অব্যাহত গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট, অন্যদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দেশে ভারী শিল্পপণ্যের চাহিদা, উৎপাদন, বিক্রি ও মুনাফা কমেছে আশঙ্কাজনক হারে। ফলে এ শিল্পমালিকদের মধ্যে বিরাজ করছে পুঁজি হারানোর আশঙ্কা, দেখা দিয়েছে উদ্বেগ। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কয়েকটি বড় অগ্নিকাণ্ডের উৎকণ্ঠা। তৈরি পোশাক, কেমিক্যাল কারখানা ও সবশেষ বিমানবন্দরের অভ্যন্তরে কার্গো ভিলেজে আগুনে ছাই হয়ে যাওয়া প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার আমদানীকৃত কাঁচামালের ক্ষতি পোষাতে ব্যবসায়ীদের বেগ পেতে হবে অনেক দিন।
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের এক বছরে প্রায় ২৫০টি ছোটবড় কারখানা বন্ধ হয়েছে। বেকার হয়েছে প্রায় দেড় লাখ শ্রমিক। এ ছাড়া রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর এ শিল্প খাতসংশ্লিষ্ট অনেকের বিরুদ্ধেই হয়রানিমূলক মামলা হয়েছে। আবার অনেক শিল্পমালিক মামলার বোঝা মাথায় নিয়ে কোনোরকমে শিল্প টিকিয়ে রেখেছেন। এ শিল্প খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২৩-২৪ সালে শিল্পে গ্যাসের দাম বেড়েছে ১৭৮ শতাংশ। সবশেষ এপ্রিলে নতুন শিল্প ও ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য গ্যাসের দাম আরও ৩৩ শতাংশ বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, এতে নতুন বিনিয়োগকারীরা পিছিয়ে যাচ্ছেন। পাশাপাশি পুরোনো শিল্পমালিকরাও চাপে পড়েছেন। কারণ অনুমোদিত লোডের ৫০ শতাংশের বেশি ব্যবহার করলে তাদেরও গুনতে হচ্ছে বাড়তি দাম। এত উচ্চ দাম দিয়ে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস পাওয়া দুষ্কর হয়ে যাচ্ছে। বিদ্যুতের অবস্থা তো আরও খারাপ। গত ১৪ বছরে দেশে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে নয়বার। এ সময়ে বিদ্যুতের দাম পাইকারি পর্যায়ে ১১৮ আর গ্রাহক পর্যায়ে বেড়েছে ৯০ শতাংশ; যা শিল্পোৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এ ছাড়া গত এক বছরে নির্মাণ খাতে নেমে এসেছে চরম দুর্দশা। এর ফলে রড, সিমেন্ট, টাইলস, সিরামিকসহ এ খাতের বিভিন্ন পণ্যের চাহিদাও কমেছে আশঙ্কাজনক হারে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আমিরুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সবার প্রত্যাশা সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসবে। তখন হয়তো শিল্প খাতের চাকা সচল হবে। গত এক বছর সিমেন্ট শিল্পের চাহিদা খুব একটা না কমলেও মুনাফায় ধস নেমেছে। কেননা অনেকটা বাধ্য হয়েই মুনাফার মার্জিন কমিয়ে আমরা বিক্রি মোটামুটি ঠিক রেখে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছি।’ যত তাড়াতাড়ি সুষ্ঠু নির্বাচন হবে, তত তাড়াতাড়ি দেশের শিল্প খাত আবারও ঘুরে দাঁড়াবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
সিমেন্ট শিল্পের প্রধান কাঁচামাল ক্লিংকার। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এর আমদানি ছিল ১ কোটি ৯০ লাখ টন, আগের বছর (২০২৩-২৪) যা ছিল ২ কোটি ৪ লাখ টন। অর্থাৎ আমদানি কমেছে ৭ শতাংশ। এতে ব্যবসাবাণিজ্য টিকিয়ে রাখতে কোনোরকমে চালু রাখা হয়েছে এসব শিল্পকারখানা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে দেশে ভারী শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে। চাহিদা সংকুচিত হওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তাদের মতে রাজনৈতিক অস্থিরতা, সুদের হার বাড়ানো ও জ্বালানিসংকটে ধুঁকছে শিল্প খাত। পুরোনো কারখানাগুলোয় যখন উৎপাদনে ভাটা চলছে, তখন নতুন বিনিয়োগের ঝুঁকি নিচ্ছেন না দেশিবিদেশি উদ্যোক্তারা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশে ১৩ কোটি ৭১ লাখ টন পণ্য আমদানি হয়েছে, যাতে স্থানীয় মুদ্রা ব্যয় হয়েছে ৬ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। আগের অর্থবছরে (২০২৩-২৪) এ আমদানির পরিমাণ ছিল ১৩ কোটি ১৭ লাখ টন, ব্যয় হয়েছিল ৬ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। সামগ্রিকভাবে পরিমাণে ৪ শতাংশ আমদানি বাড়লেও শিল্প খাতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভারী কাঁচামালের আমদানি প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক পর্যায়ে রয়েছে। রডসহ নির্মাণশিল্পের কাঁচামালের অন্যতম উৎস জাহাজভাঙা কারখানা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে যেসব পুরোনো জাহাজ আমদানি হয়েছে, সেগুলোয় লোহার পরিমাণ ৮ লাখ ৪৫ হাজার টন। এর আগের (২০২৩-২৪) অর্থবছরে আমদানি হওয়া পুরোনো জাহাজে লোহার পরিমাণ ছিল প্রায় ১০ লাখ টন। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে আমদানি কমেছে ১৫ শতাংশ।