Image description
 

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো হাউস পুড়ে ছাই হয়ে গেছে গত শনিবারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে। এরপর বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্য রাখা হয় খোলা আকাশের নিচে। এতে করে হাজার কোটি টাকার এসব পণ্য নষ্ট হয়ে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দেয়। এমন পরিস্থিতিতে বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) থার্ড টার্মিনালের নবনির্মিত কার্গো হাউসটি ব্যবহার করতে চিঠি দেয় নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানকে। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ার এ প্রতিষ্ঠানটি এতে অস্বীকৃতি জানায়। এর যুক্তিসঙ্গত কারণও রয়েছে।

জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি বেবিচকের কাছে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা পাওনা হিসেবে দাবি করে চিঠি দেওয়ার পাশাপাশি বারবার তাগাদা দিয়ে আসছে। কিন্তু এ বিষয়ে বেবিচক এতদিন কর্ণপাত করেনি। শুধু তাই নয়। জাপান ও কোরিয়ার ঢাকাস্থ রাষ্ট্রদূতও এ বিষয়ে বেসরকারি বিমান চলাচল উপদেষ্টাকে উদ্বেগ প্রকাশ করে চিঠি দিয়েছেন। তাতেও কিছু হয়নি। পরবর্তীকালে এ দুই রাষ্ট্রদূত প্রধান উপদেষ্টাকেও বিষয়টি অবহিত করেন। কিন্তু এর পরও সুরাহা হয়নি। সঙ্গত কারণেই অগ্নিকাণ্ডের পর বেবিচক কার্গো হাউসটি ব্যবহার করতে চাইলে বেঁকে বসে কোরিয়ান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি। এমনকি দাবিকৃত অর্থ আদায়ে প্রতিষ্ঠানটি আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হতে পারে বলেও সতর্কবার্তা দিয়েছে। এতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি ভবিষ্যতে বিদেশি বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাবও পড়তে পারে।

জরুরি প্রয়োজন সত্ত্বেও থার্ড টার্মিনালের কার্গো হাউস কেন ব্যবহার করতে পারছে না বেবিচক- এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য।

প্রাপ্ত তথ্য বলছে, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল হস্তান্তর ও পরিচালনার জন্য জাপানি অপারেটর নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে বড় ধরনের জটিলতা তৈরি হয়েছে। বিষয়টি গড়িয়েছে বন্ধুপ্রতিম দুই দেশের সরকারি পর্যায়ে। বকেয়া পাওনা পরিশোধ, থার্ড টার্মিনাল হস্তান্তর এবং অপারেটর নিয়োগ নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা নিরসনে ইতোপূর্বে ঢাকাস্থ জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত পৃথক দুটি চিঠি পাঠিয়েছেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিনকে। চিঠিতে তাঁরা সৃষ্ট জটিলতা বা বিরোধ দ্রুত সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন। পাশাপাশি প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরকেও বিষয়টি অবহিত করেছেন দুই দেশের রাষ্ট্রদূত।

গত ২০ জুলাই দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত বিমান উপদেষ্টাকে পাঠানো চিঠিতে উল্লেখ করেছেন, ‘শাহজালাল বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল প্রকল্প বাংলাদেশের উন্নয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হলেও আর্থিক বিরোধের কারণে এটি বর্তমানে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। কোরিয়ান প্রতিষ্ঠান স্যামসাং সিঅ্যান্ডটি করপোরেশন, যা এডিসির অন্যতম অংশীদার, প্রকল্পে তাদের কাজ সম্পন্ন করলেও এখনও বিশাল অঙ্কের বকেয়া অর্থ পায়নি। কোভিড-১৯, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা বৈশ্বিক সংকটের মধ্যেও প্রকল্পটি ২০২৪ সালের ২ জানুয়ারি সফলভাবে সম্পন্ন হয়। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী বেবিচক তাদের দায়িত্ব পালন করেনি।’

চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, নতুন টার্মিনালের জন্য নির্ধারিত বিমানবন্দর অপারেটর নিয়োগে বিলম্বের কারণে এডিসিকে অতিরিক্ত সময় ধরে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। অথচ এর বিনিময়ে কোনো অর্থ প্রদান করা হচ্ছে না। এতে করে কনসোর্টিয়ামকে বিপুল অতিরিক্ত ব্যয় বহন করতে হচ্ছে, যা তাদের আর্থিক ক্ষতির কারণ হচ্ছে।

অন্যদিকে জাপানের রাষ্ট্রদূতও গত ৩০ জুলাই এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিমান উপদেষ্টাকে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। এতে তিনি উল্লেখ করেছেন- ‘এ প্রকল্প বাংলাদেশ-জাপান অংশীদারত্বের প্রতীক। কিন্তু বকেয়া অর্থ প্রদান ও অতিরিক্ত খরচ নিয়ে দীর্ঘসূত্রতা জাপান সরকারের গভীর উদ্বেগের কারণ হয়েছে।’ চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, প্রকল্পের উল্লেখযোগ্য অংশের ভৌত কাজ শেষ করেছে এডিসি, তবু প্রত্যায়িত অনেক অর্থ এখনও পরিশোধ করা হয়নি। বেবিচক কর্তৃপক্ষ এখনও এ সুবিধা আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করেনি, যার ফলে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বহন করে চলেছে।

চিঠিতে সতর্ক করা হয়েছে, যদি দ্রুত সমাধান না আসে, তাহলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আইনি পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হতে পারে, যা সালিশি প্রক্রিয়ায় গড়াতে পারে। এতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি ভবিষ্যতে বিদেশি বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। রাষ্ট্রদূতের মতে, ‘আইনি প্রক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদি ও ব্যয়বহুল। তার ওপর, যদি এই সময়ে টার্মিনালের রক্ষণাবেক্ষণ যথাযথভাবে না হয়, বাংলাদেশের আর্দ্র আবহাওয়ার কারণে যন্ত্রাংশ ও ইলেকট্রনিক সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

দুই দেশের রাষ্ট্রদূতের চিঠিতেই আরও উল্লেখ করা হয়েছে, থার্ড টার্মিনাল প্রকল্পটি কেবল একটি অবকাঠামো নয়, বরং বাংলাদেশের প্রতি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধির প্রতীক। কিন্তু চলমান আর্থিক অনিশ্চয়তা সেই আস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। কোরিয়ান রাষ্ট্রদূত তাঁর পত্রে উল্লেখ করেন, যদি দ্রুত সমাধান না আসে, এটি বাংলাদেশে কোরিয়ান বিনিয়োগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মোস্তফা মাহমুদ সিদ্দিক অর্থ দাবির বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, অগ্নিকাণ্ডের পর ওয়্যার হাউস নিয়ে আমরা কিছুটা সমস্যায় আছি। নতুন ওয়্যার হাউসের টাকা নিয়ে ঠিকাদারের সঙ্গে কথা হচ্ছে। তাদের দাবিকৃত অর্থের পরিমাণ বেশি হওয়ায় জটিলতা তৈরি হয়েছে। এর পরও আমরা চেষ্টা করছি বিষয়টি দ্রুত সমাধানের। পাশাপাশি সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও বিষয়টি নিয়ে সার্বক্ষণিক আলোচনা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আমাদের কাছে ১ হাজার কোটি টাকা দাবি করছে। এটা সমাধানের জন্য ডিসপুট বোর্ড গঠন করা হয়েছে। তাদের মতামতের ভিত্তিতেই আশা করছি সমাধান হবে।

বিমান পরিচালনা পরিষদের সাবেক সদস্য ও এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহেদুল আলম আমাদের সময়কে বলেন, তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিশ্চয় যুক্তিসঙ্গতভাবে অর্থ দাবি করছে। যদি ১ হাজার কোটি টাকা পাওনা থাকে, তা হলে দুই পক্ষ বসে এর সমাধান করতে হবে। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনের সময় কার্গো হাউস ব্যবহার করতে না পারা আমাদের জন্যই ক্ষতি- বলেন তিনি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেবিচকের এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, আগুনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত কার্গো হাউসটি চালু করা আপাতত সম্ভব নয়। নবনির্মিত তৃতীয় টার্মিনালের আওতায় অত্যাধুনিক দুটি হ্যাঙ্গার কমপ্লেক্স রয়েছে। একটি আমদানি ও অপরটি রপ্তানি পণ্য রাখার জন্য। ১৮ মাস আগে নির্মাণ সম্পন্ন হলেও বেবিচক কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে তা বুঝে নেওয়া হয়নি। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বারবার চিঠি দিয়েছে বুঝে নেওয়ার জন্য। কিন্তু বেবিচক তা আমলে নেয়নি। এখন সংকট সৃষ্টি হওয়ায় শুরু হয়েছে বেবিচকের দৌড়ঝাঁপ। এর মধ্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানও বেঁকে বসেছে। তারা আগে দাবিকৃত অর্থ বুঝে নিতে চাইছে। তিনি আরও বলেন, যে মানের এ হ্যাঙ্গার কমপ্লেক্স তৈরি করা হয়েছে এবং আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়েছে, তা পরিচালনার জন্য দেশে কোনো দক্ষ জনবল নেই। এ অবস্থায় বেবিচক বুঝে নিলেও পরিচালনার ক্ষেত্রে বড় ধরনের সমস্যায় পড়বে।

বেবিচক সূত্র জানায়, প্রকল্পের কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্ত হলেও কিছু কারিগরি ও প্রশাসনিক কাজ এখনও বাকি আছে। ঠিকাদাররা যে অর্থ দাবি করছে, তার একটি অংশ নিয়ে কর্তৃপক্ষের আপত্তি রয়েছে। এ কারণে নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া বিলম্বিত হচ্ছে। কর্মকর্তারা দাবি করেন, বিষয়টি বন্ধুত্বপূর্ণ উপায়ে সমাধানের জন্য আলোচনা চলছে।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নির্দিষ্ট চুক্তির বাইরে ৬২০ ধরনের অতিরিক্ত কাজ করানো হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে চুক্তির বাইরে করা এসব কাজে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় হয়েছে। এটা আমাদের ন্যায্য পাওনা।

অন্যদিকে বেবিচকের ভাষ্য, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দাবিকৃত অতিরিক্ত অর্থ সমন্বয় করা হয়েছে। এর পরও যেহেতু ডিসপুট বোর্ড গঠন করা হয়েছে, সেখানে যে সিদ্ধান্ত হবে, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সূত্রে জানা গেছে, ডিসপুট বোর্ডে সিদ্ধান্ত না হলে বিষয়টি ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট (আইসিসি) পর্যন্ত গড়াতে পারে। এটি হলে দেশের মান ক্ষুণ্ন হবে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। যেহেতু বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী রাষ্ট্র হচ্ছে জাপান।

উল্লেখ্য, শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৯ সালে। প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল যাত্রী ধারণক্ষমতা তিনগুণ বৃদ্ধি করা এবং আন্তর্জাতিক মানে বিমান চলাচলের সুবিধা নিশ্চিত করা। টার্মিনালের কাজ করেছে জাপানি প্রতিষ্ঠান নিপ্পন কোইরি, নির্মাণ করেছে এডিসি- যার নেতৃত্বে রয়েছে জাপানের মিতসুবিশি করপোরেশন, ফুজিতা করপোরেশন এবং দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাং সিঅ্যান্ডটি করপোরেশন।

উদ্বেগের বিষয় হলো, টার্মিনালটির যন্ত্রাংশ ও প্রযুক্তিনির্ভর অবকাঠামো দীর্ঘদিন ব্যবহৃত না হলে বা সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ না হলে নষ্ট হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, উচ্চ আর্দ্রতার কারণে ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম, স্ক্যানার, কনভেয়র বেল্ট ও স্বয়ংক্রিয় লাগেজ সিস্টেমে ত্রুটি দেখা দিতে পারে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, তৃতীয় টার্মিনাল চালু করার জন্য এখনও অপারেটর নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ফলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকেই এখন রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিতে হচ্ছে। এটি দীর্ঘায়িত হলে বড় ক্ষতি হতে পারে।