
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন এখন সরগরম। বিশেষ করে ফরিদপুর-৩ আসনে নানা আলোচনা সৃষ্টি করেছেন বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের যুগ্ম সম্পাদক চৌধুরী নায়াব ইউসুফ। ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক পরিবার থেকে উঠে আসা এই নারী নেত্রী মাঠপর্যায়ে সক্রিয় থেকে তৃণমূলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। রাজনীতির প্রতি তাঁর অঙ্গীকার ও পারিবারিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার তাঁকে ফরিদপুরের মানুষের কাছে ইতোমধ্যেই পরিচিত ও বিশ্বাসযোগ্য মুখে পরিণত করেছে।
নায়াব ইউসুফের রাজনীতিতে আসা পারিবারিক উত্তরাধিকার থেকে হলেও তাঁর পথচলা গড়ে উঠেছে নিজস্ব পরিশ্রম ও জনগণের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কের মাধ্যমে। তিনি বলেন, ‘আমার আব্বা চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ দীর্ঘদিন এই জনপদের মানুষের সেবা করেছেন। আমি তাঁর সঙ্গে রাজনীতি করেছি। আব্বার মৃত্যুর পর মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ আরও বেড়েছে, তাঁর শূন্যস্থান পূরণের চেষ্টা করছি।’ ২০০৯ সাল থেকে রাজনীতিতে সক্রিয় নায়াব ইউসুফ। ফরিদপুরের বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রাম ও দলীয় কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দিয়েছেন। পাশাপাশি দলের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। মহিলা দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি ঢাকা মহানগর উত্তর শাখার নেতৃত্বও দিয়েছেন। সম্প্রতি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে তিনি মহানগরের দায়িত্ব ছেড়ে পুরোপুরি মনোযোগ দিয়েছেন ফরিদপুরে। তাঁর মতে, ‘জনগণের সঙ্গে আরও নিবিড়ভাবে কাজ করতে। তাই এলাকার মানুষের পাশে থেকে কাজ করছি।’ দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও আসন্ন নির্বাচনের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন না হওয়ায় মানুষ আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু এখন মানুষ পরিবর্তন চায়, গণতন্ত্র চায়। তারা এমন নেতা চায়, যিনি ভোটের পরও পাশে থাকবেন। আমরা একটি গণতান্ত্রিক সরকার চাই। ফরিদপুরের মানুষ যেন এমন প্রার্থীকে বেছে নেয়, যিনি সত্যিকার অর্থে জনগণের কল্যাণে কাজ করবেন।’ ফরিদপুরের বর্তমান রাজনীতি প্রসঙ্গে চৌধুরী নায়াব ইউসুফ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ফরিদপুরে এখনো আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী একজন নেতা প্রশাসনের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে প্রকাশ্যে রাজনীতি করছেন, যা দেশের অন্যান্য অঞ্চলে দেখা যায় না।
তাঁর অভিযোগ, ‘এ কে আজাদ নামে আওয়ামী লীগের একজন বড় নেতা প্রশাসনিক সহায়তায় মাঠে সক্রিয় আছেন। তিনি টাকার প্রভাব খাটিয়ে ভোটের পরিবেশকে বিকৃত করছেন। এটি শুধু দুঃখজনক নয়, গণতন্ত্রের জন্যও লজ্জাজনক।’ নায়াব ইউসুফ বলেন, ‘সরকার একদিকে ঘোষণা দিয়েছে যে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ, অন্যদিকে তাদের নেতাদের নির্বাচনি মাঠে সক্রিয় রাখছে। এটি স্পষ্টভাবে দ্বিমুখী আচরণ, যা সাধারণ মানুষ ভালোভাবে নিচ্ছে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘এ কে আজাদ আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন। অতীতে তিনি তথাকথিত নির্বাচনে ডামি প্রার্থী হয়ে আওয়ামী লীগকে বৈধতা দিয়েছেন। এখনো প্রশাসনের ছত্রছায়ায় তাঁর কার্যক্রম চলমান। ফরিদপুর সম্ভবত একমাত্র জেলা, যেখানে নিষিদ্ধ ঘোষিত দলের নেতারা প্রকাশ্যে রাজনীতি করছেন। বিষয়টি সত্যিই বিস্ময়কর।’ নায়াব ইউসুফের দাবি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রভাবেই এই নেতার রাজনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। ‘একাধিক সভা-সমাবেশে তিনি নিজেই বলেছেন, মন্ত্রণালয়ের উৎসাহেই তাঁকে ফরিদপুরে পাঠানো হয়েছে। আওয়ামী লীগের দোসরদের বিরুদ্ধে মামলা হলে তিনি প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে তা মীমাংসা করেন। এতে মূলত আওয়ামী লীগকেই পুনর্বাসনের চেষ্টা চলছে’ বলেন তিনি। সরকার ও প্রশাসনের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে নায়াব ইউসুফ বলেন, ‘এটি অগ্রহণযোগ্য যে নিষিদ্ধ ঘোষিত দলের একজন নেতা প্রকাশ্যে রাজনীতি করছেন, এমনকি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ইঙ্গিতও দিচ্ছেন। সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করতে অবৈধভাবে টাকা ছড়ানো হচ্ছে। এতে ভোটের পরিবেশ কলুষিত হচ্ছে এবং জনগণের আস্থা নষ্ট হচ্ছে।’
তিনি আরও যোগ করেন, ‘যদি সত্যিই মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হয়, তাহলে দেখা যাবে এ কে আজাদ কীভাবে বা কোন প্ল্যাটফর্ম থেকে প্রার্থী হন। আমরা চাইব তাঁকে যেন নির্বাচনের মাঠে থাকার সুযোগ না দেওয়া হয়। সরকার একদিকে নিষেধাজ্ঞার কথা বলবে, অন্যদিকে একই দলের নেতাকে সুযোগ দেবে- এটি জনগণ মেনে নেবে না। ফরিদপুরের মানুষ এই দ্বিমুখী আচরণের জবাব দেবে।’ ফরিদপুর নিয়ে বিভিন্ন ভাবনা এবং আগামী নির্বাচন ঘিরে মানুষের ব্যাপক উৎসাহের বিষয়েও কথা বলেন নায়াব ইউসুফ। তরুণ প্রজন্মকে রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারেও তিনি গুরুত্বারোপ করেন। তাঁর মতে, ‘দীর্ঘদিন সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়ায় তরুণদের মধ্যে রাজনীতির প্রতি আস্থা কমে গেছে। তাদের শিক্ষার সুযোগ, খেলাধুলা ও ইতিবাচক চিন্তার মাধ্যমে আবার রাজনীতিমুখী করতে হবে। আমি চাই তরুণরা যেন রাজনীতিতে অংশ নেয়, দেশকে ভালোবাসে। দলের অভ্যন্তরীণ সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি ফরিদপুর-৩ আসনে তাঁকেই মনোনয়ন দিতে পারে দল। তবে এ বিষয়ে নায়াব ইউসুফ সতর্ক কণ্ঠে বলেন, ‘মনোনয়ন এখনো ঘোষণা হয়নি। কিন্তু তারেক রহমান বলেছেন, এলাকায় সময় দিতে। এতেই বোঝা যায় তিনি আমার ব্যাপারে ইতিবাচক।’ ফরিদপুরের রাজনীতিতে চৌধুরী পরিবারের ভূমিকা দীর্ঘদিনের। তাঁর দাদা জমিদার ইউসুফ আলী চৌধুরী ছিলেন মানবসেবায় নিবেদিত একজন প্রভাবশালী নেতা। তিনি চরাঞ্চলের মানুষের শিক্ষা ও চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন।
নায়াব ইউসুফ বলেন, ‘আমার দাদা গ্রামের মানুষ যেন পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে, সেজন্য শহরে ছাত্রাবাস তৈরি করেছিলেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল সবকিছুই তিনি নিজ উদ্যোগে গড়ে তুলেছিলেন।’
তাঁর মতে, ফরিদপুরের মানুষ রাজনীতির ঊর্ধ্বে গিয়ে তাঁদের পরিবারকে ভালোবাসে। তাঁর বাবা চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ পাঁচবার এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। মানুষ রাজনীতির হিসাব না করে ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে ভালোবেসেছে। তাঁদের পরিবারের প্রতি মানুষের আস্থা আছে। এটিকে সবচেয়ে বড় শক্তি হিসেবে বিবেচিত করেন নায়াব ইউসুফ।
নায়াব ইউসুফ মনে করেন, ‘বিএনপি ফরিদপুরে শক্ত অবস্থান গড়ে তুলতে পেরেছে মূলত এই ঐতিহ্য ও জনগণের ভালোবাসার কারণেই। এই অঞ্চলে আওয়ামী লীগের শক্ত অবস্থান ছিল। কিন্তু আমার আব্বার নেতৃত্বে বিএনপি এখানে সংগঠিত হয়েছে। অন্য কেউ হয়তো এমনটা করতে পারত না।’
তিনি দলের বর্তমান সাংগঠনিক শক্তি প্রসঙ্গে বলেন, ‘তারেক রহমান আমাদের দূর থেকে থেকেও এমনভাবে সংগঠিত করেছেন যে এখন প্রতিটি ওয়ার্ড পর্যন্ত বিএনপির কমিটি আছে। তিনি যে নির্দেশনা দিয়েছেন, তার সুফল আমরা পাচ্ছি।’
ফরিদপুরের উন্নয়ন ও প্রান্তিক মানুষের জীবনমান নিয়ে নিজের পরিকল্পনা তুলে ধরে নায়াব ইউসুফ বলেন, ‘আমাদের বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে বহু মানুষ বসবাস করে, তাদের যাতায়াতের কোনো সহজ ব্যবস্থা নেই। রাস্তাঘাটগুলো যান চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতে ব্যাপক কাজ করতে হবে।’ তিনি জানান, ফরিদপুরে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, চরাঞ্চলের স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়ন ও অবকাঠামো সংস্কারের পরিকল্পনা তাঁর অগ্রাধিকার।
নায়াব ইউসুফ বলেন, ‘আমার আব্বা এখানে ২৫০ বেডের হাসপাতাল করেছিলেন, যা পরে ৫০০ বেডে উন্নীত হয়। কিন্তু আজও দূরদূরান্তের মানুষ যথাযথ চিকিৎসা পাচ্ছে না। এসব খাতে নতুন উদ্যোগ নিতে হবে।’
নায়াব ইউসুফ বলেন, ‘বিএনপি সরকার গঠনের সুযোগ পেলে ফরিদপুরে সেনানিবাস স্থাপন, ফরিদপুর সদরকে সিটি করপোরেশনে উন্নীতকরণ এবং গোয়ালন্দ-দৌলতদিয়া রুটে দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হবে।’ তিনি মনে করেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ফরিদপুর অবহেলিত ছিল। গোপালগঞ্জকে প্রাধান্য দিয়ে ফরিদপুরকে উপেক্ষা করা হয়েছে।
নারী নেতৃত্বে নিজের অবস্থান ও অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে নায়াব ইউসুফ বলেন, ‘আমাদের দেশে নারীদের এখনো অনেক সময় দুর্বল মনে করা হয়। কিন্তু আমি মাঠে থেকে প্রমাণ করেছি, নারী নেতৃত্ব পুরুষের মতোই কার্যকর হতে পারে। আমি আন্দোলনে থেকেছি, মামলা-হামলার শিকার হয়েছি, জেলও খেটেছি। তবু থেমে যাইনি।’ তিনি মনে করেন, নারীদের ভোট ও সমর্থনই তাঁর রাজনীতির বড় শক্তি। নারী ভোটাররা মোট ভোটের অর্ধেক। একজন মা ও নারী হিসেবে আমি তাঁদের সহজে বোঝাতে পারি, তাঁদের পাশে থাকতে পারি। একজন পুরুষ প্রার্থী হয়তো তা পারে না।
কমসূচি তৃণমূল পর্যায়ে নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে তিনি ইতোমধ্যেই বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে উঠান বৈঠক, মহিলা সমাবেশ ও কৃষক সমাবেশ করছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আমি খালি বক্তৃতা দিই না, কাজ করি। মহিলাদের সেলাই প্রশিক্ষণ দিচ্ছি, বাগান করার উৎসাহ দিচ্ছি, ক্ষুদ্রঋণের ব্যবস্থা করছি। অনলাইনে মাত্র ১০০ টাকায় চিকিৎসা পরামর্শের সুযোগ তৈরি করেছি।’
নিজের ভবিষ্যৎ স্বপ্নের কথা বলতে গিয়ে নায়াব ইউসুফ বলেন, ‘আমার আব্বার অসম্পূর্ণ স্বপ্নগুলো পূরণ করতে চাই। ফরিদপুরকে সৌহার্দপূর্ণ ও শান্তিপূর্ণ শহরে রূপ দিতে চাই, যেখানে সবাই সমান অধিকার নিয়ে বাঁচবে। শিক্ষার প্রসার, স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন, পরিচ্ছন্নতা ও নাগরিক সচেতনতা বাড়ানো- এসবই আমার লক্ষ্য।’ তিনি মনে করেন, ‘দেশের উন্নয়ন শুধু সরকারের নয়, জনগণেরও দায়িত্ব। আমাদের প্রত্যেককে দেশকে ভালোবাসতে হবে। প্রতিটি সরকারি প্রতিষ্ঠানকে নিজের সম্পদ হিসেবে ভাবতে হবে। তবেই প্রকৃত পরিবর্তন আসবে।’
নির্বাচন সামনে রেখে তিনি আশাবাদী কণ্ঠে জানান, এবার মানুষ ভুল করবে না। ফরিদপুরের মানুষ সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে। তারা এমন প্রার্থী বেছে নেবে, যিনি গণতন্ত্রের পক্ষে, মানুষের পাশে এবং দেশের কল্যাণে কাজ করবেন।