ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হলে অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে নির্বাচন আয়োজনের জন্য সময় আছে মাত্র সাড়ে তিন মাস। নির্বাচনকে যারা গ্রহণযোগ্য করবে সেই ডিসি, ইউএনও, স্কুল শিক্ষক, তৃণমূল পর্যায়ে ভোট আয়োজনে যুক্ত প্রশাসনকে এরই মধ্যে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন রাজনীতিবিদরা। তারা দলে দলে গিয়ে প্রধান উপদেষ্টাকে বলছেন প্রশাসন নিরপেক্ষ নয়। অথচ তাদের মনমতো হলেই কোনো রা নেই। একদিকে রাজনৈতিক চাপ, অন্যদিকে ভোটের উত্তাপে চিড়েচ্যাপ্টা প্রশাসন।
নির্বাহী আদেশে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণার পর থেকেই অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপি নিরপেক্ষ প্রশাসনের দাবি জানাছে। বিভিন্ন সভা-সমাবেশে তারা বলছে প্রশাসনের গুরুত্বপপূর্ণ পদে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের অনুসারীরা বসে আছেন। এই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ দল জামায়াতে ইসলামীও বলছে, প্রশাসন একটি বিশেষ দলের প্রতি অনুগত। ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী দল জাতীয় নাগরিক পার্টিও (এনসিপি) প্রশাসনের প্রতি অনাস্থার কথা জানিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কাছে।
নির্বাচন বা যে কোনো রাজনৈতিক ব্যর্থতার দায় কেন আমলাদের এমন প্রশ্নে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জনগণের সঙ্গে আমলাতন্ত্রের সম্পর্ক ভালো করবেন রাজনীতিবিদরা। রাজনীতিবিদরা জবাবদিহির কাজটি করবেন। জনগণ এবং আমলাদের মধ্যে আস্থার সংযোগ করবেন তারা। যেহেতু রাজনীতিবিদরা তা করতে পারছেন না, সে জন্য বোঝাপড়াও সহজ হচ্ছে না।’
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের গত সপ্তাহের বৈঠকে বিএনপি, জামায়াত এবং এনসিপির পক্ষ থেকে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। বৈঠকে দলগুলোর পক্ষ থেকে প্রশাসনে নিরপেক্ষতা নিশ্চিতে প্রধান উপদেষ্টাকে তাগিদ দেওয়া হয়। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, প্রশাসনে কোনো দলীয় ব্যক্তি থাকলে তাদের অপসারণ করতে হবে। প্রশাসনের বিতর্কিত কর্মকর্তাদের কেউ যেন আগামী নির্বাচনে কোনোভাবেই ভোট পরিচালনায় অংশ নিতে না পারেন। পরে একই বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকেও সতর্ক থাকার কথা বলেছে বিএনপি। দলটির অভিযোগ, ‘বিগত তিনটা নির্বাচনের নামে প্রহসন হয়েছে। কাদের দ্বারা হয়েছিল? যারা প্রশাসনে থেকে রাজনৈতিক ভূমিকা রেখেছিলেন। ১৫ বছরের কর্মকর্তারা ১৫ মাসে পরিবর্তন হবেন না। এ বিষয়ে ইসিকে সচেতন হতে হবে।’
জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেছেন, ‘নির্বাচন কমিশন, সচিবালয়, পুলিশ প্রশাসনের ৭০ থেকে ৮০ ভাগ অফিসারেরই একটি দলের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ পেয়েছে। আমরা গেলে তারা বলেন প্রচ- চাপ। এই যে চাপ, এই চাপ একটি দলের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়। প্রসিকিউটর যারা হন, পিপি, এপিপি যারা হন তাদের ৮০ ভাগই একটি বিশেষ দলের, কেউ কেউ বলেন, এটি ৮০ না ৬৫। এই ৬৫টিই যদি হয় তাতো অনেক বেশি হয়ে গেল। বাকি বাংলাদেশের ৩৫।’
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘জনপ্রশাসনে যেভাবে বদলি-পদায়ন হচ্ছে, সেটা কীসের ভিত্তিতে হচ্ছে? নিরপেক্ষতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে পদায়ন হচ্ছে কি না। কারণ, আমরা বিভিন্ন জায়গায় দেখতে পাচ্ছি, শুনতে পাচ্ছি যে প্রশাসনে বিভিন্ন ভাগ-বাটোয়ারা হচ্ছে। বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে যারা পরিচিত, তারা নিজেদের মধ্যে প্রশাসন, এসপি-ডিসি ভাগ-বাটোয়ারা করছে। নির্বাচনের জন্য তারা সেই তালিকা করে সরকারকে দিচ্ছে।’ জনপ্রশাসনে বদলি-পদায়নে ‘ভাগ-বাটোয়ারায়’ উপদেষ্টা পরিষদের ভেতর থেকে সহায়তা করা হচ্ছে অভিযোগ করে তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ চেয়েছে এনসিপি।
ওদিকে বৈঠকের আলোচনার বিষয়ে এক বিবৃতিতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা হিসেবে নির্বাচনের আগে প্রশাসনের যাবতীয় রদবদল সরাসরি প্রধান উপদেষ্টার তত্ত্বাবধানে হবে। জেলা প্রশাসক পদে নিয়োগের জন্য একাধিক ‘ফিট লিস্ট’ থেকে যোগ্য কর্মকর্তাদের বাছাই করে প্রত্যেককে নির্বাচনের আগে যথাযোগ্য স্থানে নিয়োগ দেওয়া হবে।
রাজনৈতিক দলগুলো যখন পরস্পর অভিযোগ করছে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে তখন প্রশাসনকে অকার্যকর ও প্রশ্নবিদ্ধ করতে রাজনীতিবিদদেরই দায়ী করছেন জনপ্রশাসন বিশ্লেষক ও সিনিয়র আমলারা। তারা বলছেন, ‘আপনার সন্তান ঘরের জানালা দিয়ে দেখছে রাস্তায় হরতাল পালিত হচ্ছে কিন্তু টিভি পর্দায় প্রচারিত হচ্ছে যান চলাচল ব্যাহত হয়নি। স্বাভাবিক ছিল দিনের কার্যক্রম। তখন সেই জেনারেশন একটি রাজনৈতিক মিথ্যার সাক্ষী হয়ে যায়। সে কখনো আস্থা রাখতে পারে না প্রচলিত রাজনীতিতে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সিনিয়র সচিব দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অর্থ, বাণিজ্য, গণমাধ্যম, ক্যাপিটাল মার্কেট, সিভিল প্রশাসন, সরকারি স্বায়ত্তশাষিত সংস্থা, নির্বাচন কমিশন, পুলিশ প্রশাসন, মানবাধিকার কমিশন কেউই রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব নিরপেক্ষভাবে পালন করতে পারেনি। দলীয় লেজুরবৃত্তির উপহার হিসেবে এখানে দলীয় পদধারী অথবা অনুগত আমলাকে বসিয়ে স্বার্থ উদ্ধার করা হয়েছে। জনগণকে সঠিক সেবা বঞ্চিত করা হয়েছে। ফলে প্রশাসন এখনো রাজনীতিমুক্ত হয়েছে সেটি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।’
সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ পৃথিবীতে বাংলাদেশিদের মতো দলান্ধ জাতি আর নেই। বিভিন্ন দলের প্রতি অন্ধ আচরণ ও সমর্থনের জন্য আমরা প্রতিযোগিতায় নামি। প্রশাসনও এর ব্যতিক্রম নয়। কেউ কেউ অলিখিত দলবাজি করেছে যা পরম্পরা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে অবিশ^াস স্বাভাবিকভাবে তৈরি হয়েছে। এসব দলান্ধের ক্লাসিফাই করা যায়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো মুখে মুখে নিরপেক্ষতার কথা বলে কিন্তু সবাই মনে মনে নিজের পক্ষের লোককেই ডিসি, ইউএনও হিসেবে দেখতে চায়। এদের মুখের কথার সঙ্গে রাজনৈতিক চর্চার কোনো মিল নেই। তাদের দলের লোক হলেই নিরপেক্ষ প্রশাসন, আর না হলে নিরপেক্ষ নয়।’
তিনি অন্তর্বর্তী সরকারকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘প্রশাসনকে নিয়ে এসব প্রশ্ন তৈরি হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের দোদ্যুল্যমান আচরণের কারণে। সরকার কখনো বিএনপির প্রতি আনুগত্য, কখনো জামায়াতের প্রতি আগ্রহ, কখনো এনসিপিকে সমর্থন দিয়ে প্রশাসনের শৃঙ্খলা ফেরাতে ব্যর্থ হয়েছে। এখানে দোষীদের তালিকা করে নিরপেক্ষ প্রশাসন সাজাতে ব্যর্থ হয়েছে বলেই প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, সরকার নিরপেক্ষভাবে দেশ পরিচালনায় ব্যর্থ হয়েছে বলেই কয়েকজন উপদেষ্টাকে নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এর মধ্য দিয়ে সরকারের আস্থায়ও ভাটা পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বিতর্কিত উপদেষ্টাদের বাদ দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদলে সরকার গঠন করারও দাবি এসেছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারে থাকা যেসব উপদেষ্টাকে নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, নির্বাচনের আগে তাদের সরকার থেকে চলে যেতে হবে। তিনি বলেন, যেহেতু নির্বাচনের আগে আর কোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসবে না, সেহেতু এই সরকারকে শিগগিরই নির্বাচনী নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে।
যদিও সরকারের প্রতি আস্থাহীনতা কিংবা নিরপেক্ষতা ভঙ্গ হয়েছে এমন মনে করছেন না আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, আমাদের বিরুদ্ধে সব দলই অভিযোগ করে, এক দল বলে ওই দলের লোক আছে, আরেক দল বলে ওই দলের লোক আছে। যেহেতু সব দলই অভিযোগ করে, অন্য দলের লোক আছে। তার মানে হচ্ছে আমরা নিরপেক্ষভাবেই দায়িত্ব পালন করছি।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোনো কর্মকর্তা নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন না করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. এহছানুল হক। তিনি বলেছেন, নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী মাঠ প্রশাসন সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করবে। আমরা প্রশাসনের কর্মকর্তারা সুযোগ পেলে নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন পরিচালনা করতে পারি। মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা যদি স্বাধীনভাবে কাজ করার উপযুক্ত পরিবেশ পান, তাহলে তারা সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে ভোট পরিচালনা করতে পারবেন।’