দায় তাদেরই নিতে হবে। আমাদের কাজ শেষ করে বিল নিয়ে চলে এসেছি।’ 

গৌরীপুর মডেল মসজিদ হস্তান্তরের আগেই ফাটল

এই মসজিদের কাজ শেষ পর্যায়ে। কয়েক দিনের মধ্যেই হস্তান্তর হওয়ার কথা। কিন্তু তার আগেই প্রতিটি কক্ষের দেয়ালে ফাটল ধরেছে। সরেজমিন দেখা যায়, প্রতিটি কক্ষের ছাদের কোণায় ও দেয়ালে বড় বড় ফাটল পুডিং দিয়ে বন্ধ করে রং করার কাজ চলছে। সাইট ইঞ্জিনিয়ার শফিকুল ইসলাম জানান, ব্লক দিয়ে কাজ করার কারণে ফাটল ধরেছে। এত বছরেও কেন কাজ শেষ হয়নি? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মসজিদের জমি নিয়ে ঝামেলা ছিল। পুরাতন মসজিদ ভেঙে নির্মাণকাজ শুরু করলে মালপত্র রাখার জায়গা ছিল না। তাঁর দাবি, ব্লক দিয়ে কাজ করার কারণে সব দেয়াল ফেটে গেছে।

এই মসজিদের দরপত্রে বিদ্যুতের সাবস্টেশন করার কথা থাকলেও এটি করা হয়নি। সাবস্টেশনের জন্য বরাদ্দ ছিল ৪৫ লাখ টাকা। এটি কেন করা হয়নি? এই প্রশ্নে সাইট ইঞ্জিনিয়ার জানান, গণপূর্তের প্রকৌশলীদের নির্দেশে এমনটি হয়েছে।

পরিচয় গোপন রাখার শর্তে একজন ঠিকাদার জানান, এক একটি মসজিদের বরাদ্দ ছিল ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকা। কিন্তু বাস্তবে অর্ধেক টাকাও খরচ করা হয়নি। 

তদন্তের দাবি  

ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইডিইবি) ময়মনসিংহ জেলার সদস্য সচিব এমদাদুল হকের ভাষ্য, মসজিদের নামে জনগণের অর্থের এমন অপচয় ও পুকুর চুরি মেনে নেওয়া যায় না। জমি নির্বাচন এবং মসজিদ নির্মাণের কারিগরি বিষয়গুলো খতিয়ে দেখার জন্য উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা দরকার। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ঠিকাদার, প্রকৌশলী ও কর্মকর্তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব মোহাম্মদ শফিকুল আলম ময়মনসিংহের এক অনুষ্ঠানে সমকালকে বলেন, বিগত সরকার এক বিলিয়ন ডলার খরচ করে ৫৬০টি মডেল মসজিদ তৈরি করেছে। এটিকে পুঁজি করে আওয়ামীপন্থি ঠিকাদাররা পাঁচ থেকে সাত কোটি টাকার কাজ করে প্রতিটি মসজিদ থেকে ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকা পর্যন্ত বিল তুলে নিয়েছেন। যারা এসব করেছেন, তাদের অবশ্যই জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। 

গণপূর্ত প্রকৌশলীদের বক্তব্য

ময়মনসিংহ গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী অর্ণব বিশ্বাস মডেল মসজিদের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করতে রাজি হননি। গণপূর্ত বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল ময়মনসিংহে যোগদান করেন ২০২৩ সালের ২৩ আগস্ট। মডেল মসজিদের অনেক বিল তাঁর স্বাক্ষরে দেওয়া হয়েছে। নির্মাণকাজে অনিয়ম সম্পর্কে জানতে চাইলে বিভিন্ন অজুহাতে দুই সপ্তাহ সময়ক্ষেপণ করেন তিনি। পরে জানান, প্রধান প্রকৌশলী বক্তব্য দেওয়ার অনুমতি দেননি। ময়মনসিংহ গণপূর্ত জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ড. মইনুল ইসলাম দায়িত্বে আছেন ২০১৯ সাল থেকে। মডেল মসজিদের অধিকাংশ বিলে তাঁর স্বাক্ষর রয়েছে।