Image description
 
 

একটি শিশুর সঙ্গে বড় হবে প্রায় ৬০০ গাছ। দীর্ঘ হবে ছায়া, বাড়বে অক্সিজেন। কোনোটি মরে গেলে বা কেউ উপড়ে ফেললে আরেকটি নতুন গাছ লাগানো হবে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন স্থানে এখন এই সব গাছ বড় হচ্ছে। যে শিশুকে উপলক্ষ করে এই গাছ লাগানো হয়েছে, তার নাম আয়ান খান রুহাব। শিশুটির বয়স এখন মাত্র আট মাস। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে জন্ম নেওয়া শিশু আয়ানকে এখন বাংলাদেশের প্রথম ‘কার্বন-নিরপেক্ষ (নিউট্রাল) শিশু’ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে।

১৯ অক্টোবর রাজধানীর বসুন্ধরায় আইইউবি মাল্টিপারপাস হলে ঢাকা প্ল্যান্টার্সের আয়োজনে আনুষ্ঠানিকভাবে আয়ানকে বাংলাদেশের প্রথম ‘কার্বন-নিরপেক্ষ শিশু’ ঘোষণা করা হয়। ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইসিসিসিএডি) এবং ঢাকা প্ল্যান্টার্সের পক্ষ থেকে এই ঘোষণা দেওয়া হয়।

এর আগে বিশ্বের প্রথম কার্বন–নিরপেক্ষ শিশু হিসেবে স্বীকৃতি পায় ভারতের তামিলনাড়ুর দুই বছরের শিশু আদাভি। তামিলনাড়ুর কৃষকদের সহায়তায় আদাভির জন্মের অনেক আগে থেকেই প্রায় ছয় হাজার ফলের গাছ লাগিয়েছিলেন তার মা–বাবা। কার্বন-নিরপেক্ষ মানুষ মানে কোনো ব্যক্তি বাতাসে যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ করেন, সেই পরিমাণ কার্বন শোষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মা–বাবা প্রায় ছয় হাজার গাছ লাগিয়ে কার্বন শোষণের যে ব্যবস্থা করেছেন, তার স্বীকৃতি হিসেবে আদাভিকে বিশ্বের প্রথম কার্বন-নিরপেক্ষ শিশু অভিধা দেয় এশিয়া বুক অব রেকর্ডস।

সাতক্ষীরার শিশু আয়ানের মা আয়শা আক্তার প্রথম আলোকে বললেন, ‘সন্তানের প্রাকৃতিক সুরক্ষার কথা ভেবে গাছ লাগানোর ভাবনা মাথায় এসেছে। এমন নয় যে গাছ লাগানো এখানেই শেষ। গাছের সংখ্যা আরও বাড়বে।’

আয়শা আক্তার বর্তমানে খুলনার একটি কলেজে স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। গত বুধবার দুপুরে তিনি পরীক্ষার হলে ছিলেন। বের হয়ে কথা বললেন প্রথম আলোর সঙ্গে। বললেন, সাতক্ষীরা দুর্যোগপ্রবণ এলাকা। আয়ানের দাদাবাড়ি-নানাবাড়ি দুটিই এখানে। গাছগুলো দেখভাল করার প্রয়োজন আছে, তাই সব গাছই লাগানো হয়েছে আত্মীয়স্বজনের জমিতে। ফলদ গাছের ফল গ্রামের শিশুরাও খেতে পারবে।

মা–বাবার কোলে শিশু আয়ান খান। তার জন্য সাতক্ষীরায় ৫৮০টি গাছ লাগিয়েছেন মা–বাবা
মা–বাবার কোলে শিশু আয়ান খান। তার জন্য সাতক্ষীরায় ৫৮০টি গাছ লাগিয়েছেন মা–বাবাছবি: শিশু আয়ান খানের পরিবারের সৌজন্যে

সাতক্ষীরার তালা উপজেলাসহ বিভিন্ন স্থানে এসব ফলদ ও বনজ গাছ লাগানো হয়েছে। এসব গাছের মধ্যে আছে কাঁঠাল, আম, জাম, নিম, সুপারিসহ অনেক ধরনের গাছ। আয়ানের জন্য লাগানো গাছের কোনোটি বসতির ভেতরে, কোনোটি পথের ধারে, কোনোটি এখন বড় হচ্ছে পুকুরের পাশে আরেক গাছের সঙ্গে গলাগলি করে।

আয়শা জানান, তাঁর সন্তানের সঙ্গে গাছগুলো বড় হতে দেখার আনন্দ আছে। তবে তাঁর সন্তান ‘কার্বন–নিরপেক্ষ শিশু’ হবে, এটি চিন্তা করে গাছ লাগাননি। এখন এই স্বীকৃতি আরও গাছ লাগাতে উৎসাহ জোগাচ্ছে।

শিশু আয়ান খানের বাবা ইমরান রাব্বী ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটিতে ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিষয়ে স্নাতকোত্তর পড়ছেন। তিনি পরিবেশবাদী সংগঠন গ্রিনম্যানের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ইমরান রাব্বী প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের মানুষের গড়ে প্রতিবছর কার্বন নিঃসরণের যে হার, তাতে প্রত্যেকের জন্য অন্তত ৫৪টি করে কাঁঠালগাছ লাগানো প্রয়োজন। সেই হিসাব থেকে তিনি বাচ্চার জন্য গাছ লাগানোর চিন্তা করেছিলেন। সেটা পরে ৫৮০টিতে গিয়ে পৌঁছায়।

বিশ্বব্যাংকের ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতিবছর একজন মানুষ গড়ে শূন্য দশমিক সাত টন কার্বন নিঃসরণ করেন। গ্রিনম্যানের সভাপতি ইমরান রাব্বীর হিসাবে এই পরিমাণ কার্বন শোষণ করতে পারে ৫৪টি কাঁঠালগাছ।

শিশু আয়ান খানের কথা মাথায় রেখে সাতক্ষীরায় ৫৮০টি গাছ লাগিয়েছেন তার মা–বাবা। এসব গাছ লাগানোর জন্য জমিতে নিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাসী
শিশু আয়ান খানের কথা মাথায় রেখে সাতক্ষীরায় ৫৮০টি গাছ লাগিয়েছেন তার মা–বাবা। এসব গাছ লাগানোর জন্য জমিতে নিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাসীছবি: শিশু আয়ান খানের পরিবারের সৌজন্যে

আয়ানকে বাংলাদেশের প্রথম ‘কার্বন-নিরপেক্ষ শিশু’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া নিয়ে যোগাযোগ করা হয় ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের সঙ্গে। এই গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশের ইয়ুথ অ্যান্ড জেন্ডার–বিষয়ক প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর সুমাইয়া বিনতে সেলিম প্রথম আলোকে বলেন, গাছ রোপণ করলেই হবে না। সেই গাছের তদারকি করতে হবে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হলে নতুন গাছ রোপণ করতে হবে। এসব বিবেচনা করা হয় এই স্বীকৃতির ক্ষেত্রে। ভারতের শিশুটি এই স্বীকৃতি পাওয়ার পর তাঁরা উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। কার্বন–নিরপেক্ষ ঘোষণা একটা সম্মানজনক স্বীকৃতি। পরিবেশের প্রতি মানুষের সচেতনতা বাড়াতে এই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে শিশুটিকে।

আয়ানের বাবা ইমরান রাব্বী জানান, এই গাছগুলোই তাঁর সন্তানকে দিন শেষে বিশেষ সহায়তা দেবে বলে তাঁর বিশ্বাস। তিনি বিশ্বাস করেন, যেকোনোভাবেই হোক প্রকৃতি এ ব্যবস্থা করবে। তাই সন্তানকেও গাছ লাগাতে শেখাবেন তিনি।

শিশু আয়ান খান বড় হয়ে গাছ নিয়ে কতটা ভাববেন, তা দেখতে অপেক্ষা করতে হবে। তবে আট মাসের শিশু যে শত শত গাছের মালিক, এটা অনেকের কাছেই দারুণ ব্যাপার!