Image description

রাজধানীর গণপরিবহনগুলোর নাজুক ও ভঙ্গুর অবস্থা নতুন কিছু নয়। দিনদিন সিটিতে চলাচলকারী বাসগুলোর আকার ছোট হয়ে আসছে। বসার আসন থেকে শুরু করে লাইট-ফ্যান— কিছুই যাত্রীদের অনুকূলে নেই। বরং ভাঙাচোরা আসন ও অব্যবস্থাপনার কারণে বসেও আহত হচ্ছেন যাত্রীরা। অথচ কিলোমিটারপ্রতি সর্বোচ্চ ভাড়া নিয়েও যাত্রীসেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে ঢাকার পরিবহন মালিক-চালকদের মানসিকতা সর্বনিম্ন অবস্থানে।

সাম্প্রতিক সময়ে এমনই এক তিক্ত অভিজ্ঞতার শিকার হন আদনান বাবু আদর নামের এক যাত্রী। তিনি সন্ধ্যা ৭টার দিকে টেকনিক্যাল মোড় থেকে ফার্মগেটের উদ্দেশে যাবেন বলে ৮ নম্বর বাসে উঠেছিলেন। মেট্রোরেলের ফার্মগেট স্টেশনের নিচে বাসের হঠাৎ ব্রেকে হাঁটুর কাছে তীব্র ব্যথা অনুভব করেন। তিনি খেয়াল করে দেখেন, জিন্স প্যান্টের খানিকটা অংশ ছিঁড়ে গেছে। শরীরের চামড়াও কেটে গেছে, রক্ত বের হচ্ছে।

সেই সময়ের কথা জানতে চাইলে আদর ঢাকা পোস্টকে বলেন, “সন্ধ্যার পর আন্তঃজেলা বাস থেকে নেমে টেকনিক্যাল মোড়ে এসে ৮ নম্বর বাসে উঠি। উদ্দেশ ফার্মগেট যাব। পেছনের চাকার কাছে ফাঁকা একটি সিটে বসি। দেখি বাসে দুটি বাতি মিটমিট করে জ্বলছে, বাকিগুলো নষ্ট। ফ্যানও নেই। ছোট সিটে পা ভাঁজ করে কোনো রকম খামারবাড়ি পর্যন্ত আসি। মেট্রো স্টেশনের নিচে বাস হঠাৎ করে ব্রেক করল। আমি সামনের দিকে ঝুঁকে গেলাম। একটু পরে হাঁটুর কাছে ব্যথা অনুভব করলাম। খেয়াল করে দেখলাম, সামনের সিটের পেছনে থাকা টিন বাঁকা হয়ে আছে। সেই টিনের আঘাতে হাঁটু কেটে রক্ত বের হচ্ছে। কন্ডাক্টরকে ডাকলাম, সে ‘সরি’ বলে চলে গেল।”

রাজধানীর গণপরিবহনগুলোর অবস্থা অত্যন্ত নাজুক ও ভঙ্গুর। এ অবস্থার মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছেন সাধারণ মানুষ / ছবি- ঢাকা পোস্ট

‘অথচ এই পাঁচ কিলোমিটার পথের ভাড়া নিল ২০ টাকা! কোনো সেবাই তো ঠিকমতো পেলাম না, উল্টো রক্তাক্ত হলাম।’

ঢাকার বাসগুলোর ভেতরের পরিবেশ একেবারেই অস্বস্তিকর। সিটগুলো ভাঙাচোরা ও নোংরা, মাথার অংশে ময়লা জমে থাকে। কিছু ফ্যান ঘোরে, আবার অনেকগুলো একেবারেই নষ্ট। বসার জায়গা এতটাই সংকুচিত যে সামনের সিটের সঙ্গে হাঁটু লেগে যায়, ফলে জ্যামের সড়কে দীর্ঘসময় বসে থাকা কষ্টকর হয়ে পড়ে

নিয়মিত আবুল হোটেল থেকে বসুন্ধরা বাসস্টপেজ পর্যন্ত যাতায়াত করেন আশরাফুল ইসলাম। তিনি ঢাকা পোস্টকে জানান, ঢাকার বাসগুলোর ভেতরের পরিবেশ একেবারেই অস্বস্তিকর। সিটগুলো ভাঙাচোরা ও নোংরা, মাথার অংশে ময়লা জমে থাকে। কিছু ফ্যান ঘোরে, আবার অনেকগুলো একেবারেই নষ্ট। বসার জায়গা এতটাই সংকুচিত যে সামনের সিটের সঙ্গে হাঁটু লেগে যায়, ফলে জ্যামের সড়কে দীর্ঘসময় বসে থাকা কষ্টকর হয়ে পড়ে।

ভাড়ার ক্ষেত্রে নৈরাজ্য : ই-টিকিটিং জরুরি

ভাড়ার ক্ষেত্রেও অনিয়ম চলছে বলে অভিযোগ করে আশরাফুল ইসলাম বলেন, বেশিরভাগ বাসেই কোনো ভাড়ার তালিকা ঝোলানো থাকে না। কন্ডাক্টরের ইচ্ছামতো ভাড়া নেওয়া হয়। সবসময় রাউন্ড ফিগারে—১০, ১৫, ২০ টাকা নেওয়া হলেও হিসাব অনুযায়ী ভাড়া অনেক সময় ১২, ১৩ বা ১৮ টাকা হওয়ার কথা। কিন্তু কন্ডাক্টররা ভাংতি নেই বলে যাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি টাকা আদায় করে। এই বিশৃঙ্খলা দূর করতে সব বাসে ই-টিকিটিং ব্যবস্থা চালু করা জরুরি। কিছু পরিবহন ইতোমধ্যে এ ব্যবস্থা চালু করেছে, তবে তা সীমিত। ন্যায্যমূল্যে টিকিট চালু হলে ভাড়ায় স্বচ্ছতা যেমন আসবে, তেমনি যাত্রীদের ভোগান্তিও কমবে।

গত সোমবার (৬ অক্টোবর) সকালে রামপুরা থেকে আকাশ এন্টারপ্রাইজের একটি বাসে উঠে দেখা যায়, গেটের কাছে থাকা ফ্যানটি ঘুরছে না। জানতে চাইলে কন্ডাক্টর বলেন, ‘ফ্যান নষ্ট।’ অথচ গরমে ঘামছিলেন যাত্রীরা। এদিকে, সিটে বসার পর হাঁটু ঠিকভাবে রাখা যাচ্ছিল না। কোনো রকম চাপিয়ে বসতে হলো। সিট কভার দেখে মনে হলো, এটি লাগানোর পর আর কখনও ধোয়া হয়নি। ময়লা আর মানুষের ঘামে রং পাল্টে গেছে। বাস তৈরির সময় যেসব লাইট লাগানো হয়েছিল, সেগুলো ভেঙে ঝুলে আছে। অথচ বর্তমানে সিটিতে চলা বাসগুলো যাত্রীপ্রতি কিলোমিটারে দুই টাকা ৪৫ পয়সা ভাড়া নিয়ে থাকে।

ঢাকার বাসগুলোর ভেতরের পরিবেশ একেবারেই অস্বস্তিকর। সিটগুলো ভাঙাচোরা ও নোংরা, মাথার অংশে ময়লা জমে থাকে। কিছু ফ্যান ঘোরে, আবার অনেকগুলো একেবারেই নষ্ট / ছবি- ঢাকা পোস্ট

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও মালিক সমিতির বক্তব্য

দেশের প্রধান শহরের বাসগুলোর এমন অবস্থার বিষয়ে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিম্নমানের যাত্রীসেবা দেওয়ার পেছনে বাস-মালিক ও বিআরটিএ (বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ) উভয়ই দায়ী। এই দুই পক্ষ যোগসাজশে যাত্রীদের ঠকাচ্ছে।

যাত্রী পরিবহন অযোগ্য বাসগুলোর বিষয়ে সংগঠনের পক্ষ থেকে কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে— জানতে চাইলে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. সাইফুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমাদের মন্তব্য করা কঠিন। এসব গাড়ি রাস্তায় চলতে দেওয়া উচিত না। আমরা চিঠি দিয়ে দিয়েছি। আমরা বাস-মালিকদের ডেকে মিটিং করে বলেছি, গাড়ি শুধু কাগজে-কলমে ফিট থাকলেই হবে না। গাড়ির সিট ভালো থাকতে হবে, রং ভালো হতে হবে। গাড়ির ইন্ডিকেটর থাকতে হবে, গ্লাস ভালো থাকতে হবে। তারপরও অনেকে এগুলো মানছেন না। তারা গাড়িগুলো চালকদের কাছে কন্ট্রাক্ট সিস্টেমে দিয়ে দিয়েছেন।’

খেয়াল খুশি মতো ভাড়া নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এক-দেড় মাসের মধ্যে আমরা ই-টিকিটিং শুরু করব। স্টপেজ টু স্টপেজ গাড়ি দাঁড় করানো হবে। ওই সময় আমরা আরেকটা কাজ করব, এই যে আনফিট গাড়িগুলো— সেগুলোকে আমরা রাস্তায় চলতে দেব না। মালিক, শ্রমিক ও পুলিশ মিলে আমরা এটাকে প্রতিহত করব। এগুলো ফোর্স করে আমরা গ্যারেজে পাঠিয়ে দেব, আর না হলে এগুলো সরাসরি ডাম্পিং করা হবে।’

সিটগুলো অত্যন্ত সংকীর্ণ, ঠিক মতো বসা যায় না। গাদাগাদি করা বাসে দাঁড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না / ছবি- ঢাকা পোস্ট

গণপরিবহনগুলোর নাজুক ও ভঙ্গুর অবস্থা সম্পর্কে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এমন বাজে যাত্রীসেবা দেওয়ার পেছনে আমি মনে করি, উভয় পক্ষই দায়ী। অর্থাৎ বাস-মালিক ও বিআরটিএ; যেহেতু এটা সেবামূলক খাত, এখানে সিটের কন্ডিশন, ফ্লোরের কন্ডিশন, ফ্যান, লাইট, সিট ইত্যাদি ঠিকঠাক রাখা বাস-মালিকদের দায়িত্ব। আর যেহেতু বাসগুলো প্রতি বছরই ফিটনেসের জন্য বিআরটিএ-তে যায়, সেখানে বিআরটিএ-এর দায়িত্ব এসব ভালোভাবে দেখা। কিন্তু উভয় পক্ষের যোগসাজশে উভয় পক্ষই যাত্রীদের ঠকাচ্ছে।’

‘পরিবহন সেবা খাত হলেও এটি বর্তমানে পুরোপুরি ব্যবসামূলক খাতে পরিণত হয়েছে। কারণ, বাস রাস্তায় নামিয়ে দিতে পারলেই টাকা আসে। যাত্রীসেবার উদ্দেশ্য থাকলে তো যাত্রীরা আরামে যাতায়াত করতে পারত। বাসের সবকিছু ঠিকঠাক থাকত। এগুলো কিন্তু শুধুমাত্র সেবার বিষয় না, নিরাপত্তার জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ।’

ঢাকার গণপরিবহনের নাজুক অবস্থার প্রধান কারণ হলো অপরিকল্পিত নগরায়ণ, অপর্যাপ্ত ও অদক্ষ গণপরিবহন ব্যবস্থা এবং ব্যক্তিগত যানবাহনের অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি / ছবি- ঢাকা পোস্ট

করণীয় কী— জানতে চাইলে এই যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘সরকারকে শক্ত হাতে বাসের স্টিয়ারিং সিট নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তা না হলে কখনও সঠিক যাত্রীসেবা পাওয়া যাবে না। স্টিয়ারিং সিট নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলে মালিকরা শুধু ব্যবসা করেই যাবেন, যাত্রীদের কোনো লাভ হবে না।’

এ বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপ কী— জানতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঢাকায় পাঁচ লাখ বাসের রেজিস্ট্রেশন দেওয়া থাকলেও বাস্তবে এর দ্বিগুণ বাস সড়কে চলছে। আমাদের সড়কের তুলনায় বাসের সংখ্যা বেশি, আবার যাত্রীদের চাহিদাও অনেক। ফলে বাস রিপ্লেসমেন্ট না করে এগুলো সড়ক থেকে সরানো যাচ্ছে না। বাস-মালিকদের সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার বিষয়ে কাজ চলছে, যাতে তারা নতুন বাস এনে পুরোনোগুলো রিপ্লেস করতে পারেন।