Image description

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার একটি কাঠামো ঠিক করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। কিন্তু সনদের সংবিধান–সম্পর্কিত সংস্কার প্রস্তাবগুলো আগামী সংসদ নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়ন করবে—এমন নিশ্চয়তা বিধান কীভাবে করা যায়, তা খুঁজে পাচ্ছে না কমিশন।

কমিশন–সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নিশ্চয়তা প্রশ্নে কমিশনের চিন্তা হলো জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশে এমন একটি বিধান রাখা, যেখানে বলা হবে, আগামী সংসদ গঠিত হওয়ার ৯ মাসের মধ্যে সনদ বাস্তবায়ন করবে। কিন্তু এ সময়ে বাস্তবায়িত না করলে কী হবে, তা এখনো ঠিক করতে পারেনি কমিশন। এখনো জুলাই সনদ বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা খুঁজছে কমিশন।

১৭ অক্টোবর জুলাই জাতীয় সনদে সই হয়। এতে এখন পর্যন্ত ২৫টি রাজনৈতিক দল ও জোট সই করেছে। কিন্তু জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) পাঁচটি দল এখনো সনদে সই করেনি।

বৃহস্পতিবারের বৈঠকে দুটি বিকল্প আলোচনায় এসেছিল। এর একটি হলো এমন একটি বিধান করা, যেখানে বলা হবে নির্ধারিত সময়ে (৯ মাস) সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করা না হলে সংসদ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আরেকটি হলো, এমন বিধান করা যে নির্ধারিত সময়ে আগামী সংসদ সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন না করলে সেগুলো বাস্তবায়িত বলে গণ্য হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গতকাল শনিবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে এনসিপি বলেছে, সনদ বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা না থাকলে তারা সই করবে না। কমিশন চায়, সব দল সনদে সই করুক। এ ছাড়া বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা না থাকলে আরও কিছু কিছু দলও আপত্তি তুলতে পারে। পাশাপাশি কমিশন–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাও মনে করেন, বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা না থাকলে সংস্কার নিয়ে দীর্ঘদিনের চেষ্টা বিফল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে ৩১ অক্টোবর। এ সময়ের মধ্যে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে তাদের একটি সুপারিশ দেওয়ার কথা রয়েছে।কমিশন সনদ বাস্তবায়নের এমন একটি সুপারিশ করতে চায়, যেটা আইনি এবং রাজনৈতিক দিক থেকে গ্রহণযোগ্য হবে।

গতকালও এ বিষয়ে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও আইনজীবীদের সমন্বয়ে গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করে কমিশন। আজ সকালে ঐকমত্য কমিশন আবার নিজেরা বৈঠকে বসবে। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গেও বৈঠক হতে পারে।

১৭ অক্টোবর জুলাই জাতীয় সনদে সই হয়। এতে এখন পর্যন্ত ২৫টি রাজনৈতিক দল ও জোট সই করেছে। কিন্তু জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) পাঁচটি দল এখনো সনদে সই করেনি।

যে উপায় কমিশনের বিবেচনায়

ঐকমত্য কমিশন সূত্র জানায়, সনদ বাস্তবায়নে এখন পর্যন্ত কমিশনের সিদ্ধান্ত হলো গণ-অভ্যুত্থানকে ভিত্তি ধরে প্রথমে ‘জুলাই সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ’ জারি করা হবে। সেটার অধীনে গণভোট নিয়ে একটি অধ্যাদেশ করা হবে। এর ভিত্তিতে হবে গণভোট। এ ছাড়া একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আগামী সংসদ নিয়মিত কাজের পাশাপাশি সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে কাজ করবে। ৯ মাসের মধ্যে সংসদ সংবিধান–সংক্রান্ত সংস্কার প্রস্তাবগুলো অনুমোদন করবে। কিন্তু এ সময় তা না করা হলে কী হবে তা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আগামী সংসদে সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করবে এমন নিশ্চয়তা বিধান করার বিষয়ে গতকাল বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠকে কমিশনের দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। এর আগে বৃহস্পতিবারের বৈঠকে দুটি বিকল্প আলোচনায় এসেছিল। এর একটি হলো এমন একটি বিধান করা, যেখানে বলা হবে নির্ধারিত সময়ে (৯ মাস) সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করা না হলে সংসদ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আরেকটি হলো, এমন বিধান করা যে নির্ধারিত সময়ে আগামী সংসদ সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন না করলে সেগুলো বাস্তবায়িত বলে গণ্য হবে।

দুই বিকল্পের সমস্যা যেখানে

কমিশন–সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গতকালের বৈঠকে এ দুটি উপায়ের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক নিয়ে বিস্তরিত আলোচনা হয়। আলোচনায় মত এসেছে, নির্ধারিত সময়ে সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন না করলে সংসদ বিলুপ্ত হয়ে যাবে, এমন বিধান আইনি দিক থেকে গ্রহণযোগ্য। কিন্তু তা রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে না। কারণ, সংসদ বিলুপ্ত হলে এক বছরের মধ্যে আরেকটি নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। সে নির্বাচন কার অধীনে হবে, সেই প্রশ্ন দেখা দেবে। আবার সংবিধান সংস্কার না হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে যুক্ত হবে না। বিদ্যমান সংবিধানে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা বলা আছে। এটি নিয়ে আবার রাজনৈতিক সংকট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা আছে। তা ছাড়া এক বছরের মধ্যে আরেকটি নির্বাচন আয়োজনও বিশাল ব্যয়সাপেক্ষ।

একাধিক সূত্র জানায়, নির্ধারিত সময়ে আগামী সংসদ সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন না করলে সেগুলো বাস্তবায়িত বলে গণ্য হবে—এমন বিধান করাও যৌক্তিক হবে না বলে গতকালের বৈঠকে মত এসেছে। কারণ, সনদটি বিল আকারে উপস্থাপন করা হচ্ছে না। সনদের কিছু বিষয় চূড়ান্ত নয়। যেমন বলা হয়েছে, মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ করা হবে। সেখানে কী কী থাকবে, তা আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করবে আগামী সংসদ। যদি স্বয়ংক্রিয়ভাবে গৃহীত হয় তাহলে এ ধরনের বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে কী হবে এ প্রশ্ন আছে। তা ছাড়া দিন শেষে সংস্কারগুলো সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে সংসদকেই। সেটা আপনা–আপনি সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে, এমন বলাটা বাস্তবসম্মত হবে না।

এখানে সমস্যা হবে, যদি নিয়মিত সংসদ না থাকে তাহলে সরকার গঠন করবে কে? দেশ পরিচালিত হবে কীভাবে? তখন অন্তর্বর্তী সরকারকেই দেশ চালাতে হবে। এটিও রাজনৈতিকভাবে বাস্তবসম্মত বলে মনে করছেন না বিশেষজ্ঞ ও ঐকমত্য কমিশনের সদস্যরা।

আরেক বিকল্প

ঐকমত্য কমিশন–সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, গতকালের বৈঠকে আরেকটি বিকল্প আলোচনায় এসেছিল। সেটি হলো প্রথমে একটি সময় পর্যন্ত সংসদ হবে শুধু সংবিধান সংস্কার পরিষদ বা গণপরিষদের মতো। সংবিধান সংস্কার করার পর তাঁরা নিয়মিত সংসদের সদস্য হিসেবে শপথ নেবেন। এটি হলে সংসদ সদস্যরা দ্রুত সংস্কারকাজ শেষ করবেন। কিন্তু এখানে সমস্যা হবে, যদি নিয়মিত সংসদ না থাকে তাহলে সরকার গঠন করবে কে? দেশ পরিচালিত হবে কীভাবে? তখন অন্তর্বর্তী সরকারকেই দেশ চালাতে হবে। এটিও রাজনৈতিকভাবে বাস্তবসম্মত বলে মনে করছেন না বিশেষজ্ঞ ও ঐকমত্য কমিশনের সদস্যরা।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, শেষ পর্যন্ত সনদ বাস্তবায়নের জন্য আগামী সংসদকে একটি নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু সেটা এনসিপি ও অন্য কিছু দল মানবে না।

এ ছাড়া সংবিধান সংস্কার পরিষদের কাজ কী হবে, সেটাও এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত করতে পারেনি কমিশন। সূত্র জানায়, কমিশন মনে করছে আগামী সংসদকে কনস্টিটুয়েন্ট পাওয়ার (গাঠনিক ক্ষমতা) দেওয়া হলে দুই–তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সংবিধানের সংশোধনী পাস করার বাধ্যবাধকতা দেওয়ার প্রয়োজন হবে না। সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সংবিধানের সংশোধনী পাস হবে। নিয়মিত সংসদের স্পিকারই সংবিধান সংস্কার পরিষদে সভাপতিত্ব করবেন।

সুপারিশ শিগগিরই

গতকাল দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জাতীয় সংসদে কমিশন কার্যালয়ের সম্মেলনকক্ষে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কমিশনের বৈঠক হয়। এতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম এ মতিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন মোহাম্মদ ইকরামুল হক, সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শরিফ ভূঁইয়া, ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিক ও ব্যারিস্টার তানিম হোসেইন।

আলোচনায় কমিশনের পক্ষে অংশ নেন সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ইফতেখারুজ্জামান ও মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া। এ ছাড়া জাতীয় ঐকমত্য গঠনপ্রক্রিয়ায় যুক্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারও এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

কমিশনের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, কমিশন আশা করে, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট ও পূর্ণাঙ্গ সুপারিশপত্র শিগগিরই সরকারের কাছে জমা দেওয়া যাবে।

এর আগে গতকাল সকালে জাতীয় সংসদের এলডি হলে এনসিপির সঙ্গে বৈঠক করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, এনসিপির প্রতিনিধিরা বলেছেন, তাঁরা সনদে স্বাক্ষর করতে চান। তাঁরা বেশ কিছু বক্তব্য দিয়েছেন। কমিশন কিছু বিষয়ে তাঁদের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে। কমিশন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে এগুলো নিয়ে আলোচনা করেছে। তাদের প্রস্তাবের ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দিকই আছে। সেগুলো বিবেচনা করে কমিশন এগোচ্ছে। কমিশনের মূল লক্ষ্য সব দল যেন সনদে সই করে।