Image description

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে অদৃশ্য এক চাপে পড়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সরকারপ্রধানের ঘোষিত সময় ধরে রোডম্যাপ অনুযায়ী প্রস্তুতি নিলেও নানা ইস্যুতে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না সংস্থাটি। প্রতীক বরাদ্দ, নতুন দলের নিবন্ধন, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা বাছাই এবং রাজনৈতিক সংলাপ- সব ক্ষেত্রেই চাপ ও চ্যালেঞ্জের মুখে কমিশন। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অদৃশ্য চাপ ইসির স্বাধীনতা ও প্রস্তুতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ঘোষণা অনুযায়ী ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের বাকি তিন মাস। সরকারপ্রধানের ঘোষিত সময়কে লক্ষ্যমাত্রা ধরে নিজেদের কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করেছে ইসি। সেই কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী অনেক কাজ গুছিয়ে নিয়েছে। তবে কিছু কিছু কাজ নিয়ে বর্তমানে বেশ চাপে পড়েছে সাংবিধানিক সংস্থাটি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার থেকে অন্য কমিশনার ও কর্মকর্তারা চাপের বিষয়টি উড়িয়ে দিলেও তাঁদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়ে চাপ দৃশ্যমান হচ্ছে বলেই মনে করেন বিশ্লেষকরা। এরই মধ্যে কয়েকটি বিষয় দৃশ্যমান হয়েছে। নির্বাচনী আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনীর ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতকে পাশ কাটিয়ে জোটবদ্ধ হলেও জোটের দলগুলোকে নিজ দলের প্রতীকে ভোট করার বাধ্যবাধতা জুড়ে দেওয়া হয়েছে।

এ নিয়ে প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ মিত্র দলগুলো আপত্তি জানিয়েছে। উপদেষ্টা পরিষদের সভায় অনুমোদনের পর আপত্তি দেওয়া ইসির জন্য বাড়তি চাপ। এ ছাড়া নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধন চূড়ান্ত করেও ঘোষণা দিতে পারছে না ইসি। জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) শাপলা প্রতীক ইস্যুতে ইসি-এনসিপির মধ্যে একাধিক বৈঠক হলেও সুরাহা হয়নি। এনসিপি শাপলা প্রতীকের ব্যাপারে অনড়; অন্যদিকে ইসিও শাপলা না দেওয়ার সিদ্ধান্তে অটল। এ নিয়ে এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা প্রশ্ন তুলেছেনÑ ইসি বিশেষ কোনো চাপের কারণে শাপলা দিতে অপারগ কিনা? ফলে বারবার সময় দিয়েও নতুন দলের নিবন্ধন প্রক্রিয়া শেষ করতে পারছে না সংস্থাটি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, নতুন নতুন ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলো থেকে যেভাবে আপত্তি জানানো হচ্ছে, তাতে এই কমিশনের জন্য নির্বাচনী প্রস্তুতিতে ব্যাঘাত ঘটছে। শুধু তাই না, নতুন চ্যালেঞ্জের মধ্যেও পড়ছে কমিশন।

ইসির নির্বাচনী কর্মপরিকল্পনা ও ঘোষণা অনুযায়ী চলতি অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ হওয়ার কথা ছিল। যেহেতু নতুন দলগুলোর নিবন্ধন প্রক্রিয়া শেষ হয়নি, তাই সংলাপের সূচি সাজানো পিছিয়ে গেছে। এ ছাড়া জুলাই সনদে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত কোন কোন দলকে সংলাপে আহ্বান করা হবে, সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। বর্তমানে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৫৭টি। তার মধ্যে সরকারের নির্বাহী আদেশে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ।

এ ছাড়া নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে চারটির। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগসহ পাঁচটি দলের নির্বাচন করার সুযোগ নেই। বাকি ৫২টি দলের মধ্যে কোন কোন দলকে আমন্ত্রণ জানানো হবে, তা নিয়ে সিদ্ধান্তহীন নির্বাচন কমিশন। কারণ, এরই মধ্যে বিগত তিনটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সহযোগী হিসেবে জাতীয় পার্টিকেও নিষিদ্ধের দাবি তোলা হয়েছে। তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে কোনো রাজনৈতিক দলকে আমন্ত্রণ জানিয়ে অহেতুক বিতর্কে জড়াতে চায় না ইসি। এ জন্য তারা সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ বেশ কয়েকটি দল সংসদ নির্বাচনের আগে নভেম্বরের মধ্যে গণভোটের দাবি তুলেছে। যদিও ইসির কাছে এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই।

নির্বাচন কমিশনের কাছে আরেকটি বড় চাপ ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা বাছাই। বিগত তিনটি নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী বিতর্কিত কর্মকর্তাদের আগামী ভোটে দায়িত্ব না দিতে বিএনপিসহ বেশকিছু দল আপত্তি জানিয়েছে। বিএনপি রাখঢাক না রেখে সরাসরি বলেছে ইসলামী ব্যাংক, ইবনে সিনা হাসপাতাল, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকসহ কিছু প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের যেন ভোটের দায়িত্বে না রাখা হয়।

এ বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এএমএম নাসির উদ্দিন বলেছেন, ‘গত তিনটি নির্বাচনে যাঁরা দায়িত্বে ছিলেন, তাঁদের নিয়ে সবাই তো সন্দেহ পোষণ করেন। তবে ভালো-খারাপ তো সবখানেই আছে। কিন্তু অনেকে বলছেন, গত তিন নির্বাচনে যারা কাজ করেছেন, তাঁরা যেন ধারেকাছে না আসতে পারেন। এখন ১০ লাখ লোকের (ভোটের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকে সাধারণত) মধ্যে বাদ দিতে গেলে- লোম বাছতে গিয়ে কম্বল উজাড়, আমার অবস্থা হয়েছে সে রকম।’

ইসির রোডম্যাপ অনুযায়ী ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে নিবন্ধনের আবেদন করা নতুন দলগুলোর কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করার কথা ছিল। এর আগে নির্বাচন কমিশন থেকে বলা হয়েছিল ২০ অক্টোবরের মধ্যে এনসিপি শাপলা ব্যতীত প্রতীক পছন্দ না করলে ইসি নিজ উদ্যোগে প্রতীক দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করবে। শেষ মুহূর্তে আবার দলটির শীর্ষ নেতারা সিইসির সঙ্গে দেখা করে শাপলা প্রতীকের বিষয় অবহিত করেন। এমনকি শাপলা প্রতীক না পেলে নির্বাচনে যাবে না বলে ছাত্রদের গড়া দলটি ঘোষণা দিয়েছে। পাশাপাশি এই কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ইসি পুনর্গঠনেরও দাবি করেছেন দলটির নেতারা। এই অবস্থায় গতকাল সোমবার আবারও ইসি সচিব জানিয়েছেন এনসিপিকে শাপলা প্রতীক দেওয়ার সুযোগ নেই। এতে রাজনীতিতে আবার নতুন উত্তাপ ছড়াতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

শুধু এনসিপির কারণে নিবন্ধনের চূড়ান্ত হওয়া আরও কয়েকটি দলের সিদ্ধান্ত আটকে রয়েছে। এ ছাড়া নিবন্ধন প্রক্রিয়া শেষে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের সূচি চূড়ান্ত করবে ইসি।

এদিকে নির্বাচনী সংলাপে কোন কোন দলকে আমন্ত্রণ জানাবে, তাও চূড়ান্ত করতে পারেনি ইসি। নিবন্ধিত সব দলকে ডাকবে নাকি জুলাই সনদে স্বাক্ষর করা এবং অভ্যুত্থানে সক্রিয় দলগুলোকেই আমন্ত্রণ জানাবে, তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। তাই অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে সংলাপের ঘোষণা করলেও তা আর সম্ভব হয়ে উঠছে না।

নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ড. আব্দুল আলীম আমাদের সময়কে বলেন, কিছু কিছু বিষয়ে চাপ তো বটেই। কিছু বিষয় ইসির জন্য চ্যালেঞ্জও। এতে ইসির কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। প্রতীক বরাদ্দ, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা বাছাই- এগুলো বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে। ভোটের আগে গণভোট- এটা ইসির জন্য চ্যালেঞ্জ। এটা করতে হলে নতুন করে প্রস্তুতি নিতে হবে। এ জন্য পরিষ্কার রোডম্যাপ থাকলে ইসির জন্য ভালো হতো। কতগুলো বিষয়ে চাপ থাকায় সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না নির্বাচন কমিশন।

সমস্যাগুলো ইসির জন্য বড় ইস্যু হবে না বলে মন্তব্য করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, সমস্যাগুলো ইসির জন্য খুব বড় সমস্যা নয়। শাপলা প্রতীক নিয়ে ইসির কাছে ‘ইগো’ ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেহেতু না করেছে, এখন দিলে বলা হবে একটা রাজনৈতিক দলের চাপে সিদ্ধান্ত বদল। তা হলে কীভাবে সুষ্ঠু নির্বাচন করবে? ইসলামি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা না রাখার বিষয়ে বিএনপির দাবি যৌক্তিক। জামায়াত নিজেই বলেছে এসব প্রতিষ্ঠানে তাদের কর্মী রয়েছে। কাজেই তাদের নির্বাচনী দায়িত্বে রাখা ঝুঁকিপূর্ণ। ভোটের আগে গণভোট- এটা সম্ভব না।

জামায়াত যেহেতু পিআর ইস্যুতে অনেকটাই হেরে গেছে, তাই তারা চাইছে এটাতে অন্তত বিজয়ী হতে। তবে বাস্তবতা এখন ভোটের আগে গণভোট করার মতো অবস্থায় ইসি নেই। এক দিনেই গণভোট হওয়া উচিত। জোটবদ্ধ দলগুলোর নিজ দলীয় প্রতীকে ভোটের বিষয়ে তিনি বলেন, এটা থাকা উচিত। ছোট ছোট দলগুলোর প্রতীক ভোটারদের জানার দরকার আছে।

নির্বাচন কমিশন সচিব আখতার আহমেদ বলেছেন, রোডম্যাপ ধরে সব ধরনের প্রস্তুতি এগিয়ে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত আতঙ্কিত বা দুশ্চিন্তায় পড়ার মতো কোনো কারণ আমি দেখছি না। কর্মপরিকল্পনার সময় অনুযায়ী দিনক্ষণ মেপে কোনো কাজ করা সম্ভব নয়। পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে কিছু কিছু জায়গায় সমন্বয় করতে হয়। কিছু কিছু বিষয় আগে করা হয়েছে; কিছু কিছু বিষয়ের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে, আর কিছু কিছু বিষয়ে আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে।