Image description

বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী একটি বাণিজ্যিক বাসের জন্য রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট, ফিটনেস সার্টিফিকেট, ট্যাক্স টোকেন, ইন্স্যুরেন্স সার্টিফিকেট এবং রুট পারমিট থাকা বাধ্যতামূলক। এর মধ্যে রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট একবার নেওয়া হলে আজীবনের জন্য বৈধ থাকে, কিন্তু বাকিগুলো প্রতি বছর নবায়ন করতে হয়। ফলে প্রতি বছর বাস-মালিকদের ছুটতে হয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) সার্কেল অফিসে।

বাস-মালিকদের অভিযোগ, নির্ধারিত ফি দেওয়ার পরও ঘুষ ছাড়া ফিটনেস সার্টিফিকেট পাওয়া যায় না। তাদের ভাষায়, ‘গাড়ির সবকিছু ঠিক থাকলেও অতিরিক্ত টাকা না দিলে ফিটনেস সার্টিফিকেট দেওয়া হয় না।’ তাদের হিসাবে, এই ঘুষের পরিমাণ ন্যূনতম পাঁচ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত। যেসব বাসে কোনো ত্রুটি থাকে না, তাদের ক্ষেত্রে অন্তত পাঁচ হাজার টাকা দিতে হয় কর্মকর্তাদের দালালদের মাধ্যমে। আর যেসব বাসে প্রকৃত সমস্যা থাকে, সেগুলোর ক্ষেত্রে সমস্যার ধরন অনুযায়ী ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ গুনতে হয়।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আসলে বিআরটিএ-এর নিজেরই ফিটনেস আছে কি না, সেটাই এখন প্রশ্ন। তারা মনে করেন, বিদেশে যেখানে ফিটনেস পরীক্ষায় ব্যর্থ যানবাহন সরাসরি বাতিল করে দেওয়া হয়, সেখানে আমাদের দেশে ঘুষের বিনিময়ে ফিটনেস সনদ দেওয়া হয়। ফলে যাত্রীদের নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে ঝুঁকির মুখে পড়ছে।

 

বিষয়টি নিয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, ঘুষের বিনিময়ে ফিটনেস সনদ দেওয়া বিষয়ে তারা অবগত নন। যদি প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাস-মালিকদের ভাষায়, ‘গাড়ির সবকিছু ঠিক থাকলেও অতিরিক্ত টাকা না দিলে ফিটনেস সার্টিফিকেট দেওয়া হয় না।’ তাদের হিসাবে, এই ঘুষের পরিমাণ ন্যূনতম পাঁচ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত। যেসব বাসে কোনো ত্রুটি থাকে না, তাদের ক্ষেত্রে অন্তত পাঁচ হাজার টাকা দিতে হয় কর্মকর্তাদের দালালদের মাধ্যমে। আর যেসব বাসে প্রকৃত সমস্যা থাকে, সেগুলোর ক্ষেত্রে সমস্যার ধরন অনুযায়ী ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ গুনতে হয়

সম্প্রতি ঢাকা পোস্টের সঙ্গে তিনটি বাস কোম্পানির মালিকের কথা হয় ফিটনেস নবায়ন নিয়ে। তবে, তারা কেউই নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। তিনজনই এক বাক্যে বলেছেন, ‘ঘুষ ছাড়া বিআরটিএ থেকে বাসের ফিটনেস নেওয়া অসম্ভব!’

বাস-মালিকদের ভাষ্য, গাড়ির সবকিছু ঠিক থাকলেও অতিরিক্ত টাকা না দিলে ফিটনেস সার্টিফিকেট দেয় না বিআরটিএ / ছবি- ঢাকা পোস্ট

আন্তঃজেলা রুটে চলাচলকারী এক বাস-মালিক বলেন, ‘আগে গাড়ি বিআরটিএ অফিসে না নিয়ে গিয়েও ফিটনেস সার্টিফিকেট পাওয়া যেত। কিন্তু এখন গাড়ি নিয়ে যেতে হয়। সেখানে নানা ধরনের টেস্ট করা হয়। ইন্ডিকেটর লাইট, ব্রেক, গ্লাস, এমনকি বাহ্যিক রঙ— চকচকে অবস্থাও দেখা হয়। কিন্তু যত ফিট গাড়িই হোক না কেন, টাকা না দিলে টেস্টে ফেল করানো হয়।’

‘গাড়ি নিয়ে গেলে কিছু টাকা দিতেই হবে। যদি আমি টাকা না দিই, তাহলে তারা একটা না একটা ভুল বের করবেই। এটা তো আর বিদেশ না যে গাড়ি ফিট থাকলে সার্টিফিকেট দিবেই। সব ঠিক থাকলেও অন্তত পাঁচ হাজার টাকা দিতে হয়। আর যদি কোনো সমস্যা থাকে, তাহলে তার ভিত্তিতে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। টাকা দিতে হয় দালালের হাতে। না দিলে ইন্সপেক্টর ভুল ধরবেই।’

অন্য এক মালিক বলেন, গাড়ির সামনের গ্লাসে সামান্য ফাটাও থাকলে সেটা ধরে ফেলেন ইন্সপেক্টর। অথচ ওই দাগ নিয়ে দীর্ঘ সময় গাড়ি চালানো সম্ভব। ‘এখন যদি গ্লাসটা পুরোপুরি পাল্টাতে যাই, তাহলে অন্তত ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়। তাই মালিকরা ঘুষ দিয়ে ফিটনেস নিতে বাধ্য হন। না দিলে বিশাল ক্ষতি।’

বিদেশে যেখানে ফিটনেস পরীক্ষায় ব্যর্থ গাড়ি সরাসরি বাতিল হয়, সেখানে আমাদের দেশে টাকা দিলে আনফিট যানও রাস্তায় চলে / ছবি- ঢাকা পোস্ট

তার অভিযোগ, ঢাকা শহরে গাড়ি ঢুকলে বাসের রঙ ঠিক থাকে না। কেউ না কেউ ঘষা দেবেই। ফলে রঙ উঠে যায়। অথচ নতুন করে রঙ করাতে এক লাখ টাকার বেশি খরচ হয়। এত খরচের পরও যদি সামান্য রঙ ওঠে, সেটার জন্যও তারা গাড়িকে ফেল করিয়ে দেন।

অপর বাস-মালিক জানান, রেজিস্ট্রেশন করাতেও কখনও কখনও ৩০ হাজার টাকার বেশি ঘুষ দিতে হয়। একটি গাড়ির বডি বানাতে অন্তত ১৮ লাখ টাকা খরচ হয়। ‘সব কাগজ ঠিক থাকার পরও ইন্সপেক্টর বলবেন, সিট কাভার ময়লা, তাই গাড়িটা পুরোনো মনে হচ্ছে— রেজিস্ট্রেশন হবে না। পরে বাধ্য হয়ে ৩০ হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে রেজিস্ট্রেশন নিতে হয়েছে।’

বিআরটিএ আধুনিক হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এখনও ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ হয় না’— অভিযোগ এক বাস-মালিকের / ছবি- ঢাকা পোস্ট

‘একটি রুট পারমিট নিতে সরকারি ফি সাত হাজার টাকার বাইরে আরও আট থেকে ১০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়। বিআরটিএ আধুনিক হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এখনও ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ হয় না’— অভিযোগ করেন তিনি।

এ বিষয়ে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, “ফিটনেস প্রদানের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা বিআরটিএ-এর অবস্থাও প্রশ্নবিদ্ধ। এটি আসলে একটি উচ্চমাত্রার টেকনিক্যাল কাজ, যেখানে গাড়ির যান্ত্রিক ও কাঠামোগত সক্ষমতা বিশ্লেষণ করতে হয়। কিন্তু সংস্থাটির নিজস্ব টেকনিক্যাল সক্ষমতা দুর্বল। অনেক ক্ষেত্রেই চোখে দেখে ফিটনেস সার্টিফিকেট দেওয়া হয়, আবার ঘুষের বিনিময়ে আনফিট গাড়িকেও ‘ফিট’ ঘোষণা করা হয়। তাই এখন প্রশ্ন উঠেছে— যানবাহনের ফিটনেস দেখার আগে বিআরটিএ-এর নিজের ফিটনেস আছে কি না, সেটাই আগে দেখা দরকার।”

‘বিদেশে যেখানে ফিটনেস পরীক্ষায় ব্যর্থ গাড়ি সরাসরি বাতিল হয়, সেখানে আমাদের দেশে টাকা দিলে আনফিট যানও রাস্তায় চলে। এতে বোঝা যায়, সরকার নিজেই যাত্রীদের ঝুঁকিপূর্ণ গাড়িতে ওঠার সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে। ফলে, যাত্রীদের নিরাপত্তা এখন পুরোপুরি প্রশাসনিক অনিয়মের হাতে জিম্মি।’

ফিটনেস নবায়নে ঘুষ নেওয়ার ব্যাপারে আমি অবগত নই। প্রমাণ পেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা— বিআরটিএ চেয়ারম্যান আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদ / ঢাকা পোস্ট

সার্বিক বিষয় নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)-এর চেয়ারম্যান আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ফিটনেস নবায়নে ঘুষ নেওয়ার ব্যাপারে আমি অবগত নই। যদি কেউ এমন করে থাকে এবং প্রমাণ পাওয়া যায়, তবে তার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’