Image description

বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি ধর্মীয় সংগঠনের ব্যানারে জড়ো হওয়া প্রখ্যাত আলেম ও উলামারা সম্প্রতি প্রকাশিত Bangla Outlook-এর একটি প্রতিবেদনকে কঠোর ভাষায় নিন্দা জানিয়েছেন। প্রতিবেদনে ইসলামি শিক্ষাবিদদের সীমানা পেরিয়ে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে জড়িয়ে দেখানো হয়েছে—যা তারা বলেছেন ‘ভ্রান্ত’, ‘ভিত্তিহীন’ এবং ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’।

জুলকারনাইন সায়ের নামের এক সাংবাদিক লিখেছেন প্রতিবেদনটি, যার শিরোনাম ছিল—‘The Quiet Architect of a Cross-Border War: Imran Haider and the Making of the Indo-TTP Pipeline from Bangladesh’। এতে বেশ কিছু পরিচিত আলেমকে অবৈধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত বলে দাবি করা হয়েছে।

প্রতিবেদন প্রকাশের পর ‘উলামা জনতা ঐক্য পরিষদ’ এক বিবৃতিতে প্রতিবেদনের তথ্যের ঘাটতি এবং অনুমাননির্ভর অভিযোগের সমালোচনা করে বলে—এটি ইসলামি শিক্ষাবিদদের বিরুদ্ধে একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা।

সংগঠনের পক্ষ থেকে বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন মাওলানা নাজমুল হক সাকিব। তিনি এই প্রতিবেদনকে সরাসরি ‘কল্পনার গল্প’ বলে অভিহিত করেন।

২৩ অক্টোবর রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘সিভিল সোসাইটির উদ্বিগ্ন ওলামাগণ’ ব্যানারে এক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বক্তারা প্রতিবেদনের অভিযোগগুলো সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন এবং অতীতে তারা যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছেন, তা তুলে ধরেন।

প্রতিবেদনে যাদের নাম এসেছে, তাদের একজন মোহাম্মদ আবু সাঈদ উপস্থিত হয়ে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর তিনি ‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিত সিটিটিসি কার্যালয়ের একটি নির্জন আটক কেন্দ্রের অস্তিত্ব প্রকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

তিনি বলেন, ‘৭ আগস্ট আমরা আন্দোলন শুরু করি আয়নাঘর উন্মোচনের দাবিতে। এরপর সংবাদমাধ্যম ও সেনাবাহিনী সেখানে যায় এবং জায়গাটি জনসমক্ষে আসে।’

তিনি আরও জানান, এরপর এয়ারপোর্টের কাছে র‍্যাব ক্যাম্পের সামনে প্রতিবাদ অব্যাহত ছিল। ‘Council Against Injustice’ নামের একটি সংগঠন, যেটি তিনি বিভিন্ন পেশার মানুষদের নিয়ে গড়ে তোলেন, তারাও এই আন্দোলন চালিয়ে যায়।

আবু সাঈদ সতর্ক করেন যে, আয়নাঘরে প্রমাণ নষ্ট করার চেষ্টা চলছিল। যদি সরকার সঠিক সময়ে পদক্ষেপ নিত, তাহলে এই জায়গাটি জনসাধারণের পর্যবেক্ষণের জন্য সংরক্ষিত রাখা যেত।

ওলামারা প্রতিবেদনে নাম উল্লেখ করা আরেকজন আলেম, মুফতি মাহমুদুল হাসান গুনবীকে নিয়ে বলেন, তিনি ‘দাওয়াতুল ইসলাম বাংলাদেশ’-এর আমীর এবং ‘মাদরাসাতুদ দাওয়াতিল ইসলাম বাংলাদেশ’-এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন।

তারা জানান, চট্টগ্রাম পার্বত্য এলাকায় ইসলামী শিক্ষা ও দাওয়াত প্রচারে তার ভূমিকা এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

প্রতিবেদনের সাধারণ অভিযোগ নিয়ে ওলামারা বলেন, ‘আমরা মনে করি, মুফতি গুনবীকে টার্গেট করার কারণ এই কাজগুলোই।’ তারা বলেন, যেসব আলেম সমাজে সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন, তাদের নাম এক ধরনের কল্পিত ষড়যন্ত্রের জালে জড়ানো হচ্ছে—যার উদ্দেশ্য মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ও আতঙ্ক ছড়ানো।

প্রতিবেদনটি প্রসঙ্গে তারা আরও বলেন, এটি সাংবাদিকতার ন্যূনতম মান বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। এটি একটি ‘অর্ডার করা গল্প’, যেখানে কল্পনা ও অভিযোগকে মিলিয়ে তথ্যপ্রমাণহীন এক বয়ান তৈরি করা হয়েছে।

লিখিত বিবৃতিতে ওলামারা একাধিক স্পষ্ট আপত্তি তুলে ধরেন—

প্রথমত, প্রতিবেদনে অনেক তথ্য একত্র করে, ‘তদন্তে পাওয়া গেছে’ এমন শব্দ ব্যবহার করে যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। অথচ কোনো পর্যায়েই সুনির্দিষ্ট প্রমাণ দেখানো হয়নি।

তারা বলেন, ‘এখানে কোনো তথ্যপ্রমাণ নেই, তবু প্রতিবেদনে তা গোপন করা হয়েছে।’ এ ধরনের কৌশল অতীতেও ইসলামি আলেমদের দমন করার জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল বলে তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

দ্বিতীয়ত, প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কিছু ব্যক্তি বিদেশ ভ্রমণ করেছেন এবং বিদেশি সংযোগে জড়িত ছিলেন। কিন্তু এ বিষয়ে একটি বিশ্বাসযোগ্য সূত্রও দেখানো হয়নি।

তৃতীয়ত, প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘এটি হয়তো খোলা সম্ভব না হলেও, অমুক ব্যক্তি কুরআন-হাদীস শেখানোর আড়ালে এই কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।’ এই বক্তব্য দিয়ে অভিযোগ প্রমাণ এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশের একাধিক আলেম ও উলামা সম্প্রতি একটি প্রতিবেদনের কঠোর সমালোচনা করেছেন, যেখানে ইসলামি চিন্তাবিদদের বিরুদ্ধে সীমানা পেরিয়ে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ তোলা হয়েছে। আলেমরা বলেছেন, এ ধরনের প্রতিবেদন অনুমাননির্ভর এবং এর মাধ্যমে যে কেউকে কোনো প্রমাণ ছাড়াই অভিযুক্ত করা সম্ভব হয়ে যায়—যা গভীর উদ্বেগের বিষয়।

চতুর্থ দিক থেকে তারা প্রতিবেদনটির যুক্তির অসঙ্গতি তুলে ধরেন। প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, কেউ যদি গণতন্ত্র বা উদারনৈতিক মতবাদে বিশ্বাসী হন, তাহলে সেই বিশ্বাস যাদের মধ্যে আছে—তারা সবাই একই অপরাধের সঙ্গে জড়িত বলে ধরে নেওয়া যায়। আলেমরা এই যুক্তিকে ‘উদ্ভট ও মনগড়া’ বলে অভিহিত করেন। তারা বলেন, এটি এমনই যুক্তি, যেন বলা হয়—বিশ্বজুড়ে সব উদারপন্থীই ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডে জড়িত। অথচ এটি সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য এবং অসংলগ্ন এক ভাবনা।

বিবৃতিতে আলেমরা আবারও জোর দিয়ে বলেন, তাদের সমস্ত কর্মকাণ্ড ইসলামি দায়িত্ববোধ এবং দেশের বাস্তবতা ও জাতীয় প্রয়োজন অনুযায়ী পরিচালিত হয়। কোনো সশস্ত্র বা বৈদেশিক সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার ইঙ্গিত ‘সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার’ বলে তারা জানান।

তারা বলেন, বাংলাদেশের মুসলমানদের সম্মান, মর্যাদা ও নিরাপত্তা জাতীয় স্থিতিশীলতার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। তাই শান্তি বাহিনী, ইউপিডিএফ, কেএনএফ এবং আরাকান আর্মির মতো গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। এই গোষ্ঠীগুলোর প্রতি যে কোনো রকমের নমনীয়তা দেশকে বিপদে ফেলতে পারে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে এবং সমাজে ধার্মিক মুসলমান ও ইসলামি শিক্ষাবিদদের অবদানের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে আলেমরা বলেন, এই শ্রেণির সামাজিক প্রভাব জাতীয় নিরাপত্তার একটি অন্যতম ভিত্তি। তারা বলেন, ‘এই প্রভাবকে সম্মান জানানো এবং গুরুত্ব দেওয়া দেশের স্থিতিশীলতার স্বার্থে অত্যন্ত জরুরি।’

সবশেষে তারা ‘Bangla Outlook’-এর প্রতি আহ্বান জানান, যেন এই প্রতিবেদনটি অবিলম্বে সব মাধ্যম থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়, প্রকাশ্যে দুঃখপ্রকাশ করা হয় এবং একটি স্পষ্ট প্রত্যাহার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। তারা সতর্ক করেন, এই আহ্বানে সাড়া না দিলে, তারা আইনি ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবেন।

Bangla Outlook-এর প্রতিক্রিয়া

সংবাদমাধ্যম ‘Bangla Outlook’ তাদের প্রতিবেদনটি একটি নির্ভরযোগ্য গোয়েন্দা নথির ভিত্তিতে প্রকাশ করেছে বলে জানিয়েছে। প্রতিবেদক নিজ উদ্যোগে সেই তথ্যপত্রে উল্লিখিত বিষয়গুলো একাধিক উৎসের মাধ্যমে যাচাই করেছেন।

সংস্থাটির দাবি, গোয়েন্দা নথিটি একটি সক্রিয় গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে মাঠপর্যায় থেকে সংগ্রহ করা তথ্যের উপর ভিত্তি করে তৈরি। এতে যুক্তিসঙ্গতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্রতিবেদনে যাদের নাম রয়েছে, তারা কিছু সন্দেহজনক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।

এই অনুসন্ধানের সূত্রপাত হয়েছিল এমন একটি ঘটনার মাধ্যমে, যেখানে একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী পাকিস্তানে প্রবেশ করে টিটিপি-তে যোগ দিতে গিয়ে এক ব্যক্তির মৃত্যু ঘটে। সেই ঘটনার সূত্র ধরে বাংলাদেশে একটি সম্ভাব্য নিয়োগ প্রক্রিয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যায়, যেটি একাধিক উৎস এবং গোয়েন্দা ডেটার সমর্থনে তৈরি হয়।

যদিও আলেমদের একটি দল প্রতিবেদনটিকে ‘ভ্রান্ত’ ও ‘কল্পিত’ বলে দাবি করেছে, তারা এখন পর্যন্ত কোনো বিশ্বাসযোগ্য পাল্টা প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেননি—যা তাদের সম্পৃক্ততার সম্ভাবনাকে পুরোপুরি অস্বীকার করে।

‘Bangla Outlook’ জোর দিয়ে বলেছে, গুম এবং ‘আয়নাঘর’-এর মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় যারা ভুক্তভোগী, তাদের প্রতি তারা সহমর্মী। তবে অতীতের ঘটনা সামনে এনে বর্তমানের বিষয়গুলো ঢেকে ফেলার যে চেষ্টা চলছে, সেটি বর্তমান বাস্তবতা অস্বীকারের সামিল।

প্রতিবেদনে নাম আসা মুফতি গুনবীকে ঘিরে বিশেষভাবে বলা হয়েছে, তিনি বিভিন্ন সময়ে ‘গাজওয়াতুল হিন্দ’—একটি ভবিষ্যদ্বাণীকৃত যুদ্ধ—নিয়ে বহু বক্তব্য দিয়েছেন। তাকে আদর্শিক প্রচারক হিসেবে তুলে ধরা হয়, যার বক্তব্য কিছু মানুষকে টিটিপি-র মতো সংগঠনে যোগদানের দিকে প্রভাবিত করতে পারে। প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, তার কর্মকাণ্ডের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের কোনো বিষয় জড়িত নয়।

ওলামারা প্রতিবেদনটিতে যে ‘ত্রুটি’ দেখিয়েছেন, তার উত্তরে ‘Bangla Outlook’ দৃঢ়ভাবে তাদের অবস্থানে অটল রয়েছে। তাদের ভাষ্য, এই প্রতিবেদন একটি বিশ্বাসযোগ্য গোয়েন্দা নথির ভিত্তিতে তৈরি, যেটি একাধিক স্বাধীন উৎস থেকে যাচাই ও সমর্থিত।